-কাকো সি? দোবরো, দোবরো?
জ্বী আপনাকেই বলছি। মানে- কেমন আছেন? ভালো? ক্রোয়েশিয়ার ভাষা। বসন্ত আর ভালোবাসা দিবসের ভারে ভালো না থেকে কই যাবেন?
তারাশঙ্করের কবি’তে কবি নিতাই আক্ষেপ করে বলেছিলো- হায় জীবন এতো ছোট কেনে?
এই ছোট্ট জীবনে এতো এতো খাবার আছে। এতো এতো যাবার আছে। এতো এতো ঘোরার আছে। এতো এতো দেখার আছে। শেখার আছে। কয়েকটা জীবন তো লাগবেই এসব করতে।
এসবই আমার ক্রোয়েশিয়ায় একমাস থাকার উপলব্ধি।
আসেন, চট করে ক্রোয়েশিয়া নিয়ে জ্ঞান জাহিরের পর্বটা সেরে ফেলি।
এই দেশেই প্রথম ‘নেক টাই’ আবিষ্কার করা হয়। নেক টাইকে ‘ক্রাভাট’ বলে ডাকা হতো। বুঝতেই পারছেন, ‘ক্রাভাট’ এসেছে ‘ক্রোয়াট’ থেকে। তো ঘটনা সেই সতেরশ’ শতাব্দীর। ইউরোপের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধ ‘ত্রিশ বছরের যুদ্ধ’ চলছে তখন। ক্রোয়েশিয়ান মার্সিনারি বা পেশাদার সৈনিকরা যুদ্ধ করতো ফরাসিদের হয়ে। নিজেদের ভাব বজায় রাখার জন্য তারা গলায় টাই বাঁধতো। সেই থেকেই নেক টাইয়ের চল শুরু।
ক্রোয়েশিনারা যথেষ্ট প্রকৃতি প্রেমিক। এদের মুদ্রার নাম ‘কুনা’। কুনা হচ্ছে এক ধরনের নকুল বা বেজি জাতীয় প্রাণি। মুদ্রার ছোট ভাই মানে পয়সার নাম হচ্ছে ‘লিপা’। লিপা হলো এক ধরনের লাইম গাছ।
ক্রোয়েশিয়ানরা দাবি করে, তারা প্যারাশুটেরও আবিষ্কারক। এ বিষয় নিয়ে খানিকটা বির্তক আছে। তবে ডালমেশিয়ান কুকুর আর দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ট্রাফল যে ক্রোয়েশিয়ায় মেলে- এই বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই।
নিশ্চয়ই ভাবছেন হঠাৎ ক্রোয়েশিয়ায় কেন?
অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা নামে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে মহামূল্যবান একটি সাবজেক্ট আছে। এর মূলেই হলো গবেষণা। একদম হাতে-মাঠে-কাগজে-কলমে গবেষণা করতে হয়। গবেষণার জন্য আমরা বেছে নিয়েছিলাম রোমাদের। এদেরকে পূর্ব-ইউরোপে বলা হয় ‘জিপসি’ বা ‘যাযাবর’। সেজন্যই প্রায় এক মাস ছিলাম সেখানে।
জার্মানি থেকে ক্রোয়েশিয়া গাড়িতেই যাওয়া যায়। পথে অস্ট্রিয়া, স্লোভেনিয়া পাড়ি দিতে হয়। প্রায় ১০-১২ ঘণ্টার জার্নি।
সক্কাল সক্কাল রিপোর্টিং। সারা রাত ধরে এটা-সেটা গোছালাম। সকাল ৭টায় গাড়ি ছাড়বে। অ্যালার্ম সেট সকাল ৫টায়, সাড়ে ৫টায় এবং সর্বশেষ ৬টায়। এতো সাবধানতার ফলাফল?
বাসে ওঠার সময় ঘটলো অদ্ভুত ঘটনা। আমি কাউকে না দেখলেও সবাই আমাকে দেখছিলো। আমার ব্যাকপ্যাকের পকেট থেকে পাসপোর্ট পড়ে গেলো।
একজন স্টুডেন্ট জানতে চাইলো- তুমি পাসপোর্ট কেন নিয়ে আসছো?
আমি বললাম- বার্লিন টু মিউনিখ তো আর যাচ্ছি না। যাচ্ছি ক্রোয়েশিয়া। সো পাসপোর্ট মাস্ট।
সে বললো- অ্যা! বলো কি? আমি তো পাসপোর্ট আনি নাই!
এরপর জিজ্ঞেস করে জানা গেলো, বেশিরভাগ স্টুডেন্টই পাসপোর্ট আনে নাই। প্রফেসরের আমার উপর গজানো রাগ গিয়ে পড়লো ওদের ওপর।
যারা পাসপোর্ট আনেনি তারা যার যার ঘরে ফেরত গেলো পাসপোর্ট আনতে। আমি আরাম করে নাস্তা সারলাম। সুন্দর করে ব্যাগ গোছালাম। খালি বাসে ঘুরে ঘুরে বেস্ট সিটটা বের করে গা এলিয়ে বসলাম। প্রফেসর সকালে দেওয়া বকা ধন্যবাদে বদলে দিলেন।
আরও প্রায় এক ঘণ্টা দেরি করে জার্নি শুরু করলাম। ড্রাইভারের পাশে সিট। বেচারা আবার আমাদের মতোই স্টুডেন্ট। সে গল্প করতে চায়। আমি চাই ঘুমাতে।
ড্রাইভার জানতে চাইলো- বিষয় কি? তুমি এতো ঘুমাও কেন?
: কেন?
: কেন? রাস্তা হলো আমাদের দেশে। কিছুটা স্থল, কিছুটা জল। তোমাদের রাস্তার দুই পাশে সাউন্ড আটকানোর বেড়া। রাস্তার গাড়ি ছাড়া কোনও কিছুই চোখে পড়ে না। আমাদের দেশে হাইওয়ের উপর ধান শুকানো হয়। গোবর শুকানো হয়। রাস্তার উপর বাজার বসে। বিশাল গরু-ছাগলের হাট বসে। পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে গাড়ির ড্রাইভারকে সিদ্বান্ত নিতে হয়- কারে বাঁচাবে, মানুষ না গরু! চ্যালেঞ্জই চ্যালেঞ্জ। বিনোদন আর বিনোদন। তোমাদের এটা কোনও হাইওয়ে হইলো?
এমনসব আজাইরা জ্ঞান বিলাতে বিলাতে পৌঁছে গেলাম অস্ট্রিয়া। অস্ট্রিয়া অদ্ভুত এক দেশ। ওদের হাইওয়েতে মাইলের পর মাইল জুড়ে বিশাল বিশাল টানেল। কারণ কী জানতে চান?
কারণ হলো পাহাড়। ওরা পাহাড়ের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করে রাস্তা নিয়ে গেছে। কিন্তু সিকি পরিমাণ পাহাড়ও কাটেনি। ওরা পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, বন-জঙ্গলকে শত্রু মনে করে না।
একটানা বিরক্তিকর গাড়িতে গড়াতে গড়াতে পৌঁছে গেলাম ডোনাল্ড ট্রাম্পের শ্বশুরবাড়ি। স্লোভেনিয়া। সেখানে নামলাম। মানুষ ছাড়া আমাদের বাসের ওজন মাপা হলো। রাস্তা ব্যবহারের জন্য আমাদের টোল দিতে হলো।
শেষমেষ পৌঁছালাম ক্রোয়েশিয়া- স্লোভেনিয়া বর্ডারে। এখানেই বাঁধলো যতো গণ্ডগোল। ক্রোয়েশিয়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে নতুন যোগ দেওয়া দেশ। এখনও ওদের বর্ডার পুলিশ খানিকটা কনফিউজড। আমাদের গাড়িতে জার্মান ফ্ল্যাগ। কিন্তু তারপরও কোনও খাতির নাই। গাড়ি সাইড করে পার্ক করা হলো।
একটা নদী পার হলেই ক্রোয়েশিয়া। পাসপোর্ট জমা দিতে হয়েছে। আমরা নদীর পাড়ে বসে বসে তিন গুটি খেলছি। প্রায় চার ঘণ্টা হয়ে গেছে। কিন্ত আমাদের ছাড়ার কোনও নাম-গন্ধ নাই।
আমি আর আমার আমেরিকান বন্ধু ডানিয়েল। মানিক- জোড়। আমরা বর্ডার পুলিশের সাথে আলাপ জুড়ে দিলাম। আলাপ করতে করতে ওদের কন্ট্রোল রুমে গেলাম। গিয়ে দেখি- ওরা ইন্টারনেটে মায়ানমার নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে। যেন সামনে এদের ভূগোল পরীক্ষা।
আমি বললাম- বাংলাদেশ চেনো?
: চিনি।
: কী করে চেনো?
: রানা প্লাজা। জামা-কাপড়ের গায়ে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’- এসব দেখে আমরা বাংলাদেশ চিনি।
বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের জন্য শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে আসলো। বাংলাদেশের নাম পৃথিবীর আনাচে-কানাচে পৌঁছে দেওয়ার সব কৃতিত্ত্ব পোশাক শ্রমিক বোন-ভাইদের।
প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টায় অন্তত তিনশ’ রাউন্ড তিন গুটি খেললাম। আর কেউ কেউ নদীর ঢেউ গুণলো। এসব শেষে আমাদের ক্রোয়েশিয়ায় ঢুকতে দেওয়া হলো।
আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছে স্টুডেন্ট ডর্মে। পই পই করে বলা হয়েছে- ছেলে আর মেয়ে, জল আর তেল- এসব মেশানোর যাতে চেষ্টা না করা হয়। মানে গার্লস ডর্মে ‘নো এন্ট্রি’। আমাদের দলের কাপলরা এই ঘোষণায় মহা বিরক্ত। ক্রোয়েশিয়া এখনও আনস্মার্ট রয়ে গেছে। আমরা সিঙ্গেলরা এই ভেবে প্রমাদ গুণলাম। কিন্তু এখানে রাতের বেলা- যাহাই তৈল তাহাই জৈল।
প্রথম দিন আমরা রেস্ট নিলাম। তারপরের দিনও রেস্ট। টুকটাক কেনাকাটা। রমণীমোহন ডানিয়েল শপিং-এ গেলো সানগ্লাস কিনতে। ফিরলো গাড়িসহ এক মেয়েকে পটিয়ে। সেই মেয়ের গাড়িতে চড়ে আমরা রাতের অভিযানে বের হতাম।
টুকটাক ক্লাস, ঘোরাফেরা- এই চলছিলো। একদিন গেলাম পেইন্ট বল খেলতে। দুই পায়ে তিন গুলি খেয়ে রুমে ফিরলাম।
আমরা প্রথমে যে শহরে উঠেছিলাম তার নাম- মারুসাভিচ। কিছুদিন পর গেলাম রাজধানী জাগরেব-এ। জাগরেব অনেক পুরনো শহর। সেখানের মানুষজন খুবই নির্ভার। এক ক্যাফেতে লেখা- “জীবন অনিশ্চিত, তাই আগে মিষ্টি খান।”
ক্রোয়েশিয়ায় অসংখ্য পরিত্যক্ত দূর্গ আছে। কেউ থাকে না সেখানে। এক মাস ধরে প্রায় প্রতিদিনই একটা নতুন দূর্গ ঘুরেছি। তবু সিকি ভাগও দেখে শেষ করতে পারি নাই।
ক্রোয়েশিয়ার সমুদ্রের বিষয়ে আমি কিছুই লিখব না। এটা আমি আগেই ঠিক করে রেখেছি। কিছু সুন্দর চোখের দেখা দেখতে হয়। দেখা না হলেও সমস্যা নাই। মৃত্যুর সময় অন্তত আফসোস করতে পারবেন। হায় রে, ক্রোয়েশিয়া না দেখে মরে যাচ্ছি!
সুন্দরের সবচেয়ে বড় গুণ কী জানেন? সুন্দরের কোন বর্ণনাই সুন্দর হয় না। আর যদি সেই বর্ণনা লিখতে বসে আমার মতো এঁচোড়, তবে তো আর কথাই নাই।
শেষ করার আগে আবারও ইট্টুসখানি জ্ঞান দেই। ক্রোয়েশিয়ানরা কিন্তু ক্রোয়েশিয়াকে ‘ক্রোয়েশিয়া’ বলে ডাকে না। ওরা নিজেদের দেশকে ডাকে ‘হারভাতসকা’ বলে।
আমার ক্রোয়েশিয়া দেখা আসলে মানুষ দেখার মধ্যেই সীমিত ছিলো। কয়েকশ’ বছর ধরে যাযাবর নাম নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষ। আমার এই পর্বে আমি তাই তেমন কিছুই লিখতে পারছি না। কারণ বার বার সেইসব মানুষেরা চিন্তার মগজে বিরক্ত করে যাচ্ছেন। তাই আগামী সপ্তাহের পুরোটা জুড়েই থাকবে সেই সব মানুষের অবিশ্বাস্য গল্প, ছবি আর ভিডিও।
আমার ধ্যান-জ্ঞান মানুষ। মানুষ ধরো, মানুষ ভজো, শুনো বলিরে পাগল মন।
ফাঁকিবাজি ক্ষমা করবেন।
লেখক: গবেষণা আর লেখালেখির চেষ্টা করেন
লেখকের ই-মেইল: kurchiphool@gmail.com
ফটো ক্রেডিট: ক্যানন ক্যামেরা এবং লেখক নিজে
রিনভী তুষারের আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি, দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com . সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |