“ফায়ার সার্ভিসকে কল দিয়ে পাচ্ছিলাম না। তারা জানালো, তাদের স্টেশন ঘেরাও করে রাখা হয়েছে।”
Published : 24 Jul 2024, 11:13 PM
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার জালকুড়ি এলাকায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়কের পাশে ‘শীতল ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের’ বাস ডিপো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসগুলো ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচল করে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলনের কারণে যানচলাচল বন্ধ থাকায় এ পরিবহনের ২৪টি বাস ডিপোতেই রাখা ছিল। গত শনিবার সন্ধ্যায় আন্দোলনকারীদের দেওয়া আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সবকটি বাস।
আগুন লাগানোর খবর পেয়ে আধা ঘণ্টার মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পেরেছিলেন শীতল ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের চারজন পরিচালক।
তাদের একজন ফারুক হোসেনের ভাষ্য, তারা ডিপোতে পৌঁছাতে পারলেও আগুন নেভানোর জন্য কোনো উদ্যোগ নিতে পারেননি। উল্টো ‘আন্দোলনকারীদের রোষানলে’ পড়েন।
শহর ও শহরতলীজুড়ে তখন তীব্র আন্দোলন চলায় ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। ফলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাসগুলো পুড়তে দেখা ছাড়া আর কোনো কোনো উপায় ছিল না তার।
শীতল ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান। আন্দোলনকারীরা বিষয়টি জানতেন এবং এই কারণে এই ডিপোটি তাদের ‘টার্গেটে’ ছিল বলে দাবি পরিচালক ফারুক হোসেনের।
ওইদিনের ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, “তখনও এশার নামাজের আযান দেয়নি। আন্দোলনকারীদের নিভৃত ও সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করতে গাড়িবহর নিয়ে ঘুরছিলেন সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। এক পর্যায়ে তিনি গাড়িবহর নিয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড দিয়ে চাষাঢ়ার দিকে এগিয়ে যান।
“এর কিছুক্ষণ পরে ‘আন্দোলনকারীরা’ নম পার্কে (শামীম ওসমানের প্রয়াত বড়ভাই নাসিম ওসমানের নামে পার্ক) আগুন দেয়। তার কিছুক্ষণ পরই আগুন দেওয়া হয় আমাদের বাস ডিপোতে।”
জালকুড়িতে এই ডিপোর অদূরে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড-বিজিবি ৬২ ব্যাট্যালিয়নের একটি ক্যাম্প রয়েছে। ফলে রাষ্ট্রীয় বিশেষ এই বাহিনীর ক্যাম্পের পাশে ডিপো হওয়ায় বাসগুলো নিরাপদ থাকবে বলে ভেবেছিলেন ফারুক। কিন্তু তাতেও রক্ষা হয়নি।
ফারুক বলছিলেন, “খবর পাই, প্রথমে দুটি বাসে আগুন দিয়েছে; ডিপোতে যারা ছিলেন তাদের সবাইকে মারধর করে বের করে দেওয়া হয়েছে। দ্রুত আমরা চারজন পরিচালক ছুটে আসি। তখন পুরো রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া, আন্দোলনকারীদের অবস্থান। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে আগুনের ভিডিও করতে নিয়েছিলাম। তখন কিশোর বয়সী কয়েকজন ছেলে আমাকে ঘিরে ফেলে। আমার মোবাইল থেকে সবকিছু ডিলেট করে ফেলে।
“আমি যখন এই অবস্থায় তখন আমাদের অপর তিন পরিচালক সরে যান সেখান থেকে। আমি এই বাসগুলোর মালিকপক্ষের কেউ এমনটা জানলে হয়তো আমি সেখান থেকে ফেরত আসতে পারতাম না।”
তিনি বলেন, “ফায়ার সার্ভিসকে কল দিয়ে পাচ্ছিলাম না। পরে একজনকে মণ্ডলপাড়া এলাকায় তাদের অফিসে পাঠালাম। কিন্তু তারা জানালো, তাদের স্টেশন ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। নিরাপত্তার কারণে পুলিশ প্রটেকশন ছাড়া কোনো স্টেশন থেকেই তারা বের হতে পারবেন না। এর মধ্যে একের পর এক বাসে আগুন ছড়িয়ে যেতে থাকে।
“একটা একটা বাস পুড়ে আর ওরা ‘আরেকটা পুড়ছে, আরেকটা পুড়ছে’ বলে উল্লাস করতে থাকে। সবকিছু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি, কিছু করার ছিল না।”
এই পরিবহনের মোট ৩০টি বাস ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচল করে। ছয়টি বাস ছিল শহরের চাষাঢ়ার একটি পেট্রোল পাম্পে। বাকি ২৪টি বাসই ওইদিনের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
“ওইখানে জ্বালানি তেলও ছিল, ওইসব যদি ব্লাস্ট হতো তাহলে আশেপাশের ভবনগুলোতেও আগুন ছড়িয়ে পড়তো”, যোগ করেন ফারুক।
শীতল ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের মালিকানার সঙ্গে আরও ১৭ জন যুক্ত রয়েছেন। একটি বাসের মূল্য ৪৫-৫০ লাখ টাকা জানিয়ে এই পরিচালক বলেন, “আমাদের ইন্সুরেন্স করা আছে। কিন্তু ইন্সুরেন্সের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ যা পাওয়া যাবে তা ক্ষতির পাঁচ ভাগের এক ভাগও হবে না।”
এই ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, মামলার প্রস্তুতি নিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
১৮ জুলাই বেলা ১২টার দিকে নারায়ণগঞ্জ শহরে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে এই সংঘর্ষে যুক্ত হয় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও। তারা আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র, লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক নিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান।
শহরের চাষাঢ়ায় শুরু হওয়া এই সংঘর্ষ আশেপাশের চারটি সড়কে ছড়িয়ে পড়ে। দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে রাত ১২টা পর্যন্ত।
শুক্রবার দুপুরে অনুসারী কর্মাবাহিনী নিয়ে সড়কে নামেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। পরে কয়েকশ সরকারি দলের কর্মী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান।