ব্যবসা হারিয়েছেন জাহাঙ্গীর, আজমতের আয় এখন বেশি

গাজীপুরে আজমতের তুলনায় জাহাঙ্গীরকে বেশি সম্পদশালী হিসেবে ধরা হয়। তবে ভোটে অংশ নিতে জমা দেওয়া হলফনামায় সেই ধারণার বিপরীত তথ্য মিলল।

গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 April 2023, 07:49 PM
Updated : 28 April 2023, 07:49 PM

আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বরখাস্ত মেয়র ও এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া জাহাঙ্গীর আলমের আয় তলানিতে নেমেছে। ব্যবসা হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। পাঁচ বছর আগের চেয়ে কমে গেছে হাতে নগদ টাকা।

আর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া আজমত উল্লা খান বরাবর আয় ও সম্পদের দিক দিয়ে জাহাঙ্গীরের পিছিয়ে আছেন বলে সাধারণের ধারণা থাকলেও এবার তিনি জাহাঙ্গীরের তুলনায় বছরে তিন গুণেরও বেশি আয় দেখিয়েছেন।

তবে স্থাবর সম্পদ অর্থাৎ জমি ও দালান কোঠার দিক দিয়ে জাহাঙ্গীর এখনও অনেকটাই এগিয়ে।

আজমতের নিজের গাড়ি নেই, নির্মাণাধীন একটি বাড়ি আছে। অপরদিকে জাহাঙ্গীরের দুটি গাড়ি ও দুটি বাড়ি। হাতে নগদ টাকা আজমতের বেশি।

আগামী ২৫ মে এর ভোটে অংশ নিতে বৃহস্পতিবার তারা যে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, সেটির সঙ্গে আয় ও সম্পদের ঘোষণাসহ যে হলফনামা জমা দিয়েছেন- তাতে সম্পদের এসব তথ্য উল্লেখ আছে।

২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিপুল ভোটে জিতে মেয়র হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। তবে এবার দলীয় মনোনয়ন জোটেনি। তার বদলে নৌকার প্রার্থী হওয়ার মনোনয়ন পেয়েছেন আজমত।

ঘরোয়া আলোচনায় বঙ্গবন্ধু ও একাত্তরে শহীদের সংখ্যা নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ উঠার পর ২০২১ সালের নভেম্বরে জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কার করেছিল আওয়ামী লীগ। ক্ষমা চাওয়ায় দলের শৃঙ্খলা মেনে চলার শর্তে গত জানুয়ারিতে ওই আদেশ প্রত্যাহার হয়।

Also Read: জাহাঙ্গীর সরে দাঁড়াবেন, বিশ্বাস আজমতের

Also Read: এবার জাহাঙ্গীরের প্রতি কঠোর হবে আওয়ামী লীগ?

তবে চার মাস যেতে না যেতেই জাহাঙ্গীর দলের প্রার্থী আজমতের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়িয়েছেন; মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তার মায়ের নামেও।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, আইনানুযায়ী হলফনামা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। শনিবার তা সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে।

জাহাঙ্গীরের অকৃষি জমির লাফ, কমেছে টাকা

২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনের আগে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় হলফনামায় জাহাঙ্গীর মোট জমি দেখিয়েছিলেন ১ হাজার ৪১৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর মধ্যে অকৃষি জমি ছিল ৩৩ দশমিক ৭১২৫ শতাংশ। বাকি সব ছিল কৃষি জমি।

এবারের হলফনামায় মোট জমির কথা উল্লেখ নেই। শুধু অকৃষি জমির কথা বলা আছে। সেটি দাঁড়িয়েছে ৮১৫ দশমিক ২১ শতাংশ। দালান বা আবাসিক সম্পদ আগে ছিল ৭ দশমিক ৪৩৭ শতাংশ। এবার তা দেখানো হয়েছে ৪১ দশমিক ১৫ শতাংশ।

গাজীপুর মহানগর হওয়ার পর জমির শ্রেণি পরিবর্তন হয়েছে অনেক জায়গায়। এ কারণে অনেক জায়গায় কৃষি জমি অকৃষি জমিতে ঢুকেছে।

জাহাঙ্গীরের অকৃষি জমি বাড়ার কারণ এটি কি না, সে বিষয়ে তার বক্তব্য জানা যায়নি। একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরনেনি।

এবারের হলফনামায় জাহাঙ্গীর হাতে নগদ টাকা দেখিয়েছেন ৪০ লাখ। পাঁচ বছর আগে তা ছিল ৭ কোটি ৪৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। তিনি ব্যাংকে জমা দেখিয়েছেনে ৫০ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে তা ছিল এক লাখ ৫৫ হাজার ৯৭১ টাকা।

Also Read: জুমার নামাজে গিয়ে ভোট ও দোয়া চাইলেন আজমত-জাহাঙ্গীর

Also Read: মনোনয়নপত্র জমায় ‘নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন’ আজমত উল্লার

Also Read: গাজীপুরের জাহাঙ্গীরের বহিষ্কারাদেশ তুলে নিল আওয়ামী লীগ

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, এমন দুটি কোম্পানির শেয়ারেও বিনিয়োগ দেখিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে অনারেবল টেক্সটাইলে ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং জেড আলম এপারেলসে ২০ লাখ টাকার শেয়ার আছে তার।

২০১৮ সালে জাহাঙ্গীর ব্যবসায় বিনিয়োগ দেখিয়েছিলেন ৭৫ লাখ ২৩ হাজার ৭৮৭ টাকা, অর্থাৎ এবারের বিনিয়োগের তুলনায় লাখ দশেক বেশি ছিল তার।

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ২০১৮ সালের মতো এবারও দেখানো হয়েছে ১০ লাখ টাকা।

তার দুটি গাড়ি, ৩৫ ভরি সোনা, একটি বন্দুক ও একটি পিস্তল, ইলেকট্রনিক সামগ্রী এবং আসবাবপত্র পাঁচ বছর আগের মতো একই পরিমাণে রয়ে গেছে।

ব্যবসার আয় তলানিতে, ‍কৃষিতে বেড়েছে জাহাঙ্গীরের

হলফনামার তথ্য অনুযায়ী পাঁচ বছর আগে কৃষিখাত থেকে জাহাঙ্গীরের বার্ষিক আয় ছিল দেড় লাখ টাকা। সেটি এখন বেড়ে হয়েছে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা। বাড়ি ও দোকান ভাড়া আগেও ছিল চার লাখ ৩০ হাজার টাকা, এবারও তাই দেখিয়েছেন তিনি।

তবে কৃষিতে বাড়লেও সামগ্রিকভাবে আয় কমে গেছে জাহাঙ্গীরের। পাঁচ বছর আগে ব্যবসা থেকে তিনি আয় দেখিয়েছিলেন ৯৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। এবার দেখিয়েছেন মাত্র তিন লাখ।

আয় কেন কমল, হলফনামায় সেই ব্যাখ্যা দিতে হয় না। আর ফোন না ধরায় জাহাঙ্গীরের বক্তব্যও জানা যায়নি।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বিতর্কিত বক্তব্যের জেরে আওয়ামী লীগ জাহাঙ্গীরকে দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করে। মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

সোয়া এক বছর পর দলীয় শৃঙ্খলা মেনে চলার শর্তে তাকে ক্ষমা করে দলে ফেরানো হয়। তবে মেয়র পদ তিনি আর ফিরে পাননি।

জাহাঙ্গীর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকার সময় গাজীপুরে পোশাক কারখানায় ঝুটের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই তার ও তার অনুসারীদের হাতে ছিল। বহিষ্কার হওয়ার পর সেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন তিনি।

সব মিলিয়ে এবার তিনি বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। পাঁচ বছর আগে এটি ছিল দুই কোটি ১৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা।

পাঁচ বছর আগে তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা না থাকলেও মেয়র পদ থেকে বরখাস্তের পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে আটটি।

আজমতের আয় বেশি, সম্পদ ও নগদ ’কম‘

গাজীপুরে বেশির ভাগের সাধারণ আলোচনায় আজমত উল্লা খানের তুলনায় জাহাঙ্গীর আলমকে বেশি সম্পদশালী হিসেবে ধরা হয়। আয়ের দিক দিয়েও ২০১৮ সালের বিজয়ী মেয়র এগিয়ে, এটি ছিল সাধারণ ধারণা।

তবে নির্বাচনের জন্য জমা দেওয়া হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণে সেই ধারণার বিপরীত তথ্য পাওয়া গেল।

আজমত বেশ কিছু উৎস থেকে তার যে আয় দেখিয়েছেন তা জাহাঙ্গীরের কমে যাওয়া আয়ের কয়েকগুণ।

আইন পেশা থেকে আওয়ামী লীগ নেতা আজমত বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ৬ লাখ টাকা। সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকে আমানতের মুনাফা থেকে আসে আরও ৬২ হাজার ৫০৫ টাকা। কৃষি ও তৈরি পোশাকসহ তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে বছরে সম্মানি ভাতা আসে ২৪ লাখ ৩ হাজার টাকা।

তার লেখা দুটি বই ২০২১ সালে প্রকাশিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, রাজনীতির মহাকবি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ এবং ২০২২ সালে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বগুণ, আর্দশ ব্যক্তি ও জাতি গঠনে অনুস্মরণীয় দৃষ্টান্ত’ থেকে বছরে এক লাখ টাকা আসে বলেও জানিয়েছেন আজমত।

অর্থাৎ সব মিলিয়ে বছরে আয় হয় ৩১ লাখ ৬৫ হাজার ৫০৫ টাকা, যা জাহাঙ্গীরের দেখানো আয়ের তিন গুণেরও বেশি।

তবে আজমত হাতে থাকা নগদ টাকা দেখিয়েছেন চার লাখ ৩১ হাজার ৭৩৬, যা জাহাঙ্গীরের হাতে থাকা নগদের ১০ ভাগের এক ভাগের মতো। আওয়ামী লীগের প্রার্থী স্ত্রীর হাতে নগদ দেখিয়েছেন দুই লাখ ৩৪ হাজার ৫০৬ টাকা।

আজমতের নিজের কোনো গাড়ি নেই। তার স্ত্রীর একটি প্রাডো গাড়ি রয়েছে। স্বামী ও স্ত্রীর কাছে মোট সোনা আছে ৫০ তোলার। এর মধ্যে নিজের ২০ তোলা এবং স্ত্রীর ৩০ তোলা।

স্থাবর সম্পদের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আজমত। তার কোনো কৃষি জমি নেই। অকৃষি জমি আছে ১৪০ দশমিক ৬৩৭৯ শতাংশ, যা জাহাঙ্গীরের ছয় ভাগের এক ভাগের মতো।

Also Read: গাজীপুরে মায়ের জন্যও মনোনয়ন ফরম তুললেন জাহাঙ্গীর

Also Read: মেয়র পদ থেকে জাহাঙ্গীর সাময়িক বরখাস্ত: মন্ত্রী

৭ শতাংশ জমির ওপর তার নির্মাণাধীন বাড়ি রয়েছে আজমতের, যা জাহাঙ্গীরের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ।

আওয়ামী লীগের এ নেতার স্ত্রীর নামেও রয়েছে ২৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ জমি।

জাহাঙ্গীরের নামে আটটি মামলা থাকলেও আজমতের নামে নেই একটিও। তবে বিরোধী দলে থাকার সময় তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা ছিল। এর মধ্যে একটি মামলায় অভিযোগপত্রেই তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বাকি দুটি মামলা আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর প্রত্যাহার করে নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

হত্যা মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে আজমত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০০৫ সালে আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যার পর টঙ্গীতে এক ছাত্রদল নেতা খুন হয়। তখন বিএনপির লোকেরা আমাকে হুকুমের আসামি করেছিল।

“অথচ সেই ছাত্রদল নেতার বাবা-মা থানায় গিয়ে আরেকটা এজাহার করে তাদের সন্তানকে কারা খুন করেছে, তা বলেছেন। কিন্তু একটি ঘটনায় দুটি এফআইআর হয় না বলে পুলিশ তা নেয়নি। তবে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ই তারা আদালতে গিয়ে হলফনামা দিয়ে বলেছেন, তাদের ছেলেকে হত্যার হুমকি ছিল আগেই। কারা কারা খুন করেছে, তাও বলেছেন।

“পরে পুলিশ তদন্ত করে বাবা-মায়ের বক্তব্যের প্রমাণ পেয়ে সত্যি সত্যি তাদের গ্রেপ্তার করে। তারা আদালতে গিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে অপরাধ স্বীকার করে। এরপর অভিযোগপত্র থেকে আমার নাম বাদ দেওয়া হয়।”

বাকি দুটি মামলা ছিল আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যার পর টঙ্গীতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায়। এ দুটি মামলাই প্রত্যাহার করে আওয়ামী লীগ সরকার।

আজমত বলেন, “আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যার পর টঙ্গীতে মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। কিন্তু আমি তো তখন সেখানে ছিলামই না। আমি তো আহসান উল্লাহকে নিয়ে ছিলাম সিএমএইচে।

“অথচ ঢাকায় জিআরপি থানায় আমাকে এবং আরও অনেককে আসামি করে মামলা দিয়েছিল। আরও অভিযোগ ছিল, টঙ্গীতে মানুষ উত্তেজিত হয়ে হামলা করেছিল।

“এগুলো রাজনৈতিক শত্রুতাবশত মামলা ছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদন্ত করে সেগুলো প্রত্যাহার করে নিয়েছে।”

Also Read: গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার

Also Read: জাহাঙ্গীরেই নৌকা ভিড়ল নগরভবনে