বিদেশ ভালো: এক গ্রীষ্মের দাদী

সামারের তিন মাস নাক মুখ গুঁজে কাজ করা যায়। পুরোটাই ট্যাক্স ফ্রি। তাই যেখানেই যাই চাকরির গন্ধ পাই।

রিনভী তুষার, জার্মানির বার্লিন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Dec 2016, 11:02 AM
Updated : 15 Dec 2016, 12:25 PM

একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিন ই-মেইল করলো। বিষয় সামার জব। কাজের ধরন- ওল্ড হোমের এক বৃদ্ধার সাথে গল্প করা। প্রতি ঘণ্টায় ১০ ইউরো বেতন। শর্ত একটাই, জার্মান ভাষা জানতে হবে। আমি সুযোগটা লুফে নিলাম।

নির্দিষ্ট দিন আমি ওল্ড-হোমে হাজির। রিসেপসনিস্ট জানতে চাইলো, কার কাছে যাবো? বললাম, ফ্রাও গেয়ারলাখ। জার্মান ভাষায় মহিলাদের ফ্রাও বলে অ্যাডড্রেস করা হয়।

আমি রুমে পৌঁছেই অপ্রস্তুত। একজন বয়স্ক মহিলা। বিছানায় আধশোয়া। বোঝাই যাচ্ছে, শরীরে বাম পাশ অচল। নিজের পরিচয় দিলাম। আমি ওনার সাথে কথা বলতে এসেছি শুনেই বাচ্চাদের মতো হেসে উঠলেন।

পরিচয় পর্ব শেষ করতেই উনি চাইলেন 'টাসেনটুস' ( মানে টিস্যু পেপার, আমাকে আমার অনেক জার্মান বন্ধু এই নামে ডাকে)। এগিয়ে দিলাম টিস্যু পেপার। প্রথম দিন ইতস্তত গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। অনেক ভেবেও ঠাওর করতে পারলাম না, আমাকে ই-মেইলটা করলো কে? এই বৃদ্ধা যে ই-মেইল করেন নাই, তা শতভাগ নিশ্চিত। ভদ্রতার মাথা খাওয়ার অভ্যাস আমার নাই। তাই চেপে গেলাম।

পরদিন আমার রুমে সকাল সকাল ফোন। কাছের একটা ক্যাফেতে আমার জব ইন্টারভিউ। ধাঁধায় পরে গেলাম। চাকরি হয় নাই এখনো!! অথচ কাজ করা শুরু করে দিয়েছি?

ক্যাফেতে পৌঁছে পেয়ে গেলাম মধ্যবয়স্ক এক কাপলকে। আমাকে কাজ দেবেন ছেলের বউ। যার জন্য কাজ করবো তিনি শাশুড়ি।

সামারে জার্মানরা ছুটি কাটাতে নানা দেশে ঘুরে বেড়ায়। তাদের কারোরই বৃদ্ধাকে দেবার মতো সময় নাই। তাই তাদের একজন মানুষ দরকার। যার কাজ হবে বৃদ্ধার সাথে প্রতিদিন গল্প-গুজব করা। ঘুরে বেড়ানো।

আমার সাথে কথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই জানালেন, আমাকে ওনাদের পছন্দ হয়েছে। আজ থেকে কাজ শুরু।

আমি বললাম, কিন্তু আমি তো কাজ অলরেডি শুরু করে দিয়েছি। উনারা অবাক। বলো কি!

আমি বললাম, হুম। বিশ্বাস না হয় তোমরা শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করো।

অ্যাঙ্গেলা হেসে কুটিকুটি। বললো, আমাদেরই ভুল।

আমি চেপে গেলাম। আসলে ভুল আমারই। চাকরি জোটানোর উত্তেজনায় দিন আর সময় গুলিয়ে ফেলেছিলাম।

প্রথমে জানতে চাওয়া হলো আমি বৃদ্ধাকে কি ডাকবো? আমি কনফিউজড। আমার সাথে ওনারাও কনফিউজড। সমাধান দিলেন বৃদ্ধা নিজেই। বললেন, ও আমাকে 'ওমা' মানে দাদী ডাকবে। আমার পছন্দ হলো।

আমাকে আমার চাকরিতে কী কী করতে হবে বুঝিয়ে দেয়া হলো। নিতান্তই সহজ চাকরি। প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা সময় কাটাতে হবে দাদীর সাথে। নিউজপেপার পড়ে শোনানো। দাদীর সাথে পাশের ক্যাফেতে খেতে যাওয়া। খেলা। গল্প করা।

আমার দাদী প্যারালাইজড। হুইলচেয়ারে চলা-ফেরা। এমনকি বিছানা থেকেও একা নামতে পারে না।

ওল্ডহোমের  ভেতরেই একটা ছোট্ট চিড়িয়াখানা। দাদীর প্রিয় খরগোশ আর মাদী শুকর।  দাদী লুকিয়ে লুকিয়ে খাবার নিয়ে যেতেন সেই মাদী শুকরের জন্য। সেই মাদী শুকরটা দিনের বেলাতেও পড়ে পড়ে ঘুমাতো। বাইরে আসতো না।

কিন্তু আমার দাদী আসলেই হেলে-দুলে বাইরে চলে আসতো। তারপর দাদী সাথে করে আনা খাবার ছুঁড়ে দিতেন। শুকরের আনন্দ নিয়ে খাওয়া দেখে দাদীর চোখ খুশিতে জ্বল জ্বল করতো। কোন কোন দিন আমি আর দাদী পাশের ঘন বনের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম। দাদী রাস্তা পার হতেই চাইতো না।

আমি একদিন রাগ করে বললাম, কেন তুমি রাস্তা পার হতে চাওনা? তোমাকে তো আর হাঁটতে হয় না। তাই না?

দাদী মন খারাপ করে বললেন, রুমে ফিরে চলো। বুঝলাম দাদী কষ্ট পেয়েছেন। ইনিয়ে-বিনিয়ে ক্ষমা চাইলাম। বললাম রাগ কোরো না।

দাদী বললো, নাহ্, রাগ না। আমি রাস্তা পার হতে ভয় পাই। বছর দুয়েক আগের কথা। আমি আর তোমার 'ওপা' (মানে দাদা) এই ওল্ড হোমেই থাকতাম। একই রুমে। একদিন রাস্তা পার হচ্ছিলাম একসাথে। কোথা থেকে এক হোন্ডা এসে অনেক জোরে তোমার দাদাকে ধাক্কা দিলো। তোমার দাদা এইখানেই মারা গেছেন। আমরা কোনদিনও আলাদা থাকিনি। আমার প্লেনে চড়তে ভয় লাগতো। আমার যাওয়া হবে না ভেবে, হাজার ইচ্ছা থাকার পরও তোমার দাদা কোনদিনও আমাকে ছেড়ে দূরে কোথাও যায়নি। তাকে ছাড়া বাঁচতে হবে...মানতে পারিনি। আমার তারপর স্ট্রোক হয়। আমি প্যারালাইজড হয়ে যাই। তুমি সেদিন জানতে চেয়েছিলে আমার একই আঙুলে দুইটা আংটি কেন? একটা আমার আর একটা তোমার দাদার। এরপর আমি কখনোই দাদীকে রাস্তা পার হবার জন্য জোর করিনি।

আমার দাদী অনেক স্টাইলিশ ছিলেন। দাদীর মাথায় চুল খুবই অল্প ছিলো। কিন্তু প্রতিদিন বাইরে ঘুরতে যাবার আগে প্রায় মিনিট দশেক ধরে সেই চুলই বিভিন্ন ঢঙে আঁচড়াতেন। তারপর পরতেন হাল ফ্যাশানের জামা। জ্যাকেট।  জুতা।

একদিন ওল্ড-হোমের সিস্টার বললো, ক্যাফেতে যাওয়া যাবে না। কারণ ক্যাফেতে গেলে দাদী তার প্রিয় অরেঞ্জ কেক খাবে। আর তাতে বেড়ে যাবে রক্তে সুগারের লেভেল। কিন্তু দাদীকে তো সেটা বলা যাবে না।

আমি দাদীকে নিয়ে ঘুরতে বেড়োলাম। দাদী বললো, তুমি কি ক্যাফের রাস্তা ভুলে গেছো? আমি বললাম, না, আজকে ক্যাফেটা বন্ধ।

দাদী বললো, আজকে তো সোমবার। ক্যাফে বন্ধ হবে কেন?

আমি বুঝলাম ধরা পড়ে যাচ্ছি। একটা বুদ্ধি বার করলাম। পথে যাকেই পাবো, তাকে দিয়েই ক্যাফে বন্ধের মিথ্যাটা বলাবো। দাদী তো আর ইংরেজি বোঝে না!

পথে পর পর তিনজনকে পেলাম। তিনজনই আমার ইউনি'র ছাত্রী। তারা দাদীকে ক্যাফে বন্ধ, এটা বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে দিলো। দাদী কিছুটা বিরক্ত।

আমি বললাম, দাদী চলো, তোমাকে আমি যেখানে থাকি সেখানে নিয়ে যাই।

দাদীর বিরক্তি কমলো না। বললো, নাহ্, চলো ঘরে ফিরে যাই।

ফেরার পথে দাদী চুপ। আমি বললাম, দাদী সত্যি সত্যিই কিন্তু ক্যাফেটা বন্ধ।

দাদী বললো, সেটাতো বুঝলাম। কিন্তু তোমার এতো এতো মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব কেন? একজনের সাথে বন্ধুতা করতে পারো না? তাহলে তো আমি তোমার ছেলে-মেয়ের মুখ দেখে মরতে পারি।

আমি বুঝলাম, দেশ ভিন্ন হতে পারে কিন্তু দাদী-নানিদের চাওয়া একই রকম।

এভাবেই জার্মান বৃদ্ধা আমার দাদী হয়ে উঠলেন। আমার যেতে দেরি হলে ফোন। কখনো কখনো রাগ।

দাদীর ফেভারিট ছিলো আলু। কিন্তু আলু ছোলা সমস্যা, তাই ওল্ড-হোমে ভাত বেশি রান্না করা হতো। দাদী কিছুতেই ভাত খেতে চাইতো না। একদিন তো দাদী কিছুতেই দুপুরে খাবে না। জোর করতেই কান্না শুরু। আমি অবাক হয়ে গেলাম! একজন ৭৮ বছরের মানুষ আলুর জন্য কাঁদছে?

পরদিন আমি বাঙালী ঘরানায় আলু ভাজি করে নিয়ে গেলাম। ওল্ড-হোমে বাইরের খাবার আনা নিষেধ। কিন্তু অনেক লুকানোর পরও ধরা পরে গেলাম। সিস্টার আমাকে ধরে নিয়ে গেলো রেসিডেন্সিয়াল মেডিকেল অফিসারের রুমে।

তিনি একজন ডাক্তার। আমার তো ভয়ে জড়োসড়ো অবস্থা। বিস্তারিত কমপ্লেইন শুনে ডাক্তারের রায় দিলেন, যেহেতু দাদী প্যারালাইজড, জীবনের শেষ সময় পার করছেন; যেহেতু ওনার সচল থাকা ইন্দ্রিয়ের মধ্যে একমাত্র জিভই ঠিকঠাক কাজ করে, সেহেতু এতটুকু অনিয়ম করা যেতেই পারে।

তবে শর্ত হলো, এরপর আলু ভাজি করলে সেটা নার্সসহ ডাক্তারকে শেয়ার করতে হবে। মানে আলু ভাজিটা পরিমাণে বেশি করতে হবে। আমার দাদী খুশিতে চিৎকার করে উঠলেন।

বাংলাদেশে বেড়াতে যাব। দাদীকে বললাম, কি আনবো তোমার জন্য? দাদী ডান হাতের রুমাল দিয়ে অনেক কষ্ট করে একটা ব্যাগের মতো বানালেন। বললেন, এই সাইজের একটা ব্যাগ আনবে। ব্যাগে চেইন চাই না। বোতাম চাই। কারণ এক হাতে চেইন টেনে ব্যাগ বন্ধ করা যায় না।

নকশী কাঁথার নকশা করা একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে গিয়েছিলাম দাদীর জন্য। দাদী সবসময় সেই ব্যাগটা কোলে রেখে ঘুরে বেড়াতেন। মানুষজনকে গর্ব করে ব্যাগের গল্প করতেন। আমি ভাবতাম, সামান্য একটা ব্যাগের এতো মন ভালো করা গুণ?

দাদী অসম্ভব পরিষ্কার মানুষ। তার নেশা টিস্যু পেপার কেনা। বাহারি রঙের টিস্যু। গাদা গাদা টিস্যু। ছেলের বউ এসব নিয়ে মহাবিরক্ত। তবে ছেলের বউ শাশুড়িকে বেশ মায়াও করতো।

একটা সামারই কাজ করার কথা ছিলো। নানা কাজের দোহাই। পড়াশোনার চাপ। কোন কিছুতেই দাদীকে ছাড়া হয়ে উঠেনি। কারণ দাদী আমাকে ছাড়বেন না। প্রতি মাসে আলাদা করে গিফট। বেতনের বাইরে পকেট মানি। আর ক্রিসমাস মানেই রাজ্যের দু:খ।

প্রতিবার ক্রিসমাসে আমি একটা গল্পই শুনতাম। আশার গল্প। দাদী ভাবতেন, এইবারের ক্রিসমাসে নিশ্চয়ই সবার সাথে অন্তত একটা রাত তার নিজের বাড়িতে কাটানো হবে। অন্তত একটা রাত!

দাদী বলতো, দেখো, এইবার আমার ছেলে আর অ্যাঙ্গেলা আমাকে ক্রিসমাসে ওদের কাছে নিয়ে যাবে।

আমি জানতাম, তা হবার নয়। সেবার আমার অনেক অনুরোধের পরও ওরা নিতে রাজী হয়নি। ওদের যুক্তি ছিলো, দাদীকে দেখাশোনা করতে গেলে ওদেরই ক্রিসমাস সেলিব্রেট করা হবে না। তাছাড়া ওল্ড-হোমে ক্রিসমাসে অনেক অনুষ্ঠান তো হয়ই।

দাদী মন খারাপ করে থাকতো সেই দিনগুলিতে। জোর করেও রুমের বাইরে নেয়া যেতো না। অনেক সাধার পরও দাদী কারো সাথে খেলতে চাইতো না।

ক্রিসমাসের সপ্তাহ দুয়েক বাকি। দাদী আমার সামনেই ছেলের বউয়ের হাত ধরে কেঁদে দিলেন। বললেন, অন্তত এবারের ক্রিসমাসে আমাকে বাসায় নিয়ে চলো। ছেলের বউ সান্তনা দিলেন। বললেন, সম্ভব না।

আমি কেমন বধির হয়ে গেলাম। চোখের সামনে পৃথিবীটা দুলে উঠলো। এমনিতেই ওল্ড-হোমে মানুষের বুড়িয়ে যাওয়া জীবন দেখার যন্ত্রণা। তার ওপর দাদীর কান্না।

গত বছর ১৯ ডিসেম্বর। ক্রিসমাসের সপ্তাহখানেক আগে। আমার দাদী সব অনুরোধ-উপরোধের উর্ধ্বে চলে গেলেন। ক্রিসমাসে নিজের বাড়িতে ফেরা হলো না। নাতী-নাতনীদের সাথে ক্রিসমাসের কেক কাটা হলো না আর।

তবে দাদী মুক্তি পেয়েছেন। এটা ভেবেই সান্তনা পাই। মানুষটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসতেন। অথচ ঘণ্টার পর ঘণ্টা নোংরা ভরা ডায়াপার নিয়ে শুয়ে থাকতে হতো। পরিষ্কার করার জন্য কাতর কণ্ঠে নার্সদের অনুরোধ করতেন। ছেলে, ছেলের বউকে ফোন করতেন। ভয়েস-মেইলে ম্যাসেজ দিয়ে রাখতেন। কিন্তু কাজ হতো না। মৃত্যুর পর তো আর সেই যন্ত্রণা নাই।

দাদী নাই আজ প্রায় এক বছর। আবার ক্রিসমাস আসছে। অ্যাঙ্গেলা জানতে  চেয়েছে, এবারের ক্রিসমাসে আমার কি চাই? আমি ওর কাছে দাদীকে উপহার দেয়া সেই ছোট্ট ব্যাগখানা চেয়েছি। দাদীর সেই ভালোলাগা ব্যাগখানা থাকলো নাহয় আমার কাছে।

দাদীর সেই পার না হতে চাওয়া রাস্তা ধরে আমি আজো হাঁটি আর আওড়াই-

তোমাদের ব্যস্ত মনে;- তবুও, কিশোর, তুমি নখের আঁচড়ে

যখন এ ঘাস ছিঁড়ে চলে যাবে- যখন মানিকমালা ভোরে

লাল লাল বটফল কামরাঙা কুড়াতে আসিবে এই পথে-

যখন হলুদ বোঁটা শেফালির কোনো এক নরম শরতে

ঝরিবে ঘাসের 'পরে, - শালিখ খঞ্জনা আজ কতদূর ওড়ে-

কতখানি রোদ- মেঘ-টের পাবে শুয়ে শুয়ে মরণের ঘোরে।

দাদী- ইস ফেয়ারমিসে ডিস। দাদী তোমাকে অনেক মনে পড়ে।

লেখক: গবেষণা আর লেখালেখির চেষ্টা করেন। 

লেখকের ই-মেইল: kurchiphool@gmail.com

ছবি কৃতজ্ঞতা: রিনভী তুষার

রিনভী তুষারের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,  দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!