Published : 26 Jul 2024, 10:01 AM
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসের বিকালে নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যখন অফিস ত্যাগ করেন তার কিছু পরেই ভবনটি দখল নিয়ে নেন কিছু হামলাকারী।
লাগাতার আন্দোলনের মধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ মহাসড়ক তখন আন্দোলনকারীদের দখলে। এর মধ্যেই ১৮ জুলাই রাতে ব্যাপক ভাঙচুরের পর পাসপোর্ট কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে গেলে তাদের গাড়িতেও হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে তারা সেখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়। ফলে চারতলা ভবনটির অধিকাংশ জিনিসপত্রই ভস্মীভূত হয়ে গেছে।
এ কারণে ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন শত শত গ্রাহক। সংস্কার কাজ শেষে কবে নাগাদ আবার সেবা চালু করা যাবে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছেন না কর্মকর্তারা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক কার্যত আন্দোলনকারীদের দখলে চলে যায়। নারায়ণগঞ্জ জেলা শহর ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা এতে স্বতস্ফূর্তভাবে যোগ দেন। আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে তারা মহাসড়কসহ আশপাশের মূল সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানচলাচল বন্ধ থাকে। এ সময় রেলপথ অবরোধ করে গাড়ি আটকে রাখার ঘটনাও ঘটে।
এসব কর্মসূচির সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনেরর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। তবে বড় ধরনের হামলা ও সহিংতার ঘটনা ঘটতে শুরু করে বৃহস্পতিবার থেকে। শুক্রবার সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনা মাত্রা ছাড়ায়।
এ সময় নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ে হামলা ও তাণ্ডব চালানো হয়। রাস্তার পাশে যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সংঘর্ষ, হামলা ও অগ্নিসংযোগের সময় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কে কয়েকজনের হতাহতের ঘটনাও ঘটে। একপর্যায়ে সড়কটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এসব ঘটনার মধ্যেই ১৮ জুলাই রাতে নারায়ণগঞ্জের আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সেদিন রাতে কার্যালয়ে ছিলেন চারজন আনসার সদস্য এবং একজন নৈশপ্রহরী।
আনসার সদস্য সালাহ উদ্দিন বৃহস্পতিবার বলেন, “পরিস্থিতি খারাপ দেখে আমাদের সতর্ক থাকার নির্দেশনা ছিল। রাত পৌনে ৯টার দিকে কয়েকশ আন্দোলনকারী গেইট ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে। আমরা তখন বিল্ডিংয়ের চারতলায়। নিচে কলাপসিবল গেটটি তখনও বন্ধ। এর মধ্যে আমাদের গার্ড রুমে আগুন ধরিয়ে দেয়। কলাপসিবল গেইট ভেঙে ভেতরে ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেয়।”
“পরিস্থিতি খারাপ দেখে স্যারদের ফোন দিলাম, পুলিশে ফোন দিলাম। কিন্তু কেউ এই অবস্থায় আসতে পারলো না। ফায়ার সার্ভিসের দুইটা গাড়ি আসছিল আগুন নেভাতে। তখন একটা গাড়িতে আগুন দিলে অন্যটা সেখান থেকে সরে যায়।”
সালাহ উদ্দিন বলেন, “৬০-৭০ জন পরে উপরে উঠে গিয়ে ভবনের বিভিন্ন কক্ষে ভাঙচুর করে আগুন দেয়। তারা এক ঘণ্টারও বেশি সময় ছিল। পুরো সময়ের মধ্যে কেউ ব্যাক-আপ দিতে পারে নাই।”
কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, চারতলা পাসপোর্ট কার্যালয়ের নিচতলায় বায়োমেট্রিক কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। দ্বিতীয় তলায় সার্ভার রুম, উপ-পরিচালকের কক্ষ রয়েছে। সেখানে সারি সারি সাজিয়ে রাখা তৈরি পাসপোর্ট।
তৃতীয় ও চতুর্থ তলাতেও বিভিন্ন নথিপত্র ও পাসপোর্টের কার্যক্রম চলে। পুরো চারতলা ভবনের কোনোকিছুই আর বাকি নেই। তৈরি করে রাখা পাঁচ হাজারেরও বেশি পাসপোর্টও পুড়ে গেছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
আগুন দেওয়ার সময় ভবনটিতে আটকা পড়েন আনসার সদস্যরা। হামলা এড়াতে আনসারের পোশাক পাল্টে সাধারণ পোশাক পরে কৌশলে ভবনটি থেকে হওয়ার কথা জানান ২৩ বছর বয়সী আনসার সদস্য মিটন চন্দ্র কর।
তিনি বলছিলেন, “তিন বছর হয়েছে আমার চাকরির। আমি কখনই ভাবিনি এমন সিচুয়েশনে পড়বো। একটা সময় ভেবেছিলাম ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়বো। ভবনের নিচে আগুন জ্বলছে, শত শত মানুষ সেখানে। আর আমরা উপরে আটকা পড়ছি। কেউ কোনো কথা বলছি না। বাঁচার কোনো উপায় দেখছিলাম না। পরে ড্রেস চেঞ্জ করে এলাকার কিছু ছেলের সহযোগিতায় ভবন থেকে আমরা নেমে আসি।”
বিভীষিকাময় ওই পরিস্থিতির তুলনা ‘অন্য কিছুর সঙ্গে হয় না’ মন্তব্য করে এই তরুণ আনসার সদস্য বলেন, “এক সাংবাদিক ভিডিও করতেছিল আগুনের। তখন তাকেও ব্যাপক মারধর করা হয়। একটা বাড়িতে বা কোনো অফিসে ডাকাতি হইলেও তো এমন হয় না। বিল্ডিংটাতে কিচ্ছু রাখে নাই। শুধু ভাঙচুর আগুন যে দিছে তা না, লুটপাটও করছে তারা।”
এ ঘটনায় ২২ জুলাই ফতুল্লা মডেল থানায় একটি মামলা করেন আঞ্চলিক এই পাসপোর্ট কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মাহমুদুল হাসান। ওই মামলায় কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে উল্লেখ করে দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে জানান ফতুল্লা মডেল থানার ওসি নূরে আযম।
আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মাহমুদুল হাসান বলেন, “ভবনের কোথাও কিছু বাকি নেই। পাঁচ হাজারেরও বেশি তৈরি পাসপোর্টসহ নথিপত্র, সার্ভার বক্স সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অফিসের কম্পিউটারসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। কবে নাগাদ এই অফিসের কার্যক্রম শুরু করা যাবে তা বলা যাচ্ছে না।”
গ্রাহকদের ভোগান্তি
বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা যায়, পাসপোর্ট কার্যালয়ের সামনে গ্রাহকদের ভিড়। ভবনের সামনের ফটকে একটি ডেস্ক খোলা হয়েছে। গ্রাহকদের বিষয়ে তথ্যাদি সেখানে টুকে রাখা হচ্ছে। পরবর্তীতে এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে বলে জানাচ্ছেন পাসপোর্ট কার্যালয়ের কর্মীরা। দুপুর ২টা পর্যন্ত ৩৯ জন গ্রাহক সেবা নিতে এসেছিলেন বলে রেজিস্ট্রারে দেখা যায়।
পাসপোর্ট কার্যালয়ের সামনে কথা হয় গ্রিস প্রবাসী জান্নাত ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, ১৫ জুলাই পাসপোর্টের নাম সংশোধনের জন্য আবেদন করেছিলেন তিনি। তাকে ‘এক্সপ্রেস ডেলিভারির’ মাধ্যমে পাসপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল। বৃহস্পতিবার তার পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার কথা। কিন্তু এসে শোনেন, এখানে আগুন দেওয়ার কারণে সব কার্যক্রম বন্ধ।
তিনি বলছিলেন, “আমার গ্রিসের সিটিজেনশিপ আছে। কিন্তু কিছু কাগজপত্রের জটিলতার কারণে আমি দেশে এসেছি। এগুলো শেষ করে আবার এই মাসের মধ্যেই গ্রিসে ফেরার কথা ছিল। এখন তো আমি ঝামেলায় পড়ে গেলাম। দেখি, এখন হেড অফিসে যাবো, সেখানে কোনো সমাধান পাই কিনা। নাহলে আমার সিটিজেনশিপ বাতিল হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।”
নারায়ণগঞ্জ শহরের নিতাইগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা লোকনাথ রায় তার স্ত্রীর পাসপোর্টের জন্য এসেছিলেন। ১০ জুলাই তার পাসপোর্ট পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি তা পাননি। স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার কথা তার।
লোকনাথ রায় বলেন, “আমার স্ত্রী খুব অসুস্থ। দ্রুততার সঙ্গে তাকে ইন্ডিয়া নিতে হবে। তার (স্ত্রী) পাসপোর্ট না থাকায় নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেছিলাম গত মাসে। এই মাসের ১০ তারিখে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা পাইনি। তারপর কয়েকদিন তো গেলো ঝামেলার মধ্য দিয়ে, এখন এসে শুনি কার্যক্রম বন্ধ।”
পাসপোর্ট কার্যালয়ের টেকনিক্যাল অপারেটর শাহ পরাণ বলেন, “অনেকের পাসপোর্ট রেডি ছিল কিংবা কার্যক্রম চলছিল। কিন্তু সব কিছুই তো পুড়ে গেছে। এখন তো কিছু করা যাচ্ছে না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে সমাধানের ব্যাপারে কাজ করছেন।
“যাদের পাসপোর্ট তৈরি ছিল তাদের পাসপোর্ট নতুন করে ছাপানোর পর হয়তো পার্শ্ববর্তী কোনো জেলা অফিস থেকে বিতরণ করা হবে। আর যারা নতুন পাসপোর্ট করতে চাচ্ছেন তাদেরও পার্শ্ববর্তী জেলা অফিসে যোগাযোগ করতে বলছি আমরা।”
এদিকে উপ-পরিচালক মাহমুদুল হাসান বলেন, “এই অফিস তো এই মুহূর্তে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আমরা বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবছি। সবার দুর্ভোগ লাঘবে কী করা যায় এই বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত দেবেন।”
আরও পড়ুন:
নরসিংদী কারাগার থেকে পালানো আরেক জঙ্গি গ্রেপ্তার
'আরেকটা পুড়ছে, আরেকটা পুড়ছে- বলে উল্লাস করতে থাকে ওরা'
কোটা সংস্কার: নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া রণক্ষেত্র, আহত শতাধিক
কোটা: নারায়ণগঞ্জে পুলিশ-শিক্ষার্থী সংঘর্ষ, শহরে আতঙ্ক
কোটা সংস্কার: ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে শিক্ষার্থীরা, ছাত্রলীগের ধাওয়া