বিদেশ ভালো: জার্মান দেশে আত্মহত্যা

কথার ছলে আমরা প্রায় বলি, ‘এখানে তো মরেও শান্তি নাই’। নিজেই নিজেকে মেরে ফেলার জন্যও জার্মানি আদর্শ জায়গা। মরেও শান্তি! কেন?

রিনভী তুষার, জার্মানির বার্লিন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 March 2017, 09:59 AM
Updated : 31 March 2017, 12:27 PM

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ৬১ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেছিলেন। ম্যাক্সিম গোর্কিও চেষ্টা করেছিলেন সার্কাসের বন্দুক দিয়ে নিজেকে মারার। পারেন নাই। গোর্কি ভেবেছিলেন হৃদপিণ্ড শরীরের ডানে থাকে।

নাহ! বিখ্যাত মান্যবরদের আত্মহত্যার গল্প করতে আসি নাই। আত্মহত্যার প্রমোশনও এটা না। তবে বইয়ের প্রোমোশন বলা যেতে পারে। এই বছরই ‘বিদেশ ভালো’র একটা সংকলন বই এর মতো করে প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে। বইয়ে শুধু আমার গল্প থাকবে না। থাকবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পলিসিতে বাদ পরা অনেক অনেক গল্প। আপনিও থাকবেন। থাকবে আমাকে পাঠানো আপনার ই-মেইল। সুতরাং হাত ধুয়ে ই-মেইল করে ফেলুন।

যা বলছিলাম। এখনকার আত্মহত্যা ঠিক কেমন যেন- ধর্মের নামে, জিহাদের নামে, স্বর্গের লোভে। আগের দিনে বিষয়টা এমন ফালতু ছিলো না। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা ঘাটলে আত্মহত্যা ও ইউথেনেসিয়ার অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। তবে আত্মহত্যা ও ইউথেনেসিয়ার মাঝে পার্থক্য আছে। চুপিচুপি বিষ খাওয়া, গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পরা, ট্রেনের নিচে ঝাপ দেওয়া এসব টিপিকাল আত্মহত্যা। ট্রেনের প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি। জার্মানিতে আত্মহত্যা আইনত বৈধ। কিন্তু রেললাইনে নামা বা হাঁটা একেবারেই অবৈধ।

ইউথেনেসিয়া হলো নিজেকে মেরে ফেলার একটা স্বীকৃত উপায়। কারো কারো অসুস্থতা প্রতিনিয়তই মরণ যন্ত্রণার সমান। এমন যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচতে স্বেচ্ছামৃত্যুর নাম ইউথেনেসিয়া। আত্মহত্যার ইতিহাস বেশ পুরনো। প্রাচীন মায়াদের তো আত্মহত্যার দেবীও ছিলো। নাম ছিলো ইক্সট্যাব। মানে ‘দড়ি মানবী‘।

প্রাচীণ গ্রিক দার্শনিক ইসপিউসিপাস এবং ডেমোক্রিটাস নিজেদের হত্যা করেছিলেন। ডেমোক্রিটাসের বয়স ছিলো তখন ৯০ বছর। আত্মহত্যার এই চল তখন থেকেই দার্শনিক এবং পণ্ডিতদের গবেষণার বিষয়।  প্লেটো আত্মহত্যার সমর্থক ছিলেন না। কিন্তু ইউথেনেসিয়াকে সমর্থন করতেন।

ইউথেনেসিয়া একটি গ্রিক শব্দ। আভিধানিক মানে ‘ভালো মৃত্যু’ বা ‘গুড ডেথ’। এটাকে ব্যাথাহীন স্বেচ্ছামৃত্যুও বলা যায়। সে সময় স্বেচ্ছামরণ নিয়ে কারোরই তেমন মাথাব্যাথা ছিলো না। ক্রীতদাস এবং সৈনিক ছাড়া যে কেউ মনের সুখে মরতে এবং নিজেকে মারতে পারতো।

কিন্তু মধ্যযুগে এই চিত্র বদলে গেলো। কেউ আত্মহত্যা করলে তার লাশকে নানাভাবে অপমান করা হতো। চালানো হতো লাশের উপর নির্যাতন। মরেও শান্তি নাই প্রবাদের উত্থান এখান থেকে হলেও হতে পারে। রাস্তার উপর টেনে হিচঁড়ে লাশকে পুঁতে রাখা হতো ক্রসরোডের নিচে। বিশ্বাস করা হতো এই করলে মৃতের ভূতের ভবিষ্যত অন্ধকার থেকে যাবে সারাজীবন। মৃতের পরিবারও রেহাই পেতো না অনেক সময়।

বিলিয়নার অ্যাডলফ মেয়ারকলে রেসেশনর ধাক্কায় বিলিয়ন ইউরো হারিয়ে আত্মহত্যা করেন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় দুই লাখ “বিশেষভাবে শারীরিক দিক দিয়ে সক্ষম” মানুষকে নাজি বাহিনী হত্যা করে। এই হত্যাকে তারা বলেছিলো ইউথেনেসিয়া। এরপর কেটে গেছে বহুদিন। ২০১৫ সালের জুন মাসে জার্মান পার্লামেন্টে পাস হয়েছে অ্যাসিসটেড সুইসাইড আইন। কিন্তু হিটলারিক ঐতিহ্যের জন্য ইউথেনেসিয়া শব্দটি জার্মান সরকার পারতপক্ষে উচ্চারণ করে না।

এই আইনে পরিষ্কার করা হয়েছে কারা কারা কোন অবস্থায় স্বেচ্ছামরণ বরণ করতে পারবে। যারা দীর্ঘদিন শারীরিক যন্ত্রণায় ভুগছেন তারাই পারবেন মরে যেতে। কিন্তু সেই মরণ হতে হবে নিজ হাতেই। কেউ সাহায্য করতে পারবে না। কি? কনফিউজড হয়ে গেলেন? সাহায্য ছাড়া কী করে মরবেন? জার্মানরাও এই বিষয়ে কনফিউজড।

তবে একটা বিষয়ে জার্মানদের কোন কনফিউশন নাই। তা হলো কোনভাবেই কমার্শিয়াল আত্মহত্যা গ্রহণযোগ্য হবে না। মানে কোন কোম্পানি টাকার বিনিময়ে কাউকে ইউথেনেসিয়া সার্ভিস প্রভাইড করতে পারবে না। সুইজারল্যান্ডে তো আত্মহত্যার জন্য কোম্পানি পর্যন্ত আছে। একটা কোম্পানির নামও বেশ বলিহারি, ‘এক্সিট’। ‘এক্সিট’ টাকার বিনিময়ে এই ধরাধাম থেকে মানুষের এক্সিট এনশিওর করে। ভেবে দেখুন তো আপনি গেলেন ‘এক্সিট’র কাছে। উদ্দেশ্য এক্সিট নিবেন।

-ফি কতো?

-শুধু মারা যাওয়া চার হাজার ইউরো।

-মানে?

-মানে! মারা যাবার পর যদি আপনার কবর-টবরও আমাদের দিতে হয় তবে বিল আসবে সাত হাজার ইউরো।

-কীভাবে মারা হবে?

-প্রথমে আপনাকে দেয়া হবে অ্যান্টিমেটিক ড্রাগস। যাতে করে আপনি বমি করতে না পারেন। তারপর এক গ্লাস পানিতে ১৫ গ্রাম পেন্টোবারবিটাল পাউডার। ব্যাস আপানার ‘এক্সিট‘ এবার ঠেকায় কে? 

পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যাকে বাঁচতে হলে পয়সা দিতে হয়। আর কোন প্রাণী জীবন বাঁচাতে পয়সা ব্যয় করে না। এখন মৃত্যুতেও পয়সা খরচ! সুতরাং মরার কি দরকার? ভরপুর বাঁচেন।

জার্মানদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশ উঠতি। ২০০৩ সালে গোটা জার্মানিতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলো ছয় হাজার ৬০০ জন। সেখানে আত্মহত্যা করেছিলেন ১১ হাজার ১৫০ জন। ক্রনিক ডিপ্রেশনই মূলত দায়ী এই আত্মহত্যার পেছনে।

আত্মহত্যার ধরন হিসাবে জার্মানদের পছন্দও মায়াদের মতো। দড়ি। ২০১১ সালে ৪ হাজার ছয়শ’ ৬৪ জন গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেছেন। তারপরেই জার্মানদের পছন্দ ঘুমের বড়ি। অদ্ভুত বিষয় হলো জার্মান পুরুষরাই বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ। এই দিক থেকে নারীরা পিছিয়ে আছে।

পশ্চিম জার্মানির তুলনায় পূর্ব জার্মানিতে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। ২০০৯ সালে জার্মানিতে ঘটে সবচেয়ে করুণ আত্মহত্যার ঘটনা। বিলিয়নার অ্যাডলফ মেয়ারকলে রেসেশনর ধাক্কায় বিলিয়ন ইউরো লস করেন। যদিও তা তেমন কোন ক্ষতি ছিলো না পৃথিবী সেরা এই ধনীর জন্য। পনের বছরের পুরোনো সাইকেল চালাতেন। শীতে চালাতেন তিন বছরের পুরোনো ভক্স ওয়াগন গলফ। নিতান্তই সাধারণ জীবনযাপন।

একদিন কাজ শেষ করে বাসায় ফিরলেন না। বউকে বললেন অফিসে মিটিং আছে। ফিরতে দেরি হবে। বাড়ির কাছেই ট্রেন স্টেশন। চলে গেলেন সেখানে। শীতের সন্ধ্যা গভীর হয়ে যায় পাঁচটা বাজতেই। অপেক্ষা করলেন ট্রেনের জন্য। বউয়ের জন্য রেখে গেলেন এক লাইনের চিঠি – ‘আই অ্যাম সরি’। ৭৪ বছরের জীবন অসহ্য বোধ হলো। পেছনে পরে রইলো নয় বিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি।

এ যেন জীবননান্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন‘ কবিতার সার্থক চরিত্র। যিনি জেনে গেছেন –

“জানি- তবু জানি

নারীর হৃদয়- প্রেম-শিশু-গৃহ- নয় সবখানি;

অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়-

আরো এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে

খেলা করে;

আমাদের ক্লান্ত করে

ক্লান্ত- ক্লান্ত করে;

লাশ কাটা ঘরে

 সেই ক্লান্তি নাই;

তাই

লাশকাটা ঘরে

চিত হ‘য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ‘পরে।”

এরকম মৃত্যু কারোই কাম্য নয়। তবে ইউথেনেসিয়া এখন জার্মানি তো বটেই গোটা ইউরোপে বেশ চালু আছে। ১৯৩৫ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম গঠিত হয় ইউথেনেসিয়া সোসাইটি। সেই সংগঠনের ছাতা এখন ২৫টিরও বেশি দেশে। তাদের রয়েছে ৫২টির মতো সহযোগী সংগঠন।

এবার আত্মহত্যা নিয়ে কিছু অদ্ভুত অনুগল্প শোনাই।

-চীন দেশে প্রতি দুই মিনিটে একজন মানুষ নিজেই নিজেকে হত্যা করেন।

-ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশে প্রতি মিনিটে একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।

-সারা পৃথিবীতে প্রায় ২০০০ মানুষ প্রতিদিন আত্মহত্যা করে।

-ব্যাধির দিক থেকে মানুষ হত্যায় আত্মহত্যার অবস্থান অষ্টম।

-আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটে সোমবারে, সবচেয়ে কম শনিবারে।

-বসন্তকালীন সময় মার্চ-এপ্রিল-মে সাধারণত আত্মহত্যাপ্রবণ মাস। ডিসেম্বর মানে ক্রিসমাস টাইমে এই প্রবণতা কম।

-বৃদ্ধদের আত্মহত্যার প্রবণতা তরুণদের চাইতে ৫০% বেশি।

-এক গবেষণায় দেখা গেছে ফুটবল সমর্থকদের আত্মহত্যার প্রবণতার তাদের সমর্থন করা ক্লাবের সফলতার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল।

-৫% থেকে ১০% আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে পাগলা গারদে।

-মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে তিনগুণ বেশি চেষ্টা করে আত্মহত্যার। কিন্তু ছেলেদের আত্মহত্যায় সফল হবার রেট মেয়েদের তিনগুণ।

-ভারতের হিন্দুকুশ পর্বত এবং দক্ষিণ সাগরবর্তী দ্বীপে আত্মহত্যার প্রবণতা প্রায় নেই বলা যায়।

-১০% থেকে ৩৫% আত্মহত্যাকারী সুইসাইড নোট রেখে যান।

-ধারণা করা হয় প্রায় চার হাজার বছর আগে পৃথিবীর প্রথম সুসাইড নোট লেখেন মিশরের কোন এক ব্যক্তি। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘জীবন মানেই যাতনা মৃত্যুই তার কামনা বাসনা’।

-রাশিয়ার কবি সের্গেই এসেনিন তার শরীরের রক্ত দিয়ে গোটা একটা কবিতা লিখেছিলেন। সেটাই ছিলো তার সুইসাইড নোট।

-ডিভোর্স আত্মহত্যার পেছনে দায়ী অন্যতম একটি কারণ। যদিও গবেষণায় দেখা গেছে ডিভোর্সের পর নারীর তুলনায় পুরুষের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি কাজ করে।

-ফিজি ইন্ডিয়ান নারীদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।

-আত্মহত্যার উপর প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা প্রকাশ করেন এমিল ডুর্খেইম। নাম ‘লে সুইসাইড‘।

এই হলো আত্মহত্যার কড়চা। কেন মানুষ আত্মহত্যা করে? এটা একটা জটিল ধাঁধা। এর উত্তর যারা পেয়ে যান তাদের কারোরই তা অন্যকে জানানোর সুযোগ হয় না। তাই আমরাও জানতে পারি না। ফরাসি দার্শনিক আলবেয়ার কামু বলেছেন- ‘মানুষের বাঁচা যে কারণে, মরাও ঠিক একই কারণে’।

আমার এই গল্প এবং জ্ঞানদান কোন ভাবেই কাউকে মরে যেতে উৎসাহ দেবার জন্য নয়। এখানে একটা কটু গল্প বলি- ১৯৭৮ সালের ১৮ নভেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রের ‘জনতার মন্দির‘ নামে এক ধর্মীয় দলের আধ্যাত্মিক গুরুর নির্দেশে তার ৯১৩ অনুসারী সায়ানাইড মেশানো জুস খেয়ে আত্মহত্যা করে। এর মাঝে ৩০০ জন শিশুও ছিলো। সেই গুরু জিম জোনসও একই বছর মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন।

ধর্মের নামে নিজের জীবন দেয়া এবং নেয়া- এটা ইদনীং কালের কোন ঘটনা না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বোকামির এই সংস্কৃতি চলে আসছে। এর সমসাময়িক মাতলামির আছড় পড়েছে বাংলাদেশে। যারা  এখনও ধর্মের নামে, প্রেমের নামে, অহেতুক আত্মহত্যার নেশায় ঝুঁকছেন তাদের জন্য ‘সোহেইলি’ ভাষায় বলছি ‘মাইশা মাজুরি’। মানে ‘জীবন অনেক সুন্দর’। নিজের এই ফালতু ইচ্ছা চেপে রাখবেন না। কাছের জনকে না পারেন দূরের জনকে বলেন। কাউকে না পারলে আমাকে ই-মেইল করেন। আত্মহত্যাকে না বলেন।

এরপরও যারা জিহাদী জোশে আত্মহত্যা করবেনই ঠিক করছেন তাদের জন্য একটা সত্য ঘটনা বলি- গোল্ডেন গেইট ব্রিজ থেকে ঝাঁপিয়ে পরে একজন আত্মহত্যা করেছিলেন। তার সুইসাইড নোটে লেখা ছিলো- ‘আমি ব্রিজের দিকে যাচ্ছি। যদি একজন অচেনা মানুষও আমার দিকে তাকিয়ে হাসে তাহলে আমি আর ঝাঁপ দিবো না’।

লা ভিদা এস বেললা। লা ভিদা এস পুনিতা। জীবন অনেক সুন্দর।

লেখক: গবেষণা আর লেখালেখির চেষ্টা করেন

লেখকের ই-মেইল: kurchiphool@gmail.com

রিনভী তুষারের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!