নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় তিন নারী সাংবাদিকের ওপর এ হামলা চালানো হয়।
Published : 30 Jul 2024, 12:19 AM
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হামলাকারীদের হাতে ‘যৌন নিপীড়নের শিকার’ এবং গ্যাস লাইট দিয়ে মুখমণ্ডল পুড়িয়ে দেওয়া নারায়ণগঞ্জের এক নারী সাংবাদিক ১০ দিন পরেও ঘুমের মধ্যে আঁতকে ওঠেন; ভয় আর আতঙ্ক মানসিকভাবে কাবু করে ফেলেছে তাকে।
তিনি বলছিলেন, “রাতে ঘুম হয় না। দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায়। সারাক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে থাকি। মানুষের ভিড় দেখলেই ভয় লাগে। প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কোনোভাবেই মাথা থেকে ওই স্মৃতি মুছতে পারছি না।”
সোমবার বিকালে নারায়ণগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন সেই নারী সাংবাদিক।
আরও পড়ুন-
স্বামীকে হারিয়ে ছেলের জন্য চাকরি চাইছেন গণির স্ত্রী
মানুষ মানুষকে এভাবে মারতে পারে? প্রশ্ন জুয়েলের বাবার
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহের জন্য গিয়ে ২০ জুলাই বিকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকায় নির্যাতনের শিকার হন ৩৭ বছর বয়সী এই নারী। এ সময় তার সঙ্গে আরও দুই নারী সহকর্মী ছিলেন। তারাও মারধরের শিকার হন।
আহত তিন নারী সাংবাদিক স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে কাজ করেন। তাদের মধ্যে দুইজনের সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
তারা বলেন, সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর আন্দোলনরতদের একটি অংশ তাদের ওপর হামলা চালায়। হাসপাতালে যিনি ভর্তি আছেন তার শারীরিক পরিস্থিতি উন্নতির দিকে রয়েছে বলে জানিয়েছে চিকিৎসক।
পাঁচ দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই নারী সাংবাদিক বলেন, আন্দোলনের শুরু থেকেই পেশাগত কারণে মাঠপর্যায়ে কাজ করছিলেন তারা। ১৯ জুলাই রাতে কারফিউ ঘোষণার পরও নারায়ণগঞ্জের একাধিক স্থান ছিল আন্দোলনকারীদের দখলে।
পরদিন বিকাল ৪টার দিকে শহরের চাষাঢ়া থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়ক হয়ে সাইনবোর্ড এলাকায় যান তিন সাংবাদিক। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থানের পরই হামলার শিকার হন তারা।
আরও পড়ুন-
‘লাঠি ফেলে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সেলফি’, তারপরই হামলা, সিঙ্গাপুরে কেমন আছেন
'কী অপরাধে কারা এমনে আমার মেয়েটাকে মারল'
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ওই সাংবাদিক বলছিলেন, “আমরা যখন যাচ্ছিলাম তখন পরিচিত একজন বলছিলেন, ওদিকে যাইয়েন না, সাংবাদিক জানলে মেরে ফেলবে। তখন ফিরে যেতে চাইলেও সাথের জন বললো, চলেন যাই, বেশিক্ষণ থাকবো না। কিছু ছবি আর ফুটেজ (ভিডিও) নিয়ে চলে আসবো। তার কথায় সায় দিয়ে গেলাম সেখানে।
“যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই ‘ওই সাংবাদিক’ বইলাই আমাদের ঘেরাও দিয়ে ফেলে। তারপর আর কিছু বলার নাই। যার হাতে যা ছিল তা দিয়েই মারতে শুরু করলো। দুইজন কোনোমতে পালাতে পারলেও শারীরিকভাবে আমাকে ওরা হেস্তনেস্ত করে ছাড়লো। তা তো আপনারা শুনেছেনই।”
শুধু মারধরই নয়, ‘যৌন নির্যাতনের’ শিকার হয়েছেন অভিযোগ করে তিনি হেনস্তার ঘটনা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “আন্দোলনের সময় গাড়িগুলো যেভাবে পিটাইয়া ভাঙছে, আমাদেরও একইভাবে পিটাইছে। এক পর্যায়ে একজন বলে উঠলো ‘তোরা থাম, মইরা গেলে তো মামলা খাবি’। তখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ার শব্দ পেয়ে হামলাকারীরা সরে যায়। পরে স্থানীয় দুইজন লোক আমাকে কোনোমতে ধরে রিকশা তুলে দেয়।”
তার আগে হামলাকারীরা মুখের সামনে গ্যাস লাইটার জ্বেলে ধরলে মুখমণ্ডলের বিভিন্ন অংশ ঝলসে যায় বলেও তুলে ধরেন এই সংবাদকর্মী।
আহত অবস্থায় প্রথমে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন তিনি। পরে তাকে পাঠানো হয় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হলেও তিনি যেতে পারেননি।
আরও পড়ুন-
একমাত্র উপার্জনক্ষম তাজুলকে হারিয়ে অসহায় পরিবার
'কতই না কষ্ট প্যায়ে আমার কলিজার টুকরা মারা গেছে'
কারণ, পরিস্থিতি তখনও স্বাভাবিক হয়নি। এমন অবস্থায় সড়ক পথে ঢাকায় যাওয়ার ঝুঁকি আর নেননি তিনি। নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে নিজ বাড়িতে না গিয়ে আশ্রয় নেন ভাইয়ের বাসায়।
ওই সংবাদকর্মী বলছিলেন, “আমি এই পেশায় ১৪-১৫ বছর। এই শহরের অনেকেই আমাকে চেনে। এইভাবে হামলায় পড়ব কখনো ভাবিনি। আমি এইসব আর নিতে পারছি না। মাথা যন্ত্রণায় ফেটে যায়। স্মৃতিগুলো বারবার মনে পড়ে।”
নির্যাতনের শিকার এই সাংবাদিকের ছেলে স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী। মায়ের ওপর হামলা ও আচরণের ‘এমন সব কথা শোনার পর’ তার মানসিক অবস্থা নিয়েও উদ্বিগ্ন তিনি।
হাসপাতালে সাংবাদিকের শয্যাপাশে ছিলেন তার ছোট বোন। তিনি বলেন, “ও (সাংবাদিক) এখন মানুষ দেখলেই ভয় পায়। কোথাও যেতে চায় না। প্যাথলজি পরীক্ষা করানোর জন্য এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে গেছিলাম। সেখানে মানুষের ভিড় দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে। বাড়ি ফিরে যাবে বলে ছটফট করতে থাকে।”
এই সাংবাদিক নারায়ণগঞ্জের যে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন সেই হাসপাতালের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মাহাদী হাসান বলেন, “একবার তিনি এখানে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় গিয়েছিলেন। পরে আবার এসে হাসপাতালে ভর্তি হন। গত পাঁচদিন তিনি ভর্তি আছেন।
“চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার শারীরিক অবস্থা আগের থেকে ভালো। তবে তার মাথায় আঘাত বেশি। মুখের বেশকিছু অংশ ঝলসে যাওয়ায় সিটিস্ক্যান করা যাচ্ছে না।”
‘শরীরে ছররা গুলি নিয়েই পেশাগত কাজে’
হামলায় মারধরের শিকার আরেক নারী সাংবাদিক আগের দিন পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হয়েছিলেন। তার শরীরের তিনটি স্থানে ছররা গুলি লেগেছিল। ডান হাতে লাগা গুলিটি অস্ত্রোপচার করে বের করতে হয়েছিল বলে জানান ৪৯ বছর বয়সী ওই সাংবাদিক।
তিনি বলছিলেন, “আগের দিন গুলি খেলেও বাসা থেকে বের হইছিলাম পেশাগত তাগিদে। কিন্তু এভাবে হামলার শিকার হব তা কোনোভাবেই ধারণায় ছিল না। যখন হামলা হয় তখন আমরা তিনজন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। মারধরের এক পর্যায়ে কোনোমতে আমি দৌঁড়ে একটি নির্মাণাধীন ভবনের নিচে গিয়ে আশ্রয় নেই। পরে স্থানীয় এক ব্যক্তির সহযোগিতায় সেখানে অনেকক্ষণ অবস্থানের পর গলির রাস্তা দিয়ে আবারও হামলার শিকার হব কি না সেই আতঙ্ক নিয়ে বাসায় ফিরতে পারি।
আরও পড়ুন-
নিস্তব্ধ রুদ্রদের বাড়ি, নির্বাক বাবা-মা
'বাবা, তোমার মনের আশা পূরণ করতে পারলাম না, মাফ করে দিও'
“কিন্তু আমাদের তিনজনেরই মোবাইল, ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ায় বাকি দুজনের খবর তৎক্ষণাৎ নিতে পারিনি। পরে আমার সঙ্গে থাকা দুই সহকর্মীর খোঁজ পেয়েছি অন্য সহকর্মীদের মাধ্যমে। তাও প্রায় দুই ঘণ্টা পর।”
ওইদিনের ঘটনার ‘ট্রমা’ কাটিয়ে উঠতে পারছেন না, রাতে জানালার পাশে কেউ দাঁড়ালেই আতঙ্ক বোধ করেন জানিয়ে তিনি বলেন, “ওইদিন আমাদের সঙ্গে আরও খারাপ কিছু হতে পারতো। সেই সিচুয়েশন তৈরি হয়েছিল। নিজেকে একটু স্বাভাবিক করতেই আজ (রোববার) বাসা থেকে বের হলাম।
“সাংবাদিকরা মানুষের কথা বলে। সাংবাদিকরা কোনো দলের বা গোষ্ঠীর নন। পেশাগত কাজ করতে গিয়ে এমনভাবে হামলার শিকার হয়েছি, যা ন্যাক্কারজনক। এইটার বিচার হওয়া উচিত।”
তিনি বলেন, “কিন্তু তার চেয়ে বড় একটি বিষয় আমাকে আঘাত দিয়েছে, তা হল- আমার অনেক সহকর্মী খোঁজ-খবর নিয়েছেন, শারীরিক অবস্থা জানতে চেয়েছেন। কিন্তু কেউ কেউ আবার বলেছেন, ‘গ্যাছো কেন এই পরিস্থিতিতে ওইদিকে’। এইটা আমাকে আঘাত করে। আমি আমার কাজ করতে যাব না? নাকি কেবল নারী বলে এই ধরনের তাচ্ছিল্য আমাদের প্রতি?”
হামলার শিকার তৃতীয়জনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
তবে তার দুই সহকর্মী জানিয়েছেন, তিনিও ব্যাপক মারধরের শিকার হয়েছেন। তবে এখন শারীরিক পরিস্থিতি অনেকটা ভালো।
আরও পড়ুন-
'আর কোনো বাবা-মায়ের কোল যেন এভাবে খালি না হয়
'তিন শিশুকে নিয়ে আমি কোথায় দাঁড়াব, এখন কে ওদের দেখবে?'
‘ছাত্ররা এই তাণ্ডব চালাতে পারে না’
এদিকে, সোমবার বিকালে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাংবাদিককে দেখতে যান জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্য ফরিদা ইয়াসমিন।
এর আগে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে আন্দোলন চলাকালীন আহত হওয়া আরও কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তাদের মধ্যে অনলাইন পোর্টাল জাগো নিউজের প্রতিবেদক শ্রাবণ মোবাশ্বির গুলিতে আহত হয়েছেন। তার মাথায় বিদ্ধ একাধিক গুলি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বের করতে হয়েছে।
আন্দোলনকারীদের হামলার শিকার হয়েছেন দৈনিক নয়াদিগন্তের ফটোসাংবাদিক মনিরুল ইসলাম সবুজও।
ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, “ছাত্ররা ন্যায্য একটি আন্দোলনে ছিল। সেই আন্দোলনকে ব্যবহার করে সারাদেশে সন্ত্রাসীরা তাণ্ডব চালিয়েছে। বিশেষ করে গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীর ওপর তারা হামলা চালিয়েছে। সরকারি উন্নয়নগুলো ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়েছে। আমরা কেউ বিশ্বাস করি না, ছাত্রদের দ্বারা এই ধরনের তাণ্ডব হতে পারে।
“নির্যাতনের শিকার তিনজন নারী সাংবাদিকের একজনের অবস্থা খুবই খারাপ। তার সঙ্গে যা হয়েছে তা মুখেও প্রকাশ করা যায় না। মায়ের জাতির সঙ্গে তারা এই ধরনের বর্বরতা কীভাবে করে তা আমার বুঝে আসে না।”
প্রধানমন্ত্রী আহত সাংবাদিকদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুন-
কোটা: সাঈদের পরিবারকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সহায়তা
কোটা: 'ও ভাইও হামাক এনা বোন কয়া ডাকো রে', সাঈদের বোনের আহাজারি
নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট কার্যালয়: 'ডাকাতি হইলেও তো এমন হয় না'