Published : 27 Jul 2024, 10:27 PM
হতদরিদ্র পরিবারের রাসেল খুব অল্প বয়সেই লেখাপড়া বাদ দিয়ে নারায়ণগঞ্জের তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছিল মূলত বাবাকে কিছুটা সাহায্য করার জন্যই। মাত্র ছয়-সাত হাজার টাকা বেতন। নিজে কোনোরকমে একটা মেসে মাথা গুঁজে খেয়ে না খেয়ে হাতের টাকাটা বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন।
গুলিবিদ্ধ রাসেলকে যে সাদা কাপড়ে মুড়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল; সেই রক্তাক্ত কাপড়টিও সহকর্মীরা যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন।
রাসেলের মরদেহ ২৩ জুলাই দুপুরে যখন নওগাঁর মান্দা উপজেলার গ্রামের বাড়ি পৌঁছে, তখন কফিনের সঙ্গে সেই রক্তমাখা কাপড়টিও ছিল।
শোকে পাথর অঞ্জনা খাতুন ছেলে রাসেলকে বিদায় দিলেও ‘যক্ষের ধনের মত’ আগলে রেখেছেন রক্তমাখা কাপড়টি। নির্বাক মা সেই কাপড়ের দিকে চেয়ে থাকেন; বুকে জড়িয়ে ধরেন; ছেলের কথা মনে করে বিলাপ করতে করতে মূর্ছা যান।
পাশে বসে ‘রাসেল, আমার রাসেল রে’ বলে উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকেন বাবা পিন্টু রহমান।
বলছিলেন, “ছেলের বুকে গুলি লাগছে শুক্রবার (১৯ জুলাই)। চার দিন ধরে হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সঙ্গে লড়েছে। ছেলে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে জ্যানেও তার পাশে থাকতে পারিনি। কতই না কষ্ট প্যায়ে আমার কলিজার টুকরা মারা গেছে। কতই না আর্তনাদ করিছে। এমন কষ্ট আল্লাহ য্যান আর কেউ না পায়।”
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ডিআইটি রোডের দেওভোগ মার্কেটের ২ নম্বর গেইটের সামনে কিশোর মো. রাসেলের বুকে গুলি লাগে। হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর চার দিন চিকিৎসাধীনও ছিলেন। পরে আর মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ফিরতে পারেননি।
শুক্রবার দুপুরে উপজেলার কশব ইউনিয়নের ভোলাগাড়ী গ্রামে রাসেলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশ-খড়ের বেড়া আর টিনের ছাউনির ছোট্ট একটি ঘর। সেই ঘরেই রাসেলের পরিবারের সদস্যরা বসবাস করেন।
বাড়িটির সামনে পৌঁছাতেই ভেতর থেকে নারীকণ্ঠে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। পরিচয় পেয়ে প্রতিবেশী এক নারী বাড়ির ভেতরে গিয়ে রাসেলের চাচা আবদুর রশিদকে ডেকে আনেন।
বাড়ির বাইরে আলাপকালে আবদুর রশিদ বলেন, রাসেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শোনার পর থেকে তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মুখে কোনো খাবার নিচ্ছেন না। এতে তিনি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছেন। রাসেলের বাবা তাকে নিয়ে গেছেন হাসপাতালে।
আবদুর রশিদ বলেন, সংসারে অভাবের কারণে রাসেল তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে আর বিদ্যালয়ে যায়নি। দেড় বছর ধরে নারায়ণগঞ্জে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করছিল। পাঁচ-সাত হাজার টাকা বেতনের সেই চাকরি। কোরবানির ঈদের ছুটি কাটিয়ে কর্মস্থল নারায়ণগঞ্জে ফিরে যায় রাসেল। আর এবার সে বাড়িতে এল লাশ হয়ে।
গ্রামবাসী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯ জুলাই বিকালে নারায়ণগঞ্জের ডিআইটি রোডের দেওভোগ মার্কেটের ২ নম্বর গেটের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয় কিশোর মো. রাসেল।
গুরুতর অবস্থায় রাসেলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাসেলের বুকে একটি বুলেট বিদ্ধ হয়। ২১ জুলাই তার অস্ত্রোপচার করে বুলেট বের করা হয়। পরে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২২ জুলাই সে মারা যায়।
২৩ জুলাই দুপুরে তার লাশ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। পরে ওই দিনই রাতে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
রাসেলের বাবা পিন্টু রহমান দিনমজুরি করে সংসার চালান। তিন বোনের এক ভাই রাসেল; সে সবার ছোট। এক বোন মানসিক ভারসাম্যহীন।
বাড়ির বাইরে আবদুর রশিদের সঙ্গে কথা বলার সময় হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন রাসেলের বাবা পিন্টু রহমান ও মা অঞ্জনা খাতুন।
পিন্টু রহমান বলেন, ১৯ জুলাই বিকালে ছেলের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল। ফোন করে সে মা-বোনের খোঁজ-খবর নিয়েছে। ওই দিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাসেলের ফোন থেকে এক ব্যক্তি কল করে জানান যে, রাসেল গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
“ঢাকায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এরই মধ্যে শুনি, কারফিউ জারি করা হয়েছে। ঢাকা যাওয়ার কোনো গাড়ি না পাওয়ায় আর ছেলের কাছে যাওয়া হয়নি।”
রাসেলের মা কোনো কথা বলতে পারেননি। তিনি শুধু কাঁদছিলেন।
রাসেলের প্রতিবেশী আবুল কালাম আজাদ বলেন, পরিবারটি অত্যন্ত দরিদ্র। উপার্জনক্ষম ছেলেটি গুলিতে মারা যাওয়ায় পরিবারটি খুব ক্ষতি হলো। এই অবস্থার কথা বিবেচনায় নিয়ে পরিবারটিকে সহায়তা করা প্রয়োজন।
প্রতিবেশী ও কশব ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য পাঞ্জব আলী বলেন, “রাসেলের বাবা একেবারে গরিব মানুষ। দিনমজুরি করে কোনো রকমে সংসার চালান। তিন মেয়ের মধ্যে একজন প্রতিবন্ধী। অন্য দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়ের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের কিছুদিন পরই স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এখন সে বাবার সংসারেই থাকেন।
“রাসেল ছেলেটা দেড় বছর ধরে পোশাক কারখানায় কাজ করছিল। ছয়-সাত হাজার টাকা বেতনে কোনো মতে তাদের সংসার চলছিল।”
আরেক প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম বলেন, “আর কিছুদিন গেলে হয়তো কাজ ভালোভাবে শিখলে বেতন আরও বাড়ত। সুখের নাগাল পেত তার মা-বাবা। এরই মধ্যে সব শেষ হয়ে গেল। থেমে গেল তার বাবা-মার রাসেলকে ঘিরে স্বপ্ন।”
আরও পড়ুন
'বাবা, তোমার মনের আশা পূরণ করতে পারলাম না, মাফ করে দিও'
'আর কোনো বাবা-মায়ের কোল যেন এভাবে খালি না হয়
'তিন শিশুকে নিয়ে আমি কোথায় দাঁড়াব, এখন কে ওদের দেখবে?'
কোটা: সাঈদের পরিবারকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সহায়তা
কোটা: 'ও ভাইও হামাক এনা বোন কয়া ডাকো রে', সাঈদের বোনের আহাজারি
নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট কার্যালয়: 'ডাকাতি হইলেও তো এমন হয় না'
'লাঠি ফেলে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সেলফি', তারপরই হামলা, সিঙ্গাপুরে কেম