বাংলাদেশে রোজায় সোজা থাকাটা কঠিন। কিন্তু জার্মানিতে ইহা ভাসাগেলেগটেরাইস আই মিন পান্তাভাত।
জার্মান জীবনের সবে তিনমাস। সংযমের অস্তিত্ব আমি প্রথম টের পাই আমার পেটে। দেশ থেকে জমিয়ে আনা ভুড়ি প্রায় নাই নাই। জাতিতে মধ্যবিত্ত। তাই খুঁজে খাবার অভ্যাস নাই। কেউ জোরাজুরি করে কিছু খেতে বলছে?
মনে মনে ভাবি- ‘আরেকবার সাধিলেই খাইবো।’ ওই আরেকবারটাই কেউ সাধে না এখানে।
এখানে খাবারের দাম কম। কিন্তু কিনতে গেলে আরেক বিপদ। মাথার মধ্যে সারাক্ষণই ইউরো টু টাকার ক্যালকুলেটর। একটা ক্র্যাকার্স- সোজা বাংলায় নোনতা বিস্কুট। দাম ৬৯ সেন্টস। প্রায় পঞ্চাশ টাকা!!!
এই টাকায় তো মোটামুটি একবেলা ভাত খাওয়া যায়। থাক ভাই। বন্যেরা বনে সুন্দর ক্র্যাকার্সরা দোকানের শেলফে।
আমাকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিলেন স্টিভ জবস। ওস্তাদের দেখানো রাস্তায় আমি ফ্রি ফ্রি খাবার খুঁজে পেলাম। ওস্তাদ সপ্তাহে একবেলা ফ্রি খাওয়ার জন্য মাইলের পর মাইল হেঁটে মন্দিরে যেতেন। আর আমার ডর্মিটরির পাশেই গির্জা।
আর যায় কই.. প্রতি শনিবারে সেখানে ‘পটলাক’ হয়, মানে জনে জনে প্রতিজন একটা করে পদের খাবার নিয়ে আসে... সেটা সবাই মিলে খায়। আমি এটা জানতাম না।
পেটে ভয়ঙ্কর ক্ষুধা। প্রার্থনার প্রায় শেষদিকে খুব ভদ্রলোকের মতোই সেখানে গেলাম। সবাই খাবার আগে বিড়বিড় করে প্রার্থনা করে। আমিও করলাম। নুন খাই যার, বিড়বিড় করি তার।
কিন্তু নিজের ভেতর ‘বুভুক্ষু’রে বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারলাম না। লাফ দিয়া জার্মানদের সামনে বের হয়া আসলো।
মার্সেল জিজ্ঞেস করলো, “আমি ভাত নিয়া আসছি। বুন্ডু তুমি কি নিয়া আসছো?”
আমি ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
মনে মনে বললাম-‘তোর বুন্ডুর খ্যাতায় আগুন’; ও বুঝে গেলো।
বললো, “শুনো এখানে তো খাবার নিয়ে আসতে হয়। পরেরবার ভাত নিয়া আসবা এক্কেবারে সোজা।”
আমি তখন চুপসানো বেলুন। কিছুক্ষণ পর পেলাম থমাসরে। সে মিটিমিটি হাসে।
বলে- “গুল্লি মারো মার্সেলের ভাতরে। ৯০ সেন্টস দিয়া একটা জুসের বোতল কিনবা। সেটারে বগলদাবা করে এখানে চলে আসবা। যাবার সময় আস্তে করে চার-পাঁচটা বোতল নিয়ে চলে যাবা।
“বোতল জমা দিলে পাবা এক ইউরো।”
‘কৈ এর তেলে কৈ ভাজা’র উপর যে শুধুই বাঙালির কপিরাইট নাই, সেটা আমি টের পেলাম। এই হলো জার্মান সংযম।
বলে নেই- জার্মানিতে খালি বোতল সুপার স্টোরে জমা দিলে প্রতি বোতলে ২৫ সেন্টস করে পাওয়া যায়।
রোজার পুরোটাই এখানে ‘সামার’। ‘সামার’ না বলে বলা উচিত কামার। গরমে নিজেকে মনে হয় কামার। হাপরের পাশে বসে লাল লোহার টুকরা পেটাচ্ছি। দেশে গরম পরে। গরীব বাঁচতে চাইলে মার্কেটগুলোতে এসির হাওয়া খাইতে যাইতে পারে।
এখানে কোথাও এসি নাই। এসির শাখা-প্রশাখাও নাই। গরম বেশি? একটা প্রায় ‘নাই নাই’ প্যান্ট আর উদাম গায়ে চলে যাও লেইকে।
সাঁতরাও আর রমণীরূপে কাঁতরাও। সামারে চোখের সংযম করাটা একটা বিশাল বিপজ্জনক টাস্ক ইউরোপে। এই সবের ভেতরেও আমার কোনো কোনো বন্ধু প্রায় ১৯ ঘণ্টা রোজা রাখে।
আপনি কি রোজা?- এটা রোজার দিনে বাংলাদেশে কমন প্রশ্ন। উত্তরে একটু উদাস হয়ে বলতে হতো- কি মনে হয়? এখানে কেউ রোজা রেখেছি কিনা জিজ্ঞেস করলে.. আমিও...
ঈদের আগের দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজ। সেদিনও একটা ‘পটলাক’ ছিলো। সন্ধ্যায়।
আমি যাবো না। কালকে ঈদ। ভাবলাম একদিন আগের রান্না করা তেহারি দিয়ে ঈদ চালিয়ে দিবো। এই ভেবে কিছু জার্মান খটমট ব্রেড পেটে চালান করে দিলাম ঘুম।
পরের দিন। মানে ঈদের দিন ক্লাস সাবমিশন। বিকালে ক্লাস। পেটে তেহারির ক্ষুধা নিয়ে কিচেনে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার তেহারি নাই। নাইতো নাই ! তেহারির নাম গন্ধও নাই।
কী আর করা! আবার ‘ব্রেড অ্যান্ড বাটার’ পেটে গুঁজে জার্মান সেজে ক্লাসে চলে গেলাম।
ক্লাসের পোলাপানের দেখি বেশ হাসিহাসি মুখ। কেউ একজন তেহারির প্রশংসা না করে আর থাকতে পারলো না। বুঝলাম এটা থমাসের কাজ। ব্যাটারে পাকড়াও করলাম।
সে বলে- “কাল সন্ধ্যায় মেনসা (ক্যান্টিন) একটু আগেভাগেই বন্ধ হয়ে গেলো..তাই পটলাকে নিয়ে যাবার জন্য জুস কিনতে পারি নাই।
“পরে ফ্রিজে দেখি তোমার তেহারি..তাই ভাবলাম...”
আমি বললাম- থাক।
বুকে তেহারিচাপা কষ্ট নিয়ে ৫০ইউরো দিয়ে পুরানা একখানা ছোট্ট ফ্রিজ কিনে ফেললাম সেই সপ্তাহে। নে ব্যাটারা এইবার চুরি কর আমার তেহারি।
ঈদের দিন আপনার ক্লাস আছে। থাকতেই পারে। কাজ আছে। এটা কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই আপনার মুরিদদের বোঝানো যাবে না।
তাই সন্ধ্যায় মুগ ডালের খিচুরি আর ডিম ভুনা করতে হলো। সাথে আলু ভর্তা। আলু ভর্তার শেষ পেয়াঁজটুকু আর খিচুড়ির শেষ ডালের কণাটুকুও রেহাই পেলো না। এই ছিলো বিদেশে প্রথম ঈদ।
এখানে ঈদের মূল আনন্দ ঈদের জামাতে। নর-নারী সবাই মিলেমিশে মসজিদে ঈদের নামাজ পরে। বার্লিনে তো কিছুদিন আগে চালু হয়েছে ‘সেকুলার মসজিদ’।
এই মসজিদে নারী-পুরুষ-শিয়া-সুন্নি-স্ট্রেইট-হোমোসেক্সুয়াল সবাই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে।
নারী-পুরুষের নামাজের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নাই। এটা একটা ‘সেকুলার মসজিদ’। বার্লিনের দেখাদেখি নরওয়েও এরকম মসজিদ বানাবে।
নামাজের পর সবাই দলবেঁধে এরওর বাসায় খেতে যায়। এই কালচারটাই আসল ঈদের কালচার। যা দেশে নাই কিন্তু বিদেশে আছে।
আগে আমরা মহল্লায় দলবেঁধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেমাই-পোলাও খেতাম। যে বাসায় কোনদিনও যাওয়া হয় নাই সে বাসাতেও যেতাম। কিন্তু এখন তো এসব চিন্তাও করা যায় না।
অথচ বিদেশে দিব্যি চেনা নাই জানা নাই ‘আজকে ঈদ’- এই উছিলায় অপরিচিতের বাসায় গিয়ে ইচ্ছামতো পোলাও-কোর্মা খেয়েছি, আবার বাক্সভরে নিয়েও এসেছি।
আসলে আনন্দ নিয়ে লেখা লম্বা করতে নাই। বিষাদ নিয়ে মাইলের পর মাইল কলম ছোটানো যায়।
তবে যারা এই লেখাটার এই পর্যন্ত পড়েছেন তাদের কাছে একটা অনুরোধ- এই ঈদে অন্তত একজন অপরিচিতের বাসায় যাবেন। গিয়ে বলবেন- আজকে তো ঈদ তাই আনন্দ ভাগাভাগি করতে এসেছি। এখন এক বাটি সেমাই নিয়ে আসেন।
বাজি ধরে বলতে পারি জীবনের অনেক সেরার একটা সেরা ঈদ হবে এটা। আর যদি কেউ মাইর খান সেই দায় আপনার নিজের। তবে যাই ঘটুক কাইন্ডলি জানাবেন।
ঈদে আর বাকি থাকে কী? ও হ্যাঁ, সেলামি। সেটাই একবার পেয়েছিলাম। ঈদের দিন কয়েক আগের ঘটনা।
একদিন দেখি আমার লেটার বক্সে ২০ ইউরোর একটা নোট। আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম।
ভাবলাম- কেউ কি আমার সততার পরীক্ষা নিচ্ছে? গেলাম ইউনিভাসর্র্টির অ্যাডমিনের কাছে। সে বললো-চিন্তার কিছু নাই। এটা পাশের ওল্ড হোমের বুড়ো-বুড়িদের কাজ। এরা প্রায়ই র্যান্ডমলি বিভিন্ন স্টুডেন্টদের ‘লেটার বক্সে’ চুপিচুপি টাকা রেখে যায়। আমি আনন্দে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। হাউ কিউট..
ও হ্যাঁ, ঈদের এতো এতো আনন্দ। এতো এতো পয়সা খরচ। তবুও যদি একটা কিছু রাঙামাটির পাহাড় ধসের শিকার মানুষদের জন্য করতে পারেন তবে সেই আনন্দ হবে পাহাড়ের সমান।
আর আমার মতো অনেকের কাছেই লোকে জানতে চায় বিদেশে ঈদের ফিলিংস কেমন? ইহা একটি আবগারি প্রশ্ন।
উত্তর : বিদেশের ঈদ পাগলের সুখের মতো। পুরাই মনেমনে। মনে করেন- যে আজকে ঈদ। দ্যাটস ইট।
সবার জীবন এই পৃথিবীর সমান আনন্দের হোক।সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।
লেখক: গবেষণা আর লেখালেখির চেষ্টা করেন ।
লেখক:
গবেষণা আর লেখালেখির চেষ্টা করেন।
লেখকের ই-মেইল: kurchiphool@gmail.com
ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক নিজে এবং ইন্টারনেট
রিনভী তুষারের আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |