উত্তেজনাকর পরিস্থিতির পর রাতে প্রশাসনের অনুরোধে জলসা বন্ধ রাখতে সম্মত হয়েছেন আয়োজকরা, জানিয়েছেন পুলিশ সুপার।
Published : 03 Mar 2023, 09:13 PM
পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসা ঘিরে দিনভর সংঘর্ষ ও আগুনের ঘটনার পর রাতে উত্তেজনা কমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে; শহরজুড়ে থমথমে অবস্থার মধ্যে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টহল জোরদার করেছে।
শুক্রবার জুমার নামাজের পর উত্তরের জেলা শহরটির চৌরঙ্গী মোড় থেকে ছড়িয়ে পড়া দফায় দফায় সংঘর্ষের পর অশান্ত পরিস্থিতি রাত আটটার পর থেকে স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
ওই সময়ের পর থেকে শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে বিজিবি ও পুলিশ জোরালো অবস্থান নিলে বিক্ষোভকারীরা সড়ক থেকে সরে যেতে থাকে।
আরও সংঘর্ষের আশঙ্কায় ও আতঙ্কে শহরের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়; সন্ধ্যার পর থেকে লোক চলাচলও কমে যায়। রাত বাড়তে থাকলে শহরজুড়ে থমথমে অবস্থা দেখা দেয়।
এদিকে দিনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির পর রাতে জেলা প্রশাসনের অনুরোধে আহমদিয়া সম্প্রদায় তিন দিনের জলসা বন্ধ রাখতে সম্মত হয়েছেন বলে জানান জেলা পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা।
আয়োজকদের সম্মতি পাওয়ার পর শুক্রবার শুরু হওয়া এ জলসা বন্ধ রাখার কথা জানিয়ে রাতে শহরে মাইকিংও করে জেলা প্রশাসন।
এর আগে এদিন জুমার নামাজের পর একদল লোক মিছিল নিয়ে জেলা শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে এলে এ সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় বলে জানিয়েছিলেন সদর থানার ওসি আব্দুল লতিফ মিয়া।
সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে বের করা মিছিলের বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশেরও সংঘর্ষ বাধে।
থেমে থেমে তা ছড়িয়ে গেলে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পঞ্চগড় শহর; সংঘর্ষের মধ্যে ট্রাফিক পুলিশের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ, দোকানপাট ভাঙচুর ছাড়াও আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়।
পাশাপাশি বিভিন্ন রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে আগুন দেয় বিক্ষোভকারীরা। এরমধ্যেই প্রাণহানির খবরও জানাজানি হয়।
এরপর রাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শহরে বিজিবি মোতায়েন করা হয় বলে বাহিনীর জনসংযোগ বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
রাতে বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, “পঞ্চগড়ে আহমদিয়া মুসলিম জামাতের সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভের ঘটনায় সংঘর্ষ; উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৭ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন“ করা হয়েছে।
শুক্রবার থেকে রোববার পর্যন্ত তিন দিন শহরের উপকণ্ঠে আহমদনগরে এ জলসার আয়োজন করেছিল আহমদিয়া সম্প্রদায়।
জলসা শুরুর আগেই সংঘর্ষ ও আগুন দেওয়ার ঘটনায় দুজনের প্রাণহানির খবরও এসেছে। পুলিশ সুপারও তাদের নিহত হওয়ার কথা জেনেছেন বলে সাংবাদিকদের জানান। সংঘর্ষে পুলিশসহ আহত হয়েছেন অনেকে।
রাতে সবকিছু 'শান্ত' রয়েছে জানিয়ে পুলিশ সুপার সিরাজুল বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিভিন্ন স্থানে টহল জোরদার করা হয়েছে।
দফায় দফায় সংঘর্ষের মধ্যে প্রথমে এককজনের মারা যাওয়ার কথা জানালেও গভীর রাতে আরেকজনের মৃত্যুর কথা জানান পুলিশ সুপার।
দ্বিতীয় ব্যক্তির মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, পিটিয়ে তার মুখমণ্ডল বিকৃত করে দেওয়ায় তাকে শনাক্ত করা যায়নি। পরে নানাভাবে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে।
জাহিদ হাসানকে (৪০) নামের এই ব্যক্তি নাটোরের বনপাড়া থেকে সালানা জলসায় যোগ দিতে আসা আহমদীয়া সম্প্রদায়ের বলে শুনেছেন বলে জানান পুলিশ সুপার।
তিনি জানান, জাহিদ সম্ভবত আহমদনগরেই অবস্থান করছিলেন।
এর আগে পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “একজনের মারা যাওয়ার খবর আমরা পেয়েছি। তবে কী কারণে মারা গেল তা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।
“ময়নাতদন্তের পরই মারা যাওয়ার কারণ বলা যাবে। শহরের পরিস্থতি পর্যবেক্ষণে রয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ, বিজিব ও র্যাব সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে।”
প্রথমে নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়া ওই ব্যক্তির নাম আরিফুর রহমান (২৭) বলে জানা গেছে। মাথায় আঘাত পেয়ে মারাত্মক জখম হলে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
তবে রাত ১১টার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মৃত্যুর খবরটি এখনও 'নিশ্চিত নয়' বলে জানান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "আমরা উড়াউড়া খবর শুনছি।"
এর আগে সন্ধ্যায় পঞ্চগড়ের সদর থানার ওসি লতিফ আহমদনগরে কয়েকটি বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার কথা জানান। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জলসা বন্ধের দাবিতে বৃহস্পতিবার দুপুর ও রাতে কয়েকটি সংগঠন জেলা শহরে বিক্ষোভ করে। এ সময় তারা সড়ক অবরোধ করলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে সাধারণ মানুষ ভোগান্তির মধ্যে পড়েন।
এর ধারাবাহিকতায় জুমার নামাজ শেষে আহমদিয়াদের তিন দিনের বার্ষিক সালানা জলসা বন্ধসহ তদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে শহরের বিভিন্ন মসজিদ থেকে খণ্ড খণ্ড বিক্ষোভ মিছিল বের হয়।
মিছিলগুলো শহরের তেঁতুলিয়া সড়কের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে থেকে বড় পরিসরে চৌরঙ্গী মোড়ের দিকে আসে।
পঞ্চগড়ে আহমদিয়া জলসা বন্ধে মিছিল থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, বাড়িতে আগুন
এই মিছিলকে কেন্দ্র করে আগে থেকেই পুলিশের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে পুলিশ মিছিলের আশপাশে ছিল।
কিন্তু আকষ্মিকভাবে মিছিল থেকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। এ নিয়ে পুলিশ ও মিছিলকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে বলে জানান ওসি লতিফ মিয়া।
এতে তিন পুলিশ সদস্যসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন জানিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, “মিছিলকারীরা শহরের ধাক্কামারা এলাকায় গিয়ে ট্রাফিক পুলিশের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করলে সেটি ভস্মীভূত হয়ে যায়।”
“বিক্ষোভকারীদের হামলায় পুলিশ ও বিজিবির গাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কয়েকটি কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করেছে।”
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় পঞ্চগড় বাজার এলাকায় একটি মার্কেটে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের কয়েকটি দোকান ভাঙচুর করা হয়। পরে সেসব দোকান থেকে মালপত্র বের করে রাস্তায় পুড়িয়ে দেয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সুপারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান।
এদিকে দিনভর সংঘর্ষের ঘটনায় কতজন আহত হয়েছেন তার সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসএ টিভির পঞ্চগড় প্রতিনিধি কামরুজ্জামান টুটুল, করতোয়ার সাংবাদিক সামসউদ্দিন চৌধুরী কালামসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন।
বিকালের দিকে শহরের উপকণ্ঠ আহমদিয়া নগরে কয়েকটি বাড়িঘরে আগুন দেয় বিক্ষোভকারীরা।
স্থানীয় সংবাদকর্মী আব্দুল রহিম বলেন, এলাকাটিতে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অনেকেই বসবাস করেন। সেখানকার ১০টির অধিক বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
রহিম আরও বলেন, এলাকা থেকে অনেকেই পরিবার নিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। পুলিশ সেখানে টহল দিচ্ছে। থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আহমদিয়া সম্প্রদায় তাদের সালানা জলসা বন্ধ ঘোষণা করেছে বলে আয়োজক কমিটির গণমাধ্যম শাখার আহ্বায়ক মাহমুদ আহমেদ সুমন জানান।