পুঁজিবাজারের কোম্পানি: আর্থিক প্রতিবেদনের খবর নেই, প্রতিকারও নেই

পুঁজিবাজার থেকে শত শত কোটি টাকা তোলা নতুন বা পুরনো কোম্পানির তথ্য না জানানোর ঘটনা একটি কিংবা দুটি নয়।

ওয়াসেক বিল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 April 2023, 04:28 AM
Updated : 2 April 2023, 04:28 AM

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অ্যাপোলো ইস্পাত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাব প্রকাশের পর এখন পর্যন্ত কোনো প্রান্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। আইন অনুযায়ী এই সময়ে আরও ১৪টি প্রান্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার কথা।

নির্ধারিত সময়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ না হলে প্রতিদিন দিতে হবে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা। কিন্তু অ্যাপোলো ইস্পাতের এ বিষয়ে কোনো বিজ্ঞপ্তি আসেনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে।

কারণ জানতে কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের উপায়ও নেই। স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে দেওয়া ছয়টি ল্যান্ডফোন নম্বরের সবগুলোই অচল। কোম্পানি সচিবের নম্বর দেওয়া নেই। ফলে বিনিয়োগকারীরা একেবারেই অন্ধকারে।

আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় কোম্পানির লাভ-ক্ষতির চিত্র জানারও সুযোগ নেই; যা কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ পাওয়া থেকেও রেখেছে দূরে।

শুধু একটি বা দুটি নয়, বছরের পর বছর অনেকগুলো কোম্পানির এমন নিয়ম ভাঙার খেলার মূল্য দিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা; প্রতিকার কী হবে তাও জানা নেই তাদের।

পুঁজিবাজার থেকে শত শত কোটি টাকা তোলা নতুন বা পুরনো কোম্পানির বিনিয়োগকারীদেরকে কোম্পানির আর্থিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে না জানানোর এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে বলে তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে।

এতে দেখা গেছে, ২০টির বেশি কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে না। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ আর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ব্যবস্থা নিয়েছে, এমন উদাহরণ বিরল।

এমন প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় এসব কোম্পানির শেয়ারধারীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং কোম্পানি ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পদক্ষেপের পরামর্শ এসেছে বিশেষজ্ঞ-বাজার বিশ্লেষকদের কাছ থেকে।

দেশের প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জ ডিএসইর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান মজুমদার এমন অনিয়মের বিষয়গুলো নিয়মিত নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অবহিত করার মাধ্যমেই তাদের দায়িত্ব পালনের কথা জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, “কোনো কোম্পানি প্রতিবেদন না দিলেই কমিশনকে (পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি) জানানো হয়। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে কমিশন নেয়।”

আর বিএসইসির মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, “কখনও কখনও কোম্পানির সময় নেওয়া থাকে। যদি সময় নেওয়া না থাকে, যদি শুনানিতে গ্রহণযোগ্য বক্তব্য দিতে না পারে, তখন অনেক সময় শাস্তি হয়। তাদের সতর্ক করা হয়, বা জরিমানা করা হয়। অনেক সময় আদালতে স্থগিতাদেশও থাকে।”

তবে এক প্রান্তিকের প্রতিবেদন দিতে বছরের পর বছর ধরে সময় লাগার কথা নয়। এছাড়া কোম্পানি বন্ধের বিষয়ে বিনিয়োগকারীকে না জানানো কিংবা বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনার তথ্যও রয়েছে।

এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রেজাউল করিম তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জানাতে পারেননি।

হদিস নেই আর্থিক প্রতিবেদনের, গুজবে বাড়ে দাম

তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে প্রতি বছর চারবার আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। কত দিনের মধ্যে তা প্রকাশ করতে হয়, সেটিও আইন দ্বারা সুনির্দিষ্ট। কিন্তু তা অনুসরণের বালাই নেই বললেই চলে।

বিনিয়োগকারীদের অন্ধকারে রাখার সুযোগ নিয়ে প্রায়ই এসব কোম্পানি নিয়ে গুজব ছড়ানো হয়। শেয়ারদর বাড়াতে নানা রকম কৌশলের আশ্রয় নেয় একটি চক্র; তখন লাফিয়ে বাড়ে দাম। সেসময় বেশি দামে শেয়ার কিনে বিপাকে পড়েন ব্যক্তি শ্রেণির বিনিয়োগকারীরা।

এমন ঘটনা ঘটেছে অ্যাপোলো ইস্পাতের শেয়ারদর নিয়েও। ঢেউ টিন উৎপাদনকারী অ্যাপোলো ইস্পাতের মালিক দীন মোহাম্মদ মারা যান ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল। এর আগেই কোম্পানি বিক্রি করার উদ্যোগ নেওয়ার গুঞ্জন ছড়ালে শেয়ারদর বাড়তে থাকে। ওই বছরের এপ্রিলেও শেয়ারদর ছিল ৫ টাকা ১০ পয়সা। ১২ অগাস্ট লেনদেন হয় ১৪ টাকা ৭০ পয়সায়।

তবে শেষ পর্যন্ত কোম্পানি বিক্রি হয়নি, দীন মোহাম্মদের উত্তরাধিকাররাও বিনিয়োগকারীদের অন্ধকার দূর করেননি।

প্রয়াত শিল্প উদ্যোক্তা দীন মোহাম্মদ ও আনসার আলী নামে এক সহউদ্যোক্তা ১৯৯৪ সালে কোম্পানিটি নিয়ে আসেন। কোম্পানির রাণীমার্কা ঢেউটিন বাজারে সেসময় চলেছেও বেশ।

২০১৩ সালে ২২ টাকা দরে শেয়ার বিক্রি করে কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে তোলে ২২০ কোটি টাকা। তালিকাভুক্তির পাঁচ বছরের মাথায় ২০১৮ সাল থেকে ব্যবসা কমতে থাকে। পরের বছরই লোকসান দেয় কোম্পানিটি, এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়।

এখন ৮ টাকা ২০ পয়সায় ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন দরে আটকে আছে শেয়ারদর। এর চেয়ে নিচে নামতে পারছে আবার এ দরে ক্রেতাও নেই।

এমনই সবশেষ ছয়টি আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ না করা আরেক কোম্পানি মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারদর গত কয়েক দিন ধরে বাড়ছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ৩ টাকা ৬২ পয়সা লোকসান দেওয়া কোম্পানিটি পরের অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত লোকসান দেয় শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ২০ পয়সা। এরপর চূড়ান্ত প্রতিবেদন বা পরের ছয়টি প্রান্তিকের প্রতিবেদন আর প্রকাশ হয়নি। এরমধ্যে গত সপ্তাহে শুধু দুই দিনে লোকসানি এ কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে ১৪.৩৪ শতাংশ।

মিরাকলের কোম্পানি সচিব জাহিদুল ইসলামের ফোন নম্বর বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এমনও দেখা গেছে, কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ঘোষণা ছাড়াই। কোম্পানি বিক্রি হয়ে গেছে, বিনিয়োগকারীরা তা জানেন না। কোম্পানির উৎপাদন বন্ধের ঘোষণা আসার পর উদ্যোক্তা পরিচালকরা বড় অঙ্কের শেয়ার কিনেছেন। এরপর শেয়ারদরে অস্বাভাবিক উত্থান হওয়ার পর নোটিসের জবাবে বলা হয়েছে, মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। পরে জানানো হয়েছে, কোম্পানি চালু আছে আগে থেকে।

আইন কী বলে

ডিএসই লিস্টিং রেগুলেশন ২০১৫ এর ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক শেষ হওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে নিরীক্ষিত বা অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। তবে জীবন বীমা কোম্পানির ক্ষেত্রে এটি ৯০ দিন।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিকের ক্ষেত্রে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয় পরের এক মাসের মধ্যে। মিউচুয়াল ফান্ড ছাড়া অন্য কোম্পানির চতুর্থ প্রান্তিক শেষে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয় অর্থবছর শেষ হওয়ার ১২০ দিনের মধ্যে। প্রতিবেদন প্রকাশে বিলম্বের জন্যও প্রতিদিন পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানার বিধান আছে।

‘সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে বিক্রি করে দেওয়া উচিত’

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে বিএসইসির কঠোর অ্যাকশন নেওয়া উচিত।”

এগুলো পুঁজিবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতির কারণ ঘটাচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এসব কোম্পানিকে ডিলিস্ট করে আইনের আওতায় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যায় কি না, সেটি দেখা দরকার। তারপর তা বিক্রি করে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া দরকার।”

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইপিএলের সাবেক গবেষণাপ্রধান দেবব্রত কুমার সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমনকি আদালতের নিষেধাজ্ঞায় বা অন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার কারণে বোর্ড মিটিং করতে না পারলেও সেটি মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে দেওয়া উচিত।”

তালিকাভুক্ত কোম্পানির পাশাপাশি অন্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “একটা কোম্পানি যখন আইপিওতে আসে, তখন বিনিয়োগকারীরা ওই কোম্পানির প্রসপেক্টাস দেখেই বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। প্রসপেক্টাস প্রণয়নে মূল ভূমিকা থাকে ইস্যু ম্যানেজারের। সঙ্গে থাকেন অডিটর এবং অ্যাসেট রি ভেল্যুয়ার কোম্পানি। যারা বাজে ইস্যুর ম্যানেজার, অডিটর ও রিভিউয়ার, প্রত্যেককে আর্থিক জরিমানার আওতায় আনতে হবে।”

ঘোষিত লভ্যাংশ বিতরণ করেনি, প্রান্তিকও জানায় না

বেশির ভাগ কোম্পানিই ২০২২-২৩ অর্থবছরের সালের অর্ধবার্ষিকের প্রতিবেদন প্রকাশ করে ফেলেছে। অথচ ২০২০ সালের পর থেকে কিংবা এরও আগের বছরের আর্থিক হিসাব বিনিয়োগকারীদের জানায়নি অনেক কোম্পানিই।

২০২০ সালের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ৮৯ পয়সা মুনাফার তথ্য জানানোর পর আর কোনো প্রতিবেদন দেয়নি সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ।

এ কোম্পানির বিরুদ্ধে লভ্যাংশ বিতরণের নামে প্রতারণার অভিযোগে মামলাও রয়েছে বিএসইসির। ২০১৯ সালের জন্য ঘোষিত ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ডিভিডেন্ড ওয়ারেন্ট বিতরণের কথা কোম্পানিটি জানালেও বাস্তবে তা পাঠানো হয়নি। দুই বছর পর ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর এ কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি।

ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডও এমন ঘটনা ঘটিয়েছে দুইবার। ২০২০ সালের জন্য ৩ শতাংশ এবং পরের বছরের জুনে সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য ঘোষিত ১ শতাংশ লভ্যাংশ বিতরণ করেনি কোম্পানিটি।

আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে যাওয়া কোম্পানিটি আর্থিক প্রতিবেদনও প্রকাশে অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য শেয়ারপ্রতি ৫ পয়সা লোকসানের তথ্য প্রকাশের পর আর কোনো আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।

বিনিয়োগকারীর অজান্তে কোম্পানি বিক্রি-বন্ধ

দেনার দায়ে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া মিথুন নিটিংয়ের কারখানা দুই বছর পর বিক্রি করে দেয় চট্টগ্রাম রপ্তানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। পত্রিকায় প্রকাশ হলেও বিষয়টি বিনিয়োগকারীদেরকে জানানো হয়নি।

কোম্পানিটি ২০২২ সালের ৩১ মে ২০২১-২২ অর্থবছরের তিন প্রান্তিকের যে হিসাব প্রকাশ করে তাতেও এ তথ্য দেয়নি। শুধু জানানো হয়, কোম্পানি বন্ধের কারণে মুনাফা-লোকসান কিছুই হয়নি।

এরপর গত ৭ ফেব্রুয়ারি চলতি অর্থবছরের দুই প্রান্তিকের হিসাব প্রকাশ করে কোম্পানিটি জানায়, এই ছয় মাসে তাদের কোনো আয় নেই। লোকসানও হয়নি।

এমন ঘটনা ঘটেছে ২০১৭ সালে ৪৩ কোটি টাকা তুলে তালিকাভুক্ত হওয়া নুরানী ডায়িংয়ের ক্ষেত্রেও। ২০২১ সালে কারখানা বন্ধ হলেও কাউকে কিছু জানানো হয়নি। ওই বছরের অগাস্টে ডিএসইর একটি প্রতিনিধিদল কারখানা ও প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করলে তা বন্ধ পায়। এরপর বিএসইসি নতুন বোর্ড গঠন করে দেয়। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি ৯৫ পয়সা লোকসানের তথ্য জানানোর পর পুরো অন্ধকারে বিনিয়োগকারীরা।

২০২০ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি ১৩ পয়সা লোকসানের তথ্য জানানোর পর আর কিছুই জানায়নি ফ্যামিলি টেক্স। কোম্পানির মালিকদের সাড়া না পেয়ে পর্ষদ পুনর্গঠন করে বিএসইসি। কিন্তু ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অসহযোগিতাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে সেই পর্ষদ থেকেও পদত্যাগ করেন সদস্যরা।

প্রান্তিক প্রতিবেদন, লভ্যাংশ সবই আটকে

সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল ২০১৮ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়ার বছরে তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি ৫৪ পয়সা আয়ের তথ্য জানিয়েছিল। এরপর আলিফ গ্রুপের নতুন ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরুর ঘোষণা এসেছে। কিন্তু আর্থিক প্রতিবেদন আর প্রকাশ হয়নি; যে কারণে আসেনি লভ্যাংশের ঘোষণাও। নতুন মালিকানায় আসার পর কোম্পানি সচিবের নম্বরও দেওয়া হয়নি। যে ফোন নম্বর দেওয়া সেটিও বন্ধ।

২০১৮ সালের পর থেকে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি ডেল্টা লাইফ। মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতা আদালতে গড়ালে ২০০৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। ২০১২ সালে একসঙ্গে প্রকাশ করা হয় আট বছরের লভ্যাংশ।

কোম্পানি সচিব উত্তম কুমার সাধু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এর পেছনে অনেক কারণ। সরকার প্রশাসক বসিয়েছে, মামলা হয়েছে, বোর্ডও ভেঙে দিয়েছিল।”

বিনিয়োগকারীদের জন্য মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে এগুলো প্রকাশ করা উচিত কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “নিয়ন্ত্রক সংস্থা আমাদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিল। আমরা দিয়েছি।”

২০২০ সালের পরের দুই বছরে কোম্পানির আর্থিক স্বাস্থ্য তেমন তা জানায়নি আরও কয়েকটি কোম্পানি। বিনিয়োগকারীরা জানেন না এসময়গুলোর চিত্র কী।

>> নর্দার্ন জুট- ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকের শেয়ারপ্রতি ৬ টাকা ২৪ পয়সা লোকসানের তথ্যই সবশেষ।

>> উত্তরা ফাইন্যান্স- ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সমাপ্ত তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ৬৮ পয়সা মুনাফা।

এটির কোম্পানি সচিব মহিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ব্যাংকের নিরীক্ষা দলের আপত্তি ছিল। সেই আপত্তির বিপরীতে কোম্পানির বক্তব্য জমা দেওয়া আছে। সেটি মূল্যায়ন করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বক্তব্য এলে তা প্রকাশ করা হবে।

তিনি বলেন, “২০২০ এবং ২০২১ সালের প্রতিবেদন প্রসেসে আছে। ২০১৯ সালেরটা চূড়ান্ত হয়ে গেছে তিনটা একসঙ্গে দিয়ে দেব।”

এসব বিষয় বিনিয়োগকারীদেরকে কে জানাবে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আসলে এসব বিষয় মূল্য সংবেদনশীল তথ্যের মধ্যে পড়ে না। আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংককে বিষয়টি জানিয়েছি।”

>> কেয়া কসমেটিকস- ২০২০ সালের জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ২৪ পয়সা মুনাফার তথ্য সবশেষ জানায়।

এটির কোম্পানি সচিব নূর হোসেনকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি।

>> ফারইস্ট ফাইন্যান্স- ২০২১ সালের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি ২ টাকা ২৬ পয়সা লোকসান।

কোম্পানি সচিব রমজান হোসেন বলেন, “আমাদের কোম্পানির বোর্ড পুনর্গঠন হয়েছিল। এরপর স্পেশাল অডিট হয়েছে। ২০২০ সালের এজিএম করেছি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। অডিটর পরের বছরের আর্থিক প্রতিবেদন দিয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারিতে। যেই কারণে আমরা ২০২১ সালের বোর্ড মিটিং করতে পারিনি।

“এ নিয়ে হাই কোর্টে রিট আবেদন করা হয়েছে। শুনানি শেষে আদেশ পেয়ে গেলে রোর্ড মিটিং হয়ে যাবে। সেটি হয়ে গেলে পরের প্রতিবেদনও দিয়ে দেব। এরপর থেকে তিন মাস পর পর প্রতিবেদন বিনিয়োগকারীরা পাবে।”

>> ইমামবাটন ২০২০ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি ৫১ পয়সা লোকসান।

কোম্পানি সচিব অরবিন্দ নাগ কোভিডের সময় কারখানা বন্ধ থাকায় পর্ষদ সভা করা যায়নি জানিয়ে বলেন, “এজিএম করতে না পারার কারণে পরের প্রতিবেদন আর দেওয়া হয়নি।”

Also Read: পুঁজিবাজার: ‘মেয়াদ’ ফুরাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের; এরপর কী সেই প্রশ্নে বেকায়দায় বিনিয়োগকারীরা

Also Read: পুঁজিবাজার: লভ্যাংশ ঘোষণায় নিয়ম রক্ষা, বিতরণের বেলায় নিয়ম উধাও

তবে উৎপাদন যে বন্ধ, সে তথ্য বিনিয়োগকারীদেরকে পাঁচ মাস পরে জানিয়েছিল ইমাম বাটন।

চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি ইমাম বাটনের নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেছে বিএসইসি। কিন্তু তাদেরকে কারখানা বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। নতুন পর্ষদ ঢাকা ও চট্টগ্রামে গিয়ে কোম্পানির অফিস খুঁজে পায়নি। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী ৮০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের দায় নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন।

অথচ এই কোম্পানির শেয়ারদর এক বছরের কিছু বেশি সময়ে বেড়েছিল আট গুণ। ২০২১ সালের ৯ মে শেয়ারদর ছিল ২০ টাকার নিচে। গত বছরের জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে উঠে ১৫৬ টাকা ৮০ পয়সায়। এখন তা আবার ৮০ টাকার ঘরে নেমেছে।

আরও যত কোম্পানি

>> লিবরা ইনফিউশন- ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি ৬ টাকা ৪৪ পয়সা লোকসানের তথ্যই সবশেষ।

>> কাট্টালি টেক্সটাইল ২০২১-২২ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ৫ পয়সা মুনাফা

>> এনভয় টেক্সটাইল ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত তৃতীয় প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি ২ টাকা ১২ পয়সা মুনাফা

>> নিউলাইন ক্লথিং- ২০২১-২২ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি এক টাকা ৬০ পয়সা মুনাফা।

>> রিজেন্ট টেক্সটাইল- ২০২১ সালে শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ৬২ পয়সা লোকসান

>> সমতা লেদার ২০২১-২২ অর্থবছরের হিসাব প্রকাশের পর আর কিছুই জানায়নি।

>> সাইফ পাওয়ারটেক ২০২২ সালে ১ টাকা লভ্যাংশ ঘোষণা করে। আগেই দুই প্রান্তিক জানায়নি, আরও এক প্রান্তিক শেষ।

এক সঙ্গে বেশ কিছু প্রতিবেদন, এর আগে দরে উত্থান

২০১৭ সালে মালিকদের ঋণ কেলেঙ্কারিতে বন্ধ হয়ে যাওয়া এমারেল্ড অয়েল চালু হওয়ার পর সম্প্রতি ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের জন্য তিন বছরের আর্থিক প্রতিবেদন একসঙ্গে প্রকাশ করে।

এজন্য ডিএসইতে ঘোষণা আসার আগেই শেয়ারদর বাড়তে থাকে। পরে জানা যায় ২০১৭ সালে শেয়ারপ্রতি ৩৪ টাকা ৪০ পয়সা, পরের বছর শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ৯৭ পয়সা এবং ২০১৯ সালে ১ টাকা ১৪ পয়সা লোকসান দিয়েছে কোম্পানিটি। এরপর শেয়ারদর আবার কমে যায়।

এখনও ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালের দুই প্রান্তিকের প্রতিবেদনের কী অবস্থা তা জানানো হয়নি।

একইভাবে সম্প্রতি ইনটেক অনলাইনের শেয়ারদরে উত্থানের ঘটনা ঘটে। কোম্পানিটি ২০২২ সালের জুন সমাপ্ত বছরের তিন প্রান্তিকের প্রতিবেদন একসঙ্গে প্রকাশ করে গত ২৯ মার্চ। এটিকে কেন্দ্র করে কোম্পানিটির শেয়ারদর বাড়তে থাকে। পরে জানা যায় তিন প্রান্তিকেই লোকসান হয়েছে। আর ২০২২ সালের চূড়ান্ত প্রতিবেদন কবে প্রকাশ হবে সে খবর এখনও নেই।

এর আগে একইরকম ঘটে বিআইএফসির শেয়ারদরে। ২০২২ সালের ১৫ জুন কোম্পানিটি ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবে যাওয়া কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ওই বছর লোকসান দেয় ১২ টাকা ২০ পয়সা।

এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর শেয়ারদরে দেয় লাফ। ১৪ জুন ৬ টাকা ২০ পয়সা থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে উঠে যায় ১৩ টাকা ৬০ পয়সায়।

এরপর ওই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর একসঙ্গে ২০২০ সালের তিন প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আর্থিক খাতের কোম্পানিটি। এর আগ পর্যন্ত বাড়তি দর ধরে রাখে। তবে সেই প্রতিবেদনে জানানো হয়, ওই বছরের নয় মাসে শেয়ার প্রতি লোকসান ছিল ৬ টাকা ৩৭ পয়সা।

তবে ওই বছরে শেষ পর্যন্ত লোকসান কত হল, ২০২১ সালের কী চিত্র, ২০২২ সালে কী হয়েছে, তা নিয়ে অন্ধকারেই বিনিয়োগকারীরা।