এ ঘটনায় ১২ জনকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে বলেও জানান ওসি।
Published : 04 Mar 2023, 08:32 PM
পরিবারের সদস্যরা কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই মিছিলকারীরা বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায় বলে অভিযোগ করেছেন পঞ্চগড়ের আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ক্ষতিগ্রস্ত এক ব্যক্তি।
সদর উপজেলার ব্যাংহাড়ি ইউনিয়নের শালশিড়িতে আহমদিয়া অধ্যুষিত এলাকার বাসিন্দা আলতাফ হোসেন শনিবার বিকালে বলেন, “কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমরা আক্রমণের শিকার হই। এ কারণে বর্তমানে নিঃস্ব হয়ে পড়েছি।
“বাড়ির ধান-চাল, কাপড় ও অলঙ্কার সবকিছু তারা লুটে নিয়েছে। তবে আমরা কোনোভাবে পালিয়ে জীবন রক্ষা করতে পেরেছি।”
একই এলাকার আরেক ভুক্তভোগী ক্ষতিগ্রস্ত মাহমুদ আহমেদ সুমন জানান, তার বাড়ির নয়টি ঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “এখন গায়ের কাপড় ছাড়া পরার মত বাড়িতে কোনো কাপড় নেই। বাড়ির কোনো সদস্যের গায়ে পরার দ্বিতীয় কোনো বস্ত্র নেই। প্রায় সব বাড়িতেই একই অবস্থা।”
শুক্র থেকে রোববার তিন দিনব্যাপী আহমদিয়া সম্প্রদায় সালানা জলসার আয়োজন করে। এই জলসা বন্ধ ও আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে বৃহস্পতিবার থেকে পঞ্চগড় শহরে মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে বিক্ষুব্ধরা।
এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার জুমার নামাজের পর শহরে বড় মিছিল হয়। এ সময় মিছিলকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ট্রাফিক পুলিশের স্টেশন, পঞ্চগড় বাজার মার্কেটে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের দোকানপাট ভাঙচুর এবং বিকালে আহমদিয়াদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
এ সময় শহরের মসজিদ পাড়া মহল্লার ফরমান আলীর ছেলে আরিফুর রহমান (২৭) এবং আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জাহিদ হাসান (২৩) নিহত হন বলে জেলা পুলিশ জানায়।
আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত বাবু বলেন, “আমি মাত্র দুয়েক দিন হল নতুন মালপত্র এনেছি। সেলফে জায়গা না হওয়ায় মেঝেতে কিছু মালামাল রেখেছি। কিন্তু মুহূর্তেই সব শেষ হয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, “দোকান ভেঙে রাস্তায় এনে মালপত্র পুড়িয়ে দিয়েছে।”
এদিকে এ ঘটনায় শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি বলে জানান সদর থানার ওসি আব্দুল লতিফ মিঞা।
তিনি বলেন, “কোনো পক্ষ থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মামলা হয়নি। তবে মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে। এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।”
এ ঘটনায় ১২ জনকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে বলেও জানান ওসি।
শুরুতে পুলিশের সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ
এদিকে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, ঘটনার শুরুর পর তাৎক্ষণিক তারা পুলিশের সহযোগিতা পাননি। যদি শুরুতেই পুলিশ তৎপর হত তাহলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যেত।
শনিবার বিকালে আহমদনগরে জলসা মাঠে সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ করেন বহিঃসম্পর্ক, গণসংযোগ, প্রেস ও মিডিয়া বিভাগের সম্পাদক আহমদ তবশির চৌধুরী।
তিনি বলেন, “তারা (মিছিলকারীরা) বাড়িগুলোতে আক্রমণ, লুটতরাজ এবং অগ্নিসংযোগ করে। এমতাবস্থায় প্রথম তিন ঘণ্টা আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সহায়তা পাইনি। অত্র এলাকায় তাদের উপস্থিতি থাকলেও অজ্ঞাত কারণে তারা নিষ্ক্রিয় থাকেন। এই বিষয়টি আমাদেরকে বিস্মিত ও ব্যথিত করেছে।”
তবে এ ব্যাপারে পুলিশের পক্ষ থেকে শনিবার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। যদিও শুক্রবার ঘটনার পর পরই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছিলেন, তারা গোটা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জেলা পুলিশ সুপারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সারাদিনই মাঠে ছিলেন।
ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে আহমদ তবশির চৌধুরী বলেন, “স্থানীয় প্রশাসনের গাইডলাইনের মধ্যেই আমরা আমাদের জলসা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। দুঃখের বিষয়, জলসা অনুষ্ঠানের ঠিক একদিন আগে একটি পক্ষ আমাদের জলসা বন্ধ এবং আচমকা আমাদের কয়েকটি বাড়িতে আক্রমণ করে। ওইদিন সন্ধ্যায় প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আমাদের জলসা শুরু করি। জলসা শুরু হওয়ার পরপরই কিছু সংখ্যক উগ্র ও দুষ্কৃতকারী আমাদের জলসার চারপাশের বাড়িঘরে আক্রমণ শুরু করে।”
তবশির চৌধুরী বলেন, “আহমদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে অসত্য, মনগড়া ও বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে, তাদেরকে উসকে দেওয়া হচ্ছে আমাদের বিরুদ্ধে। দুষ্কৃতকারীরা ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে আমাদের সদস্যদের ওপর চড়াও হয়, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে।
“তারা আমাদের এক তরুণ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার জাহিদ হাসানকে পিটিয়ে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের সংবিধান আমাদেরকে স্বাধীনভাবে ধর্ম-কর্ম পালনের অধিকার প্রদান করেছে। আমরা আশা করব, সরকার ও প্রশাসন আমাদের সেই অধিকার সংরক্ষণে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেবেন এবং নিশ্চিত করবেন।
“একই সঙ্গে দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার নিশ্চয়তা প্রদান করবেন।”
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, শালশিড়িতে ৮১টি বাড়ি, আহমদনগরে শতাধিক বাড়ি আক্রমণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা।
আরও পড়ুন:
‘নামাজ পড়ে বাসায় এসে খাবে বলেছিল আরিফ’
পঞ্চগড়ে পুলিশ ও বিজিবি টহলে, পরিস্থিতি শান্ত
আহমদিয়া জলসা ঘিরে সংঘর্ষের পর থমথমে পঞ্চগড়, বিজিবির টহল
পঞ্চগড়ে আহমদিয়া জলসা বন্ধে মিছিল থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, বাড়িতে আগুন