শুক্রবার সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে উপস্থিত সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে তার প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়েছে।”
সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মেয়র জাহাঙ্গীরের একটি মন্তব্যের অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে তোলপাড় শুরু হয়। ওই অডিওতে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে মন্তব্য করতে শোনা যায় তাকে।
দল থেকে তাকে জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কারের দাবিতে গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয় সে সময়।
এই প্রেক্ষাপটে দলীয় ‘স্বার্থ পরিপন্থি কর্মকাণ্ড ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের’ অভিযোগে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে গত ৩ অক্টেবর জাহাঙ্গীরকে নোটিস দেয় আওয়ামী লীগ।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জাহাঙ্গীর সে সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “একটি মহল আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে একটি এডিটেড ভিডিও বের করেছে, যা সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে, এমনকি কিছু গণমাধ্যমও প্রকাশ করেছে।”
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাক্ষরিত ওই নোটিসে ১৫ দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছিল জাহাঙ্গীরকে। নির্ধারিত সময়ের আগেই তিনি জবাব দিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমাও চেয়েছিলেন।
তবে দল যে তাকে বহিষ্কার করতে যাচ্ছে, বৃহস্পতিবার ওবায়দুল কাদেরের কথাতেই তার আভাস মিলেছিল।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, শুক্রবারের কার্যনির্বাহী সভায় জাহাঙ্গীরের বিষয়ে ‘সিদ্ধান্ত আসতে পারে’।
শুক্রবার রাতে কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর সাংবাদিকদের সামনে আসেন কাদের।
তিনি বলেন, “আত্মপক্ষ সমর্থনে জাহাঙ্গীর আলম তার বক্তব্য দিয়েছিল। সেটা আমি আজকের মিটিংয়ে পড়ে শুনিয়েছি। এরপর গোটা হাউস কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে মতামত দিয়েছে। এবং এ ব্যাপারে আমাদের সভাপতি সবার মতামত নিয়েছেন। সবাই এক বাক্যে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায়।”
জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, “তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। যেহেতু তার বক্তব্য বঙ্গবন্ধু ও আমাদের ইতিহাসকে কটাক্ষ করে। কাজেই এটা প্রশাসনিকভাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে আজকের দলীয় সিদ্ধান্ত অফিসিয়ালি জানানো হবে।”
দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে কথা বলতে মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
মেয়র জাহাঙ্গীর আলম
এলএলবি পাস করলেও ব্যবসায়ী হিসেবেই নিজেকে তৈরি করেন জাহাঙ্গীর, সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। গাজীপুর উপজেলা পরিষদে ভাইস চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন।
এরপর মেয়র হওয়ার সাধ জাগে তার। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনের আগে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে মেয়র পদের প্রার্থী হয়ে যান।
কিন্তু ওই নির্বাচনে জাহাঙ্গীরের বদলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করেছিল টঙ্গী পৌরসভার মেয়র আজমত উল্লাহ খানকে। আর জাহাঙ্গীরকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতে হয়। অবশ্য তারপর নবগঠিত গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পান তিনি।
শেষ পর্যন্ত ওই নির্বাচনে আজমত উল্লাহ হেরে যান বিএনপি নেতা এম এ মান্নানের কাছে। পাঁচ বছর পর প্রবীণ আজমত উল্লাহকে বাদ দিয়ে নবীন জাহাঙ্গীরের হাতেই নৌকার বৈঠা তুলে দেয় আওয়ামী লীগ। বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকারকে হারিয়ে ২০১৮ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়রের চেয়ারে বসেন ৩৫ বছর বয়সী জাহাঙ্গীর।
সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। এর জবাবে তিনি বলেছিলেন, “মানুষ মরে গেলে আইন দিয়ে কী করব! … কিন্তু আমার এখানে ৪০ লাখ মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছে। যে কোনোভাবে হোক আগে তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করা আমার দায়িত্ব। মানবিক কারণে আমি আনছি, বাঁইচা থাকলে তখন আইন আদালত।”
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে গতবছর এপ্রিলে দেশের সব মসজিদে বাইরে থেকে মুসল্লি ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সরকার। সরকারের ওই নিষেধাজ্ঞা ওঠার আগেই এপ্রিলের শেষে মসজিদ খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন মেয়র জাহাঙ্গীর আলম।
তার ওই ঘোষণায় সে সময় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন স্থানীয় প্রশাসন ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। একজন জনপ্রতিনিধির এ ধরনের ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’ পদক্ষেপের সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন অনেকেই।
শেষ পর্যন্ত ওই ঘোষণা থেকে সরে এসে মেয়র জাহাঙ্গীর বলেছিলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সবাই যেন তা মেনে চলে।