১৯ জুলাই রাজধানীর উত্তরার ওই হামলার সময় জাহাঙ্গীর আলমের ব্যক্তিগত সহকারীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে জানায় পুলিশ।
Published : 25 Jul 2024, 11:29 PM
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে নেতাকর্মীদের বহর নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার পথে গুরুতর হামলার শিকার হন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক এখন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন।
তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল আছে বলে বৃহস্পতিবার দুপুরে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সদস্য মোখলেছুর রহমান জানিয়েছেন।
১৯ জুলাই রাজধানীর উত্তরার হাউস বিল্ডিং এলাকার ওই হামলায় জাহাঙ্গীর আলমের ব্যক্তিগত সহকারী জুয়েল মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় আহত হন আরও অনেকে। তারা গাজীপুর, টঙ্গী, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি বলে জানিয়েছেন উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি ডি এ ফরমান।
উত্তরায় হামলার একদিন পর জাহাঙ্গীর আলমের গাজীপুরের ছয়দানা এলাকার বাসাতেও হামলার ঘটনা ঘটে। সেখানে বসবাস করেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুন। সেই বাসাতেও ভাঙচুর চালানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সেই বাড়িতে গিয়ে মেয়র জায়েদা খাতুনের সঙ্গে দেখা করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আজমত উল্লা খান, গাজীপুর পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলমসহ প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের নেতারা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং আশপাশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা স্বতস্ফূর্তভাবে যোগ দেয়। আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইলসহ আশপাশের মূল সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানচলাচল বন্ধ থাকে। এ সময় রেলপথ অবরোধ করে গাড়ি আটকে রাখার ঘটনাও ঘটে।
এসব কর্মসূচির সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। তবে বড় ধরনের হামলা ও সহিংতার ঘটনা ঘটতে শুরু করে বৃহস্পতিবার থেকে। শুক্রবার সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনা মাত্রা ছাড়ায়। বিআরটিএ প্রকল্পে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। এই অবস্থায় গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের সব তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তবে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা ঘটে গাজীপুর মেট্রোপলিটন সদর থানাধীন শিববাড়ী, কেয়ামত সড়ক; বাসন থানাধীন ভোগরা, চান্দনা চৌরাস্তা, তেলিপাড়া; গাছা থানাধীন কুনিয়া, বোর্ড বাজার, বড়বাড়ী; টঙ্গী পশ্চিম ও পূর্ব থানা ও কোনাবাড়ী থানাধীন কোনাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড, ফ্লাইওভারের পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে।
আন্দোলনের মধ্যে শুক্রবার দুপুরে ঢাকায় আওয়ামী লীগের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গাড়িবহর নিয়ে রওনা দেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম।
সেই গাড়িবহরে আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেছুর রহমানও ছিলেন। তিনি বলেন, “জাহাঙ্গীর আলমের গাড়িবহর উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকা পার হওয়ার সময় বিক্ষোভকারীরা গতিরোধ করে। এক পর্যায়ে তারা হামলা চালায়। এ সময় আন্দোলনকারীদের ইট-পাটকেলের আঘাতে জাহাঙ্গীর আলমের মাথা ফেটে যায়।
“সঙ্গে থাকা বেশকিছু নেতাকর্মীও আহত হন। এ সময় জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে থাকা নেতাকর্মীরা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে হামলাকারীরা জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত সহকারী জুয়েল মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা করে।”
মোখলেছুর রহমান বলেন, “পরে জাহাঙ্গীর আলম পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার করে পাশের একটি হাসপাতালে ভর্তি করে। তার মাথায় ১৭টি সেলাই দেওয়া হয়। সেখান থেকে জাহাঙ্গীরকে রাজধানীর একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়।”
একদিন পর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরের মাউন্ড এলিজাবেথ হাসপাতালে নেওয়া হয়। বর্তমানে জাহাঙ্গীরের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে বলে জানান এই আওয়ামী লীগ নেতা।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জাহাঙ্গীর আলম ফাউন্ডেশনের প্রধান সমন্বয়ক আল রিয়াদ আহসান অন্তর বলেন, “আমরা যখন জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সঙ্গে গাড়িবহর নিয়ে উত্তরার হাউজ বিল্ডিং এলাকায় পৌঁছাই তখন সামনে লোকজন দেখে ভাই গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। তিনি তাদেরকে বুঝিয়ে বলেন, আমি জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুরের সাবেক মেয়র, তোমাদের দাবি নিয়ে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব। তোমাদের দাবি সরকারের উপর মহলে তুলে ধরব। তোমরা আমাকে ঢাকায় যাওয়ার সুযোগ করে দাও। তখন আন্দোলনকারীরা হাত থেকে লাঠি ফেলে দিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে অনেকেই সেলফি তুলেন।”
এর কিছুক্ষণ পর পেছন থেকে জাহাঙ্গীর আলমের মাথা লক্ষ্য করে ইট ছুড়ে মারা হয় এবং তাতে তার মাথা ফেটে যায় জানিয়ে অন্তর বলেন, “এর সঙ্গে সঙ্গে কিছু লোক এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করেন। ভাই রক্তাক্ত অবস্থায় দৌড়ে পাশের একটি ভবনে আশ্রয় নেন। পরে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নেতাকর্মীরা ভাইকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভতি করে।”
জাহাঙ্গীরের গাড়িবহর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ধরেই ঢাকায় আসছিল। তাতে কয়েকজন সংবাদকর্মীও ছিলেন।
গাড়িবহরের সঙ্গে থাকা স্থানীয় এক সাংবাদিক বলেন, “জাহাঙ্গীরের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে উত্তরার হাউজ বিল্ডিং এলাকায়। সেখানে তিনি বিক্ষোভকারীদের মুখে পড়েছিলেন। তিনি অর্ধ শতাধিক গাড়িতে দেড় শতাধিক লোকজন নিয়ে ঢাকায় সমাবেশে যাচ্ছিলেন। এই হামলায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ওসমান গনি কাজলও আহত হন। তারও মাথা ফেটে গিয়েছিল। তিনি গুরুতর আহত অবস্থায় নিজেই গাড়ি চালিয়ে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত চলে আসেন। গুরুতর অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।”
জাহাঙ্গীরের গাড়িবহর ছেড়ে টঙ্গী ব্রিজ এলাকায় থেমে যান জানিয়ে ওই সাংবাদিক বলেন, “তারপর আমি খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই। জানতে পারি, জাহাঙ্গীরের মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন। সারা শরীর রক্তে ভরে গিয়েছিল। পরে তো শুনলাম উনাকে সিঙ্গাপুরের নিয়ে গেছে।”
আগের দিনও আন্দোলনের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে প্রায় সারাদিন ছিলেন জানিয়ে ওই সাংবাদিক বলেন, “টঙ্গী তুলনামূলক শান্ত থাকলেও উত্তরা উত্তপ্ত ছিল। সেখানে ভাঙচুর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের হামলা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। গোটা এলাকা আন্দোলনকারীদের দখলে ছিল। কাউকে তারা ঢাকার দিকে যেতে দিচ্ছিলেন না।”
দৈনিক যুগান্তরের জেলা প্রতিনিধি রিপন শাহও কিছু সময় সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের গাড়িবহরের সঙ্গে ছিলেন। তিনি টঙ্গী ব্রিজ এলাকা থেকে চলে আসেন। পরে হামলার খবর জানতে পারেন। তিনি গিয়ে কাউন্সিলর মীর ওসমান গনি কাজলকে আহত অবস্থায় পান এবং তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
হামলার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা সেখানে তিনজন ছিলাম। আমরা জানতাম উত্তরা এলাকায় গণ্ডগোল হচ্ছে। ফলে সেদিকে না যাওয়ার জন্যই বলেছিলাম। পরে তো শুনি উনি (জাহাঙ্গীর আলম) গুরুতর আহত হয়েছেন, আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন।”
স্থানীয় আরেক সাংবাদিক হামলার সময় সেখানে ছিলেন। তিনি বলছিলেন, “উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরে গাড়িবহর থামার পর একজনকে দেখলাম জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সেলফি তুলল। মূল আন্দোলনের জমায়েত তখন অনেকটাই সামনে।
“তারপরই ৪০-৫০ জন লোক বিচ্ছিন্নভাবে এসে জাহাঙ্গীরের ওপর হামলা চালায়। তখন রক্তাক্ত অবস্থায় জাহাঙ্গীর মাসকট প্লাজার পাশ দিয়ে একটি বাড়িতে গিয়ে ঢুকে পড়েন। তখন হামলাকারীরা সেই বাড়ি ঘিরে ফেলে। পরে পাশের একটি বাড়িতে গিয়ে তিনি আশ্রয় নেন। সেখানেও আন্দোলনকারীরা যান। এবং ওই বাড়ির কেয়ারটেকারকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করে রাস্তায় ফেলে দেয়।”
“রাত ৯টার দিকে র্যাব, পুলিশ, বিজিবির সহায়তায় হেলিকপ্টারে তাকে ওই বাসা থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হামলায় গাজীপুর সিটি কাউন্সিলর মীর ওসমান গনি কাজল ও কাউন্সিলর শিপু খানও গুরুতর আহত হন। এ ছাড়া আরও ৩০ জন নানাভাবে আহত হয়েছেন।”
ওই সাংবাদিক আরও বলছিলেন, তিনি ফিরে এসে দেখেন জাহাঙ্গীরের পিএস জুয়েল মোল্লাকে মারধর করে গুরুতর আহত করে হামলাকারীরা। তাকে উদ্ধার করে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে আবার তার উপর হামলা হয়। একপর্যায়ে তাকে গাছে ঝুলিয়েও পেটানো হয়।
“এ বীভৎস্য দৃশ্য দেখার মত না। কোনো সাংবাদিককে তখন ছবি তুলতে দেওয়া হয়নি।”
মেয়র জায়েদার বাড়িতে হামলা, দেখতে গেলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী
জাহাঙ্গীরের ওপর হামলার একদিন পর তার মা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জায়েদা খাতুনের ছয়দানা বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়।
ঘটনার পাঁচ দিন পর বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর ছয়দানায় জায়েদা খাতুনের বাড়ি পরিদর্শনে যান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আজমত উল্লা খান, গাজীপুর পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলমসহ প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের নেতারা।
এ সময় আজমত উল্লা খান বলেন, “কোটা আন্দোলনকে ইস্যু করে একটি পক্ষ দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে করেছিল। তবে নেতাকর্মীরা সজাগ ছিলেন। কারফিউ জারি করার পর যখন সেনাবাহিনী মাঠে আসে, তখন আমাদের নেতাকর্মীরা সরে গিয়েছিল। এ সুযোগে মেয়রের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালায় একটি পক্ষ।
“হামলাকারীরা ইট-পাটকেল ছুড়ে বাড়ির গেইট, জানালা ভাঙচুর করে। সেইসঙ্গে বাড়ির ভেতরের একটি কক্ষে আগুন বা কোনো কিছুর বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। এতে কম্পিউটারসহ অনেক আসবাব পুড়ে গেছে।”
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজাম্মেল হক বলেন, “এটা কোনো রাজনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। আমরাও সারা জীবন আন্দোলন করেছি, আন্দোলন হয় রাজপথে, হয়তবা মারামারিও হয়। পক্ষ-বিপক্ষ হয়। কিন্তু বাড়িঘরে আক্রমণ এটা নজিরবিহীন ঘটনা।
“এটা কোনো মতেই রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশ হতে পারে না। এটা প্রতিহিংসামূলক ব্যাপার। জামায়াত-শিবির বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। এখানেও আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য মেয়রের বাড়িতে হামলা করা হয়।“
গাছা থানার ওসি জিয়াউল ইসলাম বলেন, ২০ জুলাই আন্দোলনের সময় মেয়র জায়েদা খাতুনের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এখনো কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন:
কারখানা খোলায় শ্রমিকদের স্বস্তি, ইন্টারনেটে গতি চান মালিকরা
কোটা: গাজীপুরে আটকে পড়া মৈত্রী এক্সপ্রেস ছাড়ল ৫ ঘণ্টা পর
টঙ্গীতে বিএনপির ২৬৮ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার ৭