আহমদিয়াদের অভিযোগ, তাণ্ডব চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নেয়নি; তিন ঘণ্টা পর যখন অ্যাকশন শুরু করে ততক্ষণে সব শেষ।
Published : 08 Mar 2023, 09:46 PM
সালানা জলসা ঘিরে পঞ্চগড়ে আহমদিয়াদের বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে জড়িতরা রেলমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় তার সঙ্গে ছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ।
পঞ্চগড় সদরের আহমদনগর ও বোদা উপজেলার শালশিরি গ্রামে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত আহমদিয়াদের বাড়িঘর পরিদর্শনকালে বুধবার তিনি এ কথা বলেন।
বিএনপির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বদানকারী হাফিজ উদ্দিন এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
পঞ্চগড়ের আহমদনগর এলাকায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার মানুষের বসবাস। সেখানে প্রতিবছরই সালানা জলসা হয়ে থাকে।
এই জলসা বন্ধের দাবিতে গত শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কয়েকশ লোক পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। ট্রাফিক পুলিশের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ, দোকানপাট ভাঙচুর ছাড়াও আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। সংঘর্ষে নিহত হন দুজন।
এই ঘটনায় মোট ১৩টি মামলায় প্রায় ১১ হাজার আসামি হয়েছে; ১৩৬ জনকে যৌথবাহিনী গ্রেপ্তার করেছে।
বুধবার বিকালে জেলা বিএনপি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ১৭৯টি বাড়িতে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, শতাধিক আহত হয়েছে।
“কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে জনমনে তার স্পষ্ট ধারণা আছে। কয়েকদিন আগে রেলপথমন্ত্রী যখন এখানে আসেন তখন ক্ষতিগ্রস্তরা ধ্বংসাত্মক কাজে যারা লিপ্ত ছিল তারা মন্ত্রীর আশপাশে ছিলেন। তারা তাদের নামও বলেছে। আমরা আশা করেছিলাম প্রশাসন তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করবে; কিন্তু তা হয়নি।”
সরকারের অনুমতি নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা বার্ষিক সালানা জলসার আয়োজন করেছিল উল্লেখ করে হাফিজ বলেন, যখন আক্রমণ করা হয়, বাড়িঘর পোড়ানো হয়, তখন বারবার ফোন করলেও প্রশাসন এগিয়ে আসেনি। বরং পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের দৃশ্য অবলোকন করছে।”
‘তিন ঘণ্টা পর’ ডিসি এসপি এসে দুষ্কৃতকারীদের খানিকটা প্রতিরোধ করেন; এর আগে ‘ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি’ হয়ে গেছে বলে অভিযোগ হাফিজের।
“এইসব আলামত দেখে আমাদের মনে হয়েছে এর মূল কারণ দেশে গণতন্ত্র নাই, আইনের শাসন নাই, গণমানুষের কোনো অধিকার নাই। মানবতা প্রতদিনই লুণ্ঠিত হচ্ছে।”
সারাবিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ মানবতাবিরোধী, মানবাধিকারবিরোধী একটি রাষ্ট্রযন্ত্ররূপে স্বীকৃতি পেয়েছে বলে তার ভাষ্য।
হাফিজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনসহ সবাই একবাক্যে বলেছে, বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের অধিকার নেই।
তিনি আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, প্রকৃতপক্ষে সরকার জনগণের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চলমান আন্দোলন থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য এই ভয়ানক হীন সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি করেছে।
আহমদিয়াদের ওপর হামলাসহ পরবর্তী সহিংসতার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেছে বক্তব্য দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
সোমবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভা শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় দল দুটিকে দায়ী করে তিনি এ বক্তব্য দেন।
পঞ্চগড়ে সহিংসতায় জামায়াত-বিএনপি জড়িত: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
হাফিজ বলেন, “অবৈধ সরকার এই জঘন্য ন্যক্কারজনক সংঘাত ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে বিরোধী দল বিএনপির ওপর দোষারোপ করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়।”
এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত শতাধিক বিএনপি সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে এবং বাসায় তল্লাশির নামে নেতাকর্মীদের মাঝে আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
“এরা সবাই নিরপরাধ, কোনোভাবেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। সিসিটিভি এবং ঘটনার ভিডিও দেখলে তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। অথচ রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করে আমাদের নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে।”
হাফিজের ভাষ্য, রেলমন্ত্রী সুজন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাকে স্পষ্ট জানান যে আক্রমণকারীরা তার সঙ্গেই রয়েছে।
“এজন্য আমরা মনে করি, এই ঘটনা প্রমাণ করে যে সরকারের হীন পরিকল্পনা অনুয়ায়ী আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের দ্বারা এই সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। এই সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর একের পর এক হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটতারাজের ঘটনা ঘটছে; যা এই অবৈধ সরকারের ক্ষমতায় অবৈধভাবে টিকে থাকার নীল নকশার অংশ।”
এ জন্যই এ নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না এবং তারা আহমদিয়া সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আরও কঠোর ব্যবস্থা নিলে হয়তো এমন ঘটনা ঘটত না।
তিনি বলেন, গত কয়েক দিনে পঞ্চগড়ে ১৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। হাজার হাজার সাধারণ লোককে আসামি করে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে এবং অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের – এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, পঞ্চগড়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার দায়-দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়। রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ এর দায়-দায়িত্ব কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।
“গণমাধ্যমে এসেছে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেছেন যে যারা তাদের বাড়িঘরে হামলা-অগ্নিসংযোগ করেছে তারা রেলপথ মন্ত্রীর আশেপাশেই আছেন। এখন তারা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন এবং ষড়যন্ত্রমূলকভাবে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছেন।”
তিনি এ বিষয়ে বিচারবিভাগীয় নিরপেক্ষ তদন্ত ও গ্রেপ্তারকৃত নিরপরাধ ব্যক্তিদের মুক্তি এবং পঞ্চগড়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার দাবি জানান।
তার সঙ্গে দলের সহসভাপতি জয়নাল আবেদীন, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ইসমাঈল জবিউল্লাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, জেলা বিএনপির সদস্যসচিব ফরহাদ হোসেন আজাদ, যুগ্ম আহবায়ক আদম সুফি উপস্থিত ছিলেন।
আহমদিয়া সম্প্রদায়ের গণসংযোগ ও প্রেস বিভাগের প্রধান আহমদ তবশির চৌধুরি বলেন, “আমরা কারো সাহায্য সহযোগিতা চাই না। আমরা শুধু নিরাপদে বসবাস করতে চাই। নিজেদের জানমালের নিরাপত্তা চাই। নাম উল্লেখসহ ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করেছে। পুলিশও মামলা করেছে। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।”
আহমদিয়া সম্প্রদায় অধ্যুষিত দুটি গ্রামে ও পঞ্চগড় শহরের আহমদিয়াদের দুই শতাধিক বাড়িঘর, দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছে; ৭০ জন আহত হয়েছে এবং একজনকে কুপিয়ে মেরেছে বলে তার দাবি।
তিনি অভিযোগ করেন, “দুষ্কুতকারীরা দীর্ঘ তিন ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালায়। কিন্তু বিজিবি ও পুলিশ কোনো অ্যাকশনে যায়নি; যা আমাদের বিস্মিত ও হতবাক করেছে। তিন ঘণ্টা পর অ্যাকশন শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী; ততক্ষণে সব শেষ।”
এলাকার চিহ্নিতদের নাম পুলিশকে জানানো হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “ঘটনাটিকে কেউ কেউ রাজনীতির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, যা মোটেও কাম্য নয়।”
আরও পড়ুন: