Published : 29 Jul 2024, 09:28 AM
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে উত্তরার হাউজ বিল্ডিং এলাকায় হামলায় নিহত হামিদুল ইসলাম জুয়েলের শরীরের কোনো স্থান অক্ষত ছিল না, রক্তের প্রলেপের ঢাকা পড়েছিল কালসিটে দাগ, মৃত্যুর পরও হামলাকারীরা শুধু লাশটাকে গাছে ঝুলিয়ে বেদম পেটায় বলে অভিযোগ করেছেন তার বাবা।
আশি বছরের বৃদ্ধ গাজীপুর মহানগরীর ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের চান্দরা গ্রামের কৃষক বারেক মোল্লা বলছিলেন, ১৯ জুলাই উত্তরার আধুনিক হাসপাতালে গিয়ে ছেলের লাশ দেখে তিনি আঁতকে ওঠেছিলেন।
“কী যে বীভৎস! কোনোমতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না এ আমার জুয়েল। মানুষ মানুষকে এভাবে মারতে পারে? শরীরের এমন কোনো জায়গা বাকি ছিল না যেখানে আঘাত আর ক্ষত ছিল না।”
বেঁচে থাকতে থাকতে ছেলে জুয়েলের হত্যাকারীদের বিচার যেন দেখে যেতে পারেন এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন বারেক মোল্লা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং আশপাশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা স্বতস্ফূর্তভাবে যোগ দেয়। আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইলসহ আশপাশের মূল সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানচলাচল বন্ধ থাকে। এ সময় রেলপথ অবরোধ করে গাড়ি আটকে রাখার ঘটনাও ঘটে।
এসব কর্মসূচির সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। তবে বড় ধরনের হামলা ও সহিংতার ঘটনা ঘটতে শুরু করে বৃহস্পতিবার থেকে। শুক্রবার সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনা মাত্রা ছাড়ায়। বিআরটিএ প্রকল্পে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। এই অবস্থায় গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের সব তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আন্দোলনের মধ্যে শুক্রবার দুপুরে ঢাকায় আওয়ামী লীগের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গাড়িবহর নিয়ে রওনা দেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। সেই বহরে ছিলেন জুয়েল (৩৫)। তিনি জাহাঙ্গীরের একান্ত সহকারী (পিএস) হিসেবে পরিচিত ছিলেন। টুকটাক ঠিকাদারী করতেন বলেও পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন।
সেদিন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটে। তার মাথায় আঘাত করা হয়। মাথায় ১৭টি সেলাই দেওয়ার পর তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি স্থিতিশীল আছেন বলে আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন।
এই হামলার সময় সেখানে একজন স্থানীয় সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “জাহাঙ্গীরের পিএস জুয়েল মোল্লাকে মারধর করে গুরুতর আহত করে হামলাকারীরা। তাকে উদ্ধার করে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে আবার তার উপর হামলা হয়। একপর্যায়ে তাকে গাছে ঝুলিয়েও পেটানো হয়।
“এ বীভৎস্য দৃশ্য দেখার মত না। কোনো সাংবাদিককে তখন ছবি তুলতে দেওয়া হয়নি।”
পরিবারের সদস্যরা জানান, দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে জুয়েল ছিলেন মেজ। টঙ্গী কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করে রাজনীতিতে সময় দিতেন। প্রায় আট বছর আগে জুয়েলের মা মারা যান। দুই বোন স্বামীর সংসারে। বাড়িতে টিনের একটি ঘরে জুয়েল তার বাবাকে নিয়ে থাকতেন।
জুয়েলই ছিল বারেক মোল্লার একমাত্র অবলম্বন। স্নান, খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে বাবার সবকিছু দেখতেন তিনি। পৈত্রিকভাবে কিছু জমি-জিরাত থাকলেও জুয়েলের আয় ছিল সংসারের মূল উপার্জন। জুয়েলকে বিয়ে করানোর কথা ভাবছিল পরিবার।
জুয়েলের চাচা আব্দুল খালেক বলেন, “একমাত্র ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই বোন ফাতিমা আক্তার রোজিনা বার বার মূর্চ্ছা যাচ্ছেন, জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। বাবা বারেক মোল্লাও পাগলপ্রায়। তিনি এখন বয়সের ভারে ন্যূজ্ব। এখন কাজও করতে পারেন না, শরীরে ভর করেছে নানা অসুখ। আগে স্ত্রী তাকে দেখাশোনা করতেন। এখন ছেলেই সবকিছু করত।”
বারেক মোল্লা স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছেলে জুয়েল মোল্লাও কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
পরিবার জানায়, প্রতিদিনের মতো ১৯ জুলাই সকালে বাবার আগেই ঘুম থেকে উঠে রান্না করা, কাপড় ধুয়াসহ যাবতীয় কাজ শেষ করেন জুয়েল। পরে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যান। কথা ছিল, নামাজ শেষে বাড়িতে এসে বাবা-ছেলে একসঙ্গে খাবেন।
নামাজ শেষ হওয়ার পর মসজিদ চত্বরেই জুয়েলের মোবাইলে একটি কল আসে; ঢাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে লোকজন নিয়ে যেতে হবে। তখন বাবাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে জুয়েল গাজীপুরে জাহাঙ্গীর আলমের বাসায় চলে যান। দুপুরের খাবার আর খাওয়া হয়নি তার।
বিকালে বারেক মোল্লার মোবাইলে ছেলেকে হত্যার খবর আসে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জ্ঞান হারান। পরে পরিবারের লোকজন তাকে সুস্থ করে তুলেন। সড়ক অবরোধ, সংঘর্ষ আর সহিংসতার কারণে তখন সব ধরনের পরিবহন বন্ধ। এই অবস্থার মধ্যেই পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়রা একটি অটোরিকশা নিয়ে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন লাশ মর্গে পড়ে আছে। জুয়েলকে পরে বাড়ি এনে দাফন করা হয়।
রোববার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটি টিনের প্রাচীরে ঘেরা। একেবারে সুনসান। উঠানের একপাশে আম গাছের নিচে জুয়েলের কবর। উঠানে বসে সেই কবরের দিকে চেয়ে ছিলেন বারেক মোল্লা।
তিনি বলছিলেন, “জুয়েল সবসময় জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে থাকত। দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিত। তাকে খুব স্নেহ করত। নেতাকে বাঁচাতে গিয়ে আমার ছেলে নিজেই চলে গেল।”
সিঙ্গাপুর থেকে জাহাঙ্গীর আলমও খোঁজ-খবর নিয়েছেন। গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেলও বাড়ি এসে খোঁজ নিয়ে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানান বারেক মোল্লা।
তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “ছেলে হারানোর পর এক সপ্তাহের বেশি হলো, মনে হচ্ছে যেন কয়েক যুগ। নিজ হাতে আমারে খাওয়ায়ে দিত। কিছুক্ষণ পর পর ফোনে খোঁজ নিত। এখন তো কেউ আর ফোনে জিগায় না, বাবা কী করছ?”
জুয়েলের চাচা আব্দুল খালেক বলেন, “বর্বর হামলার পর মারাত্মক আহত জুয়েলের চিকিৎসার জন্য স্থানীয় হাসপাতালে পাঠালে কতিপয় অস্ত্রধারী হাসপাতালে জাহাঙ্গীরের লোকদের খুঁজতে থাকে। পরে অস্ত্রের মুখে জুয়েলকে হাসপাতাল থেকে পাশের বটগাছে ঝুলিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে। পরে পুলিশ সেখান থেকে জুয়েলের লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে রাখে।
“মরদেহ আনার সময় শতাধিক লোক জাহাঙ্গীরের লোকের লাশ কিনা জিজ্ঞাসা করতে থাকে। কিন্তু জুয়েলের পরিচয় গোপন করেই লাশটি হাসপাতাল থেকে আনতে হয়েছে। কেন কী অপরাধ ছিল আমার ভাতিজার। কেন তাকে এভাবে হত্যা করা হল?”
গাজীপুর মহানগরের গাছা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন বলেন, “জুয়েল এলাকায় খুব ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিল। আমাদের যুবলীগের একনিষ্ঠ কর্মী। তার মৃত্যুতে এলাকার সবাই শোকাহত। আমাদের দাবি, এ ঘটনার দ্রুত বিচার যেন হয়।”
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (উত্তরা জোন) সুমন কর বলেন, জুয়েল নিহতের ঘটনায় এখনও কোনো মামলা হয়নি।
আরও পড়ুন:
‘লাঠি ফেলে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সেলফি’, তারপরই হামলা, সিঙ্গাপুরে কেমন আছেন