পঞ্চগড়ে গ্রেপ্তার আতঙ্ক, সন্ধ্যাতেই ফাঁকা শহর

কাউকেই বিনা কারণে হয়রানি করা হবে না, আশ্বস্ত করেছে পুলিশ।

সাইফুল আলম বাবুপঞ্চগড় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2023, 03:47 PM
Updated : 7 March 2023, 03:47 PM

আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসাকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ-হামলা-হত্যা এবং আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ-লুটপাটের ঘটনার পর এখনও স্বাভাবিক জনজীবন ফিরেনি পঞ্চগড়ে।   

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার পর‌্যন্ত সদর ও বোদা থানায় মোট ১০ মামলায় ১০ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে; গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৩০ জনকে।  

এই অবস্থায় শহরজুড়ে মানুষের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্কের থাকলেও; বিনা কারণে কাউকে হয়রানি বা গ্রেপ্তার করা হবে না বলে আশ্বস্ত করেছে পুলিশ।

জেলা পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা সাংবাদিকদের বলেন, “ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ভিডিও ফুটেজ দেখে এবং সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আসামিদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তবে মামলা ও আসামি বেশি হওয়ার বিষয়টি নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ায় লোকজনের মধ্যে স্বাভাবিক কারণেই কিছুটা উদ্বেগ রয়েছে।“

“তবে কোনো নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে না। এমন অভিযোগও নেই। নিরপরাধ মানুষকে হয়রানির অভিযোগ এলে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।”

শুক্র থেকে রোববার তিন দিনব্যাপী আহমদিয়া সম্প্রদায় সালানা জলসার আয়োজন করে। এই জলসা বন্ধ ও আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে বৃহস্পতিবার থেকে পঞ্চগড় শহরে মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে বিক্ষুব্ধরা। 

এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার জুমার নামাজের পর শহরে বড় মিছিল হয়। এ সময় মিছিলকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ট্রাফিক পুলিশের স্টেশন, পঞ্চগড় বাজার মার্কেটে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের দোকানপাট ভাঙচুর এবং বিকালে আহমদিয়াদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

এ সময় শহরের মসজিদ পাড়া মহল্লার ফরমান আলীর ছেলে আরিফুর রহমান এবং আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জাহিদ হাসান নিহত হন বলে পুলিশ জানায়।

এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার রাতে দুজনকে আহমদিয়ারা গলা কেটে হত্যা করেছে দুষ্কৃতকারীরা এমন গুজব ছড়ায়। দুষ্কৃতকারীরা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে নিজেরা লাশ দেখে এসেছেন জানিয়ে লোকজনকে উত্তেজিত করে তোলে। এ নিয়ে ফের পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় স্থানীয় বিক্ষুদ্ধ জনতা। এ সময় দুটি দোকান ভাঙচুর করে মালামাল লুটপাট এবং একটি মাইক্রোবাসে আগুন দেওয়া হয়। 

এসব ঘটনায় পঞ্চগড় শহর ও আশপাশের এলাকায় মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবের টহলের মধ্যে রোববার থেকে শহরের দোকানপাট খুলতে শুরু করলেও ‘গ্রেপ্তার আর ফের হামলার আতঙ্কে’ জনজীবন যেন ঠিক স্বাভাবিক হয়ে উঠছে না।  

সন্ধ্যা নামতেই শহরের লোকজন বাড়ি ফিরতে শুরু করে। শহরের বাইরে থেকে আসা লোকজন কাজ সংক্ষিপ্ত করে বিকেলেই ফিরে যায়। রাত ৮টার মধ্যেই শহর প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে বলে জানালেন অনেকেই।

শহরের মসজিদপাড়া মহল্লার বাসিন্দা স্টুডেন্ট টেইলার্সের স্বত্ত্বাধিকারী আমিনার রহমান (৫০) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত তিন দিন ধরে কর্মচারীরা ভয়ে কোনো কাজই শেষ করতে পারছেন না। প্রথম দুদিন গণ্ডগোলের কারণে সবার মত আমার দোকানও বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আর শনিবার থেকে পুলিশের গ্রেপ্তারের ভয়ে সবাই সন্ধ্যা হতেই বাড়ি ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো করে।

“বাজারের লোকজন কম দেখে আমিও কাজ শেষ না হলেও বাড়ি ফিরতে বাধা দেই না। কারণ, কোনোকিছু হলে তো তাদের পরিবারের কাছে আমাকেই জবাব দিতে হবে।“

ঘটনার পর থেকে শহরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংখ্যা ও টহল বেড়েছে। অনেককে গ্রেপ্তার করছে। এ কারণে ভয়ে কয়েকদিন ধরে সন্ধ্যার পর পরই বাড়িতে ফিরছেন বলে জানান শহরের রাজনগর মহল্লার সিরাজুল ইসলাম।

ঘরে খাবারের আয়োজন সীমিত; তাই উপার্জনের আশায় বাধ্য হয়েই বের হতে হয়েছে বলে জানান রিকশাচালক মাহমুদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভাই, শহরে লোকজন কমে গেছে। এক-দুঘণ্টা পর পর একজন যাত্রী পাচ্ছি। এভাবে গত দুদিন বাজার খরচের টাকাও তুলতে পারিনি। তাড়াতাড়ি অবস্থা ভাল হলে সবার জন্যই ভাল হবে।”

শহরের কামাতপাড়া মহল্লার বাসিন্দা আব্দুল খালেক (৫৫) গালামালের দোকান করেন সিনেমা হল রোডে। তার দোকান এমনিতে স্বাভাবিক সময়ে মধ্যরাতের পরও খোলা থাকে।  

তিনি বলছিলেন, “বৃহস্পতিবার থেকে নানা গণ্ডগোলে এমনিতেই বিভিন্ন সময়ে দোকান বন্ধ হয়ে যায়। দোকানের কমবয়সী কর্মচারিটাও ভয়ে বাড়ি চলে যায়। রোববার থেকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও বাজারে লোকজনের আনাগোনা কমে গেছে। বিক্রিও কমে গেছে।

“কাস্টমাররাই বলছেন, মামলা নাকি অনেকগুলো হয়েছে, পুলিশও ধরছে। এজন্য বিপদের আশঙ্কায় সন্ধ্যার আগেই আমি বাড়ি চলে যাই। ঝামেলায় পড়তে চাই না।”

সিনেমা হল রোড এলাকার চটপটি দোকানি ও শহরের খালপাড়া মহল্লার বাসিন্দা মো. আলী বলেন, “শুক্র ও শনিবার আমার দোকানে ভিড় ও বেচাকেনা বেশি হয়। এই দুইদিনে মালামালও বেশি তৈরি করা ছিল। রাত ১২টা পর্যন্ত বেচাকেনা হত।

“কিন্তু কপাল খারাপ, দুইদিনই শহরে গণ্ডগোলের কারণে লোকজনের যাতায়াতই ছিল না। রোববার দোকান খুললেও লোকজন ভয়ে শহরে কম ছিল। কখন কী হয় এই ভয়ে আমিও সন্ধ্যাতেই দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যাই।”

পঞ্চগড় চেম্বার অব কমার্সের সহসভাপতি ও শহরের সেন্ট্রাল প্লাজার স্বত্ত্বাধিকারী মেহেদি হাসান খান বাবলা বলেন, “সাম্প্রতিক ঘটনায় শহরের পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও লোকজনের মাঝে নানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। কেউ পুলিশের গ্রেপ্তার, কেউ আবারও সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন।”

তিনি বলেন, “শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পঞ্চগড়ে এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনা কারোর কাম্য ছিল না। এক্ষেত্রে সবার আরও সতর্ক থাকা দরকার ছিল।”

আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ী আহমদ বাবু (৪৫) বলেন, “দোকানের মালামাল সব তো লুট হয়ে গেছে। ভয়ে বৃহস্পতিবার থেকে দোকানেও যাই না। কী অবস্থায় দোকান আছে তা মার্কেটের মালিককে বলেছি একটু দেখে রাখতে। তিনি বলেছেন, দেখবেন।”

সাধারণ মানুষের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্কের ব্যাপারে পঞ্চগড় সদর থানার ওসি আব্দুল লতিফ মিঞা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিরপরাধ কাউকে গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হচ্ছে না। সব ধরনের তথ্য যাচাই-বাছাই করেই আসামি ধরা হচ্ছে এবং আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হচ্ছে।”