“বাজারের স্বার্থে যেসব সুপারিশ গ্রহণযোগ্য, যাচাই-বাছাইয়ের পর সেগুলো বাস্তবায়ন করা হলে তাতে দীর্ঘ মেয়াদে বাজারে তার সুফল মিলবে বলে আশাবাদী সরকার।”
Published : 20 Oct 2024, 08:43 PM
পুঁজিবাজারে টানা দরপতন নিয়ে বিনিয়োগকারীদের হতাশা ও ক্ষোভের মধ্যে একে ‘অতীতের কারসাজির অনিবার্য ফল’ বলে ব্যাখ্যা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সুশাসন নিশ্চিতে উদ্যোগ নেওয়ার কথা তুলে ধরে ব্যাখ্যায় দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল মিলবে বলেও আশার কথা বলা হয়েছে।
রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স ৯৭ পয়েন্ট এবং একদিনেই বাজার মূলধন ৬ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা কমার মধ্যে সন্ধ্যার পর মন্ত্রণালয়ের এই বক্তব্য এল।
গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর টানা চার কর্মদিবসে প্রায় আটশ পয়েন্ট সূচক বৃদ্ধির পর থেকে যে টানা দরপতন ঘটছে, তাতে সূচক কমেছে ৮৫৫ পয়েন্ট।
তবে চার দিনের উত্থানের পর বিনিয়োগ বাড়িয়ে বিনিয়োগকারীরা এখন চরম হতাশায় পড়েছেন।
এই দরপতনে হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি বাদে প্রায় সব কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক আর্থিক লোকসান হয়েছে। আড়াই মাসেরও কম সময়ে বাজার মূলধন কমেছে ৫০ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা।
এই সময়ে ইসলামী ব্যাংক, ইবনেসিনা ফার্মাসিউটিক্যালস, ব্র্যাক ব্যাংক, গ্রামীণ ফোনের মত অল্প কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারদর ও বাজার মূলধন বেড়েছে। কোনো কোনো কোম্পানির শেয়ারদর অর্ধেকেরও নিচে নেমে গেছে।
এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কার্যালয় ঘেরাও করেছে, সংস্থাটির নতুন চেয়ারম্যানের পদত্যাগও দাবি করেছে।
টানা দরপতনের ব্যাখ্যা দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “এই বাজারে লাগামহীন কারসাজির মাধ্যমে দুর্বল মৌলভিত্তির, জাঙ্ক কোম্পানির শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
“ফ্লোর প্রাইস আরোপ, সার্কিট ব্রেকারের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমায় নানা কৃত্রিম ব্যবস্থায় বাজারের এ অবস্থা ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এখন ওই কৃত্রিম চেষ্টা না থাকায় ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকা অনিয়ম, দুর্নীতি, কারসাজির অনিবার্য পরিণতি এখন আগের চেয়েও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে।”
অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, “পতিত আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মত পুঁজিবাজারেও অবাধ ‘লুটতরাজ’ সংঘটিত হয়েছে। এ সময়ে অসংখ্য দুর্বল ও প্রায় অস্তিত্বহীন কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এ কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারের জন্য আজ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমেই এসব কোম্পানির আসল চেহারা প্রকাশিত হচ্ছে।”
‘দীর্ঘমেয়াদে সুফল মিলবে’
পুঁজিবাজারে সংস্কারে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোরও একটি বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায়।
বাজারের স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে বিগত সময়ের ‘অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতির বিষয়ে’ অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য একটি ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠন করা হয়েছে বলেও উল্লেখ আছে এতে।
বলা হয়েছে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন নিশ্চিত করতে পুঁজিবাজার সংস্কারের সুপারিশের জন্য পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭টি।
“রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক এর সংস্কার, রেগুলেটরি কমপ্লায়েন্স ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিতকরণ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন, পুঁজিবাজারে পণ্য ও বাজার উন্নয়নে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ, বিনিয়োগ শিক্ষার প্রসার ও ব্যাপ্তি বৃদ্ধি, বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি, পুঁজিবাজারে কর্মরত পেশাজীবীদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার, বাজারের বৈচিত্র্য আনতে নতুন পণ্য আনা, সর্বোপরি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি এবং পুঁজিবাজারের গঠনমূলক ও টেকসই সংস্কার ইত্যাদি সংস্কারমূলক কার্যক্রমে বিএসইসি কাজ করছে।”
টাস্কফোর্স কার্যক্রমের বাইরেও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পুঁজিবাজারের সার্বিক উন্নয়ন ও সংস্কারে পথনকশা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে বলেও উল্লেখ করেছে মন্ত্রণালয়।
“অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে বাজারের বিভিন্ন সমস্যা ও করণীয় বিষয়ে নানা সুপারিশ উঠে এসেছে। বাজারের স্বার্থে যেসব সুপারিশ গ্রহণযোগ্য, যাচাই-বাছাইয়ের পর সেগুলো বাস্তবায়ন করা হলে তাতে দীর্ঘ মেয়াদে বাজারে তার সুফল মিলবে বলে আশাবাদী সরকার।”
বিএসইসি কী করছে?
পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি কী করছে, তাও তুলে ধরা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায়।
তারা বলেছে, পুঁজিবাজার তদারকি ও কারসাজি নিয়ন্ত্রণে সার্ভিলেন্স সিস্টেমের উন্নয়নে বিএসইসি বিশ্বব্যাংকের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে। ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারের সরবরাহ বাড়ানোরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে সংস্থাটি।
পুঁজিবাজারের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন, তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে কোম্পানির ভ্যালুয়েশন, আইপিও অনুমোদন ও তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া সহজিকরণ ও দ্রুত সম্পাদনসহ বিভিন্ন বিষয়ে কমিশন কাজ করছে বলেও জানানো হয়।
“বিভিন্ন খাতের গুরুত্বপূর্ণ শক্তিশালী মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিগুলোর দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি একদিকে যেমন দেশের পুঁজিবাজারকে আরও শক্তিশালী করবে, অন্যদিকে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে অর্থায়নের ফলে এসব বিভিন্ন খাতের অধিকতর বিকাশের মাধ্যমে দেশের শিল্পায়ন ও উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করার সুযোগ তৈরি হবে।”
পাবলিক ইস্যু রুলস ২০১৫-এর সংস্কারের মাধ্যমে কোম্পানিগুলো যাতে যৌক্তিক মূল্য পায় সে বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বলেছে, এতে বহুজাতিক কোম্পানি-সহ ভালো মৌলভিত্তিক কোম্পানির তালিকাভুক্তিতে সহায়ক হবে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, “পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে করপোরেট অনুশীলন করতে হবে। নিয়মিতভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের তথ্য প্রকাশ করতে হবে, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে।
“সরকার আশাবাদী যে সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে গভীরতা বৃদ্ধি পাবে ও সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানির মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী হবে।”
আরও পড়ুন-
বিএসইসিতে নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি সশস্ত্র বাহিন
বিএসইসিতে নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি সশস্ত্র বাহিনী: আইএসপিআর
পুঁজিবাজার: দুই মাসে বাজার মূলধন কমল ৪০ হাজার কোটি টাকা