বিদেশ ভালো: মেলায় যাইরে

ক্রিসমাস মানেই একটা দিন, ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যাবেলা। পাঁচ তারকা হোটেলের সাজুগুজু। বিটিভি'র সেকুলার সাজা টিভি অনুষ্ঠান। এই তো জানতাম!

রিনভী তুষার, জার্মানির বার্লিন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Dec 2016, 12:09 PM
Updated : 21 Dec 2016, 12:19 PM

কিন্তু জার্মানিতে ক্রিসমাস মানে ক্রিসমাস মার্কেট। মার্কেট বা বাজার না বলে মেলা বলাই ভালো।  বাংলাদেশের বৈশাখী মেলা বা বিজয় মেলার মতো।  প্রায় সারামাস ধরে এই মেলা চলে।

১৭ শতাব্দির গোড়া থেকে জার্মানিতে ক্রিসমাস মার্কেটের চল। তখন শহরের মূল চার্চে এই মেলার আয়োজন করা হত।  মানুষজন তখন থেকে  মেলায় মশগুল। যে ধর্মের জৌলুস বাড়াতে এ মেলার চল সেই ধর্মের বিষয়ে কিন্তু জার্মানিতে খুব বেশি আগ্রহ দেখা যায় না।

১৬১৬ নুরেনবার্গের এক যাজক এই মেলা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। ক্রিসমাসের দিন বিকালে যাজক মহাশয় প্রার্থনা করতে চার্চে হাজির। কিন্তু চার্চ জনশূন্য। জনগণ সব মেলায়। এ যেন দেবতা ভুলে দেবতার প্রসাদ নিয়ে টানাটানি।

সারা দুনিয়ার বাচ্চা-কাচ্চাদের কাছে সান্তা ক্লজ অনেক জনপ্রিয়।  কিন্তু জার্মানিতে বেচারা খুব একটা বাজার পান নাই। বাচ্চারা এখানে অপেক্ষা করে ৬ ডিসেম্বরের নিকোলাউসটাগের জন্য।  হতে পারে বাচ্চা, কিন্তু  বিনা বাণিজ্যে নাহি দেব সূচাগ্র জার্মানির।

ছবি কৃতজ্ঞতা রয়টার্স

আগে বাচ্চারা সেন্ট নিকোলাসের ঘোড়ার জন্য খড়, কিংবা দানাদার খাবার রেখে দিত। আশা করতো তার বিনিময়ে কিছু পাবার। আর এখন পুরাই উল্টা।

বাচ্চারা তাদের বেডরুমের দরজা, জানালার বাইরে ঝুড়ি কিংবা একপাটি বড় মতো বুট জুতা রেখে দেয়।  মনের আশা জুতা বা ঝুড়িভর্তি চকোলেট। 

নিকোলাস সাহেবের তো আর আসা হয় না। তাই বাবা-মাকেই জুতা ভর্তি করে চকোলেট দিতে হয়। কিন্তু চুপিসারে। বাচ্চাদের হাতে ধরা পরলে সাড়ে সর্বনাশ।

একবার পাশের বাড়ির ভদ্রলোক সেন্ট নিকোলাস সেজে সেই জুতা ভর্তি করতে গিয়ে নিজের ছেলেমেয়ের হাতে ধরা খেলেন। তারপর দুই ছেলেমেয়ের কান্নায় গোটা পাড়া নির্ঘুম।

বার্লিনে প্রায় ৬০টির মতো ক্রিসমাস মার্কেট  বা মেলা বসে।  সাইজ অনুযায়ী ১০০-১৫০ এর মতো দোকান থাকে সেই মেলায়।  মেলায় বিক্রি হওয়া জিনিসপত্রের ধরন বাংলাদেশের মেলার মতই।

ছবি কৃতজ্ঞতা রিনভী তুষার

হাতে বানানো বিভিন্ন জিনিসপাতি। হাতে বানানো ব্রেড, নানা পদের খাবার।  তবে ক্রিসমাস মেলার মূল আকর্ষণ ক্রিসমাস ওয়াইন বা ব্লু ওয়াইন। বরফ জমা শীতে গরম গরম এই ওয়াইন খেতে খেতে মনে পড়বে গুড়ের চায়ের কথা।

ইচ্ছা করেই একটা নিরীহ উদাহরণ দিলাম। কারণ বুঝে নেন। তবে ক্রিসমাস মেলায় গিয়ে ব্লু ওয়াইন না খেলে এই ভবের জীবন বৃথা। 

একই মেলা ৬০ জায়গায় বসলেও আমার পছন্দ পটসদামার প্লাতসের ক্রিসমাস মার্কেট।  প্রায় চার হাজার বর্গমিটার জুড়ে এই মেলা বসে। ঠিক সনি সেন্টারের পাশে। একদম ভদ্রপাড়ার হৃদয়জুড়ে।

এই মেলার মূল আর্কষণ ১২ মিটার উঁচু, ৭০ মিটার লম্বা টবোগান রান ( বরফে এক ধরণের স্কি খেলা)।  খানিকটা ভয় জাগানিয়া আবার আনন্দেরও।  তবে মানুষজনের রক্ত হিম করা চিৎকার এই রানের বাড়তি মজা। সাথে আছে বিদেশি কায়দায় চরকি। মেরি গো রাউন্ড ।

ছবি কৃতজ্ঞতা রিনভী তুষার

পটসদামার প্লাতসের পাশাপাশি আরো এক মজার মেলা বসে আলেক্সজান্দার প্লাতসে। ক্রিসমাসের কিছু গিফট কেনা বাকি।  সেই রাতে মেলায় পৌঁছালাম দেরি করে। মেলায় গিয়ে পরিচয় হলো মার্টিনার সাথে। ( বৈদেশে আমার শুধু নারীদের সাথে বন্ধুত্ব হয়। এই নিষ্পাপ রহস্যে আমি নিজেও  অবাক।  ইচ্ছা ছিলো জর্মনে রমণীসঙ্গ নামে একটা নিস্পাপ লেখা লেখার। কিন্তু কোন এক নির্দোষ রমণীর চাপে এই জনমে সেটা আর হয়ে উঠবে বলে মনে হয় না )।

মার্টিনাদের চৌদ্দ পুরুষের হ্যান্ডিক্রাফটের ব্যবসা। মেলা প্রায় শেষ।মার্টিনার তখন দোকান বন্ধ করার সময়।  অনুরোধ করতেই রাজী হলো।শর্ত ওর দোকান বন্ধ করতে সাহায্য করতে হবে।  কথায় কথায় গল্প গড়ায়।

কোন এক অজানা কারণে মার্টিনার বাদামি মানুষ পছন্দ।নিজের গায়ের রঙ এবারই প্রথম এতো ভালো লাগলো।পাশের এক রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেলাম।

মার্টিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। পাশাপাশি পারিবারিক ব্যবসা দেখে। ছোট্ট একটা হ্যান্ডিক্রাফট গিফটও করলো। সেই রাত এখানেই শেষ করি। এর বেশি কিছু আপনাদের জেনে লাভ নাই।

ছবি কৃতজ্ঞতা রিনভী তুষার

যেটা জানা জরুরি তা হলো মার্টিনা এবং তার পরিবার নিরাপদ আছে।  বার্লিনে কখনোই নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয় না। কিন্তু এখন চলাফেরার সময় হেডফোনে গানটা পর্যন্ত শুনি না।

কারণ যদি গান শুনতে শুনতে গুলির শব্দ মিস করি।  কিংবা ট্রাকের নিচে চাপা পড়ি। গত সোমবারের ঘটনার পর এমনই চাপা আতঙ্ক। তবে এতোকিছুর পরও মানুষ নির্ভার। দোষারোপের সংস্কৃতি নেই। পর্যাপ্ত  প্রমাণ না পাওয়ায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে আটক করা সন্দেহভাজন পাকিস্তানি যুবককে। এটাই জার্মানি।  এটাই বহুসংস্কৃতির বার্লিন।

অনেক আনন্দ ভাবনা জড়ো করে বার্লিনের ক্রিসমাস মেলা নিয়ে লিখবো ভেবেছিলাম। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহের জমানো আনন্দ ভেসে গেছে ধর্মীয় উন্মাদনার বিষাক্ত রক্ত পিপাসায়। আমরা সবাই নিরাপত্তা খুঁজছি। ঢাকা টু বার্লিন টু আলেপ্পো।  বেঁচে গেলে লেখা হবে।  আর মরে গেলে এপিটাফ লেখার দায়িত্ব আপনাদের।

নিরাপদে থাকুন। নিরাপদে রাখুন। পৃথিবীর সব মেলা আনন্দের হোক। জয় মানবতার। জয় মানুষের।

লেখক: গবেষণা আর লেখালেখির চেষ্টা করেন

লেখকের ই-মেইল: kurchiphool@gmail.com

রিনভী তুষারের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন।  প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন।  লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!