বিদেশ ভালো: বাংলার পুলিশ ভালো, জার্মানের না !

না, আমিও গাঁজা টানিনি আর আপনিও ভুল দেখছেন না। ডোনাল্ড ট্রাম্পও জিতেছে। সাঁওতালদের বাড়িঘরও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

রিনভী তুষার,জার্মানির বার্লিন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Nov 2016, 12:25 PM
Updated : 14 Nov 2016, 12:25 PM

এরকম সত্যের মতোই এক সত্য, বাংলাদেশের পুলিশই সেরা জার্মান পুলিশের চেয়ে।

মানতে চান না ? ঠিক আছে, তো হয়ে যাক..। আমি প্রমাণ করেই ছাড়ব, ঠিক কী কী কারণে বাংলাদেশের পুলিশ সেরা। আর আপনারা প্রমাণ করুন, কেন বাংলাদেশের পুলিশ সেরা হবে না।

প্রথমে আসেন ফ্লেক্সিবিলিটির কথায়। এই পথে রিক্শা চলা মানা। সক্কাল সক্কাল আন্টি উনার বাচ্চাকে সাথে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছেন। পুলিশ বাঁশি বাজালো। এটা অবশ্যই পুলিশের অপরাধ।

পুলিশ আন্টির কাছে যেতেই উল্টা আন্টিই পুলিশকে চার্জ করেন, “বাঁশি দিলেন কেন ? এ রাস্তায় যাওয়া যাবে না মানে ? কবে থেকে ? ভাই না ভালোওওও.. আপনার বোনের বাচ্চাটার চেহারার দিকে একবার তাকান। কেমন শুকনা তাই না ?..এই চেহারা দেখার পরও পারবেন আপনি আমাদের রিকশা আটকাতে?”

আমাদের দেশের পুলিশের তখন আইনকে একটু 'কানুন' দেখাতে হয়। ইমোশন আর তোশনে মাখামাখি হয়ে পুলিশ ভাই বলেন, “এই নিয়ে  ত্রিশ, চল্লিশটা রিকশা ছাড়লাম। ঠিক আছে আপা যান।”

এরকম দৃশ্য যারা কখনো দেখেন নাই বলতে চান.. উনারা সবাই নিশ্চয় গাড়িয়াল ভাই কিংবা বোন।

এদিকে জার্মান পুলিশকে দেখেন। ব্যাটারা যে কি খারাপের খারাপ !

একদিন আমি একটা কানাগলি পার হব। অপেক্ষায়। দেখি একজন মহিলা হনহন করে সেই কানা গলির রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছেন। আমি ভদ্র ছেলে। আমি মানি লেডিস ফার্স্ট। আমিও ওনাকে ফলো করলাম।

জার্মান পুলিশ

পুলিশ হুটার (বিশেষ বাঁশি) বাজিয়ে ডাকলো। ভাবলাম, আন্টির মতো আমিও...কিন্তু মুখ দিয়ে গড়গড় শব্দ বেরুলো শুধু। 

পুলিশ বলল, “এটা কেন করলা বাছাধন?”

আমি পৃথিবীর সব থেকে নিষ্পাপ শিশুর মতো চেহারা করে উত্তর দিলাম, “কোনটা বিতে ( ভদ্র ফর্ম জার্মান ভাষায়)?” 

পুলিশ বলল, “এই যে লাল সিগন্যালে রাস্তা পার হলা।”

আমি সোজাসুজি ‘তুত মেয়্যার যেয়ার লাইড’ (একটু বেশিই সরি‌) বলে মানে মানে কেটে পরলাম। কি অসভ্য পুলিশরে বাবা !

তবে এসব তো কিছুই না। জার্মান পুলিশের স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ অসভ্যতার কথা বলছি। সাল ২০০২। ২৭ বছরের এক যুবক। পেশায় ছোটখাট উকিল। নাম ম্যাগনাস গায়েফগেন। ২৭ বছরের যুবকের চোখ ভরা স্বপ্ন। বুক ভরা উতরানো প্রেম। মেগনাস ভালোবাসে ১৬ বছরের কিশোরী কাথাকে।

কাথার এক কথা, “মেগনাস যদি তুমি আমাকে মার্সিডিজ, পোর্শের মতো গাড়ি কিনে দিতে পারো,যদি পারো ভূ-মধ্য সাগরে হলিডেতে নিয়ে যেতে, যদি পারো গুচির ব্যাগ কিনে দিতে, যদি পারো মন ভরে শপিং করে দিতে, তবেই আমি তোমার।”

মেগনাসেরও চাপার জোর ছিল। সে বললো, “এটা কোন ব্যাপার? তুমি তো জানো না, আমি কতো বড় ল’ফার্মে কাজ করি। কত কত টাকা কামাই।”

সে তার প্রেমিকাকে চার সপ্তাহের জন্য হলিডেতে নিয়ে গেল। গন্তব্য ফ্লোরিডা। যাওয়ার সময় খরচ করে ফেললো তাকে দেয়া তার বাবার জমানো পেনশন। ব্যাংকের কাছে ধার করলো প্রায় ৪ হাজার ইউরো। এত ধার-দেনা করেও বেচারা তার প্রেমিকা সামলাতে ঠাণ্ডা শিম মানে হিমসিম খেতে লাগলো।

জার্মানি এমনিতেই ঠাণ্ডার দেশ। বেশি হিমসিম তো আর খাওয়ার উপায় নাই। তাই সে প্রেয়সীকে ইমপ্রেস করতে এক মহা পরিকল্পনা করলো। কিডন্যাপিং !

ফ্রাংকফুটের প্রায় তিনশ’ বছরেরও পুরনো মেটতসলার প্রাইভেট ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফ্রেডরিখ ফন মেটতসলার। তার ১১ বছর বয়সি ছেলে ইয়াকব ফন মেটতসলারকে সে অপহরণ করে বসলো।

প্রেমে তাজমহল হলো,আর এ তো সামান্য অপহরণ! কিন্তু সামান্য অপহরণটাও আর সামান্য রইলো না। ম্যাগনাস ১১ বছরের ইয়াকবকে সামলাতে পারলো না। নাকে মুখে স্কচটেপ পেঁচাতে গিয়ে মেরে ফেললো। বাচ্চাটার লাশ ফ্রাংকফুট থেকে এক ঘণ্টার ড্রাইভিং দূরত্বে একটা লেকের ঘাটে লুকিয়ে রাখলো।

অপহরণের পর খুন হওয়া শিশু ইয়াকব ফন মেটতসলার

ম্যাগনাস, ইয়াকবের পরিবারের কাছে মুক্তিপণ চাইলো এক মিলিয়ন ইউরো। ইয়াকবের মৃত্যুর দু'দিন পর তার পরিবার বিনা শর্তে টাকা তুলে দিলো ম্যাগনাসের হাতে। মুক্তিপণের টাকা নিতে ম্যাগনাস আসলো একটা ট্রাম স্টেশনে। গোটা ঘটনাটা জার্মান পুলিশের সামনেই ঘটলো।

টাকা হাতে পেয়েই ম্যাগনাস পরদিনই অর্ডার করলো একটা মার্সিডিস সি-ক্লাশ লিমোজিন। হলিডে বুক করলো ক্যানারিস আইল্যান্ডে। প্লেন ধরতে যাবার পথেই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। আর তার এক ঘণ্টা পরেই পাওয়া যায় ইয়াকবের লাশ।

ঘটনাটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু আমি আবারও প্রমাণ করে দেব, জার্মান পুলিশ দক্ষ না। পুলিশ ম্যাগনাসকে চাপাচাপি করে ইয়াকবের খুন আর লাশের হদিস বের করে। এই হদিস বের করতে গিয়েই জার্মান পুলিশ একটা অতি মারাত্নক ভুলও করে বসে। ভুলটা হলো- তারা ম্যাগনাসকে বলেছিলো, যদি তুমি ভালোয় ভালোয় না বলো ইয়াকব কোথায়, তবে আমরা স্পেশাল পুলিশ ডাকবো। তারা খুব ভালোই জানে, কীভাবে কথা বার করতে হয়।

ব্যস, এইটুকুই। ম্যাগনাস সব স্বীকার করে। পুলিশও লাশ উদ্ধার করে। ম্যাগনাসের যাবজ্জীবন সাজা হয়। কিন্তু ম্যাগনাসকে আইন অমান্য করে ভয় দেখানোর দায়ে কোর্ট ওই পুলিশ অফিসার এবং ফ্রাংকফুট পুলিশের দ্বিতীয় প্রধান মিস্টার ডেশারকে সাসপেন্ড এবং আর্থিক জরিমানা করে।

এমনকি ক্ষতিপূরণ বাবদ ম্যাগনাসকে কোর্ট তিন হাজার ইউরো দেয়ার রায় দেয় ২০১১ সালে। গোটা বিষয় নিয়ে জার্মানির পার্লামেন্টেও চলে বাদানুবাদ।

এবার একটু দেশিয় কায়দায় ভাবেন। কিডন্যাপার টাকা নিতে আসছে, ম্যাগনাস অ্যারেস্ট। তারপর ভিকটিমের খোঁজ ?

দেখা যাবে, বাংলাদেশের পুলিশ সেটা আগে থেকেই জানে। তারপর পুলিশ ম্যাগনাসকে নিয়ে ভিকটিমের লাশ উদ্ধারে গেল। পথিমধ্যে ম্যাগনাসের ওত পেতে থাকা সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুচির ব্যাগ ছুঁড়ে মারলো। পুলিশ সেটাকে বোমা ভেবে জীবন বাঁচাতে করলো গুলি।

ব্যস, অনেক গোলাগুলির এক-দুইটা গুলি ম্যাগনাসের পিঠে ঢুকে গেলো..পুলিশেরও কেউ আহত হলো। কিন্তু কে আহত হলো, এটা একটা রহস্য।

ম্যাগনাসকে সরকারি মেডিকেলে নিয়ে যাবার পর ডাক্তারের মৃত ঘোষণা। ঘটনা শ্যাষ।

এবার বলেন, কে বেশি দক্ষ ? জামার্ন পুলিশ নাকি বাংলাদেশের পুলিশ ?

জার্মানের পুলিশ ব্যাপক আজাইরা। কোন কাজ-কাম নাই সারাদিন। একটা উদাহরণ দিলেই বুঝবেন। গেলো বছর চৈত্র সংক্রান্তির রাত। মানে ১৩ এপ্রিল। হঠাৎ মন উদাস হয়ে গেল।

ইয়াকবের লাশ উদ্ধার করছে জার্মান পুলিশ

দিলাম ফুল ভলিউমে 'মেলায় যাইরে' বাজায়া। জার্মান বন্ধু জিজ্ঞাসিলো গানের মানে। আমি বুঝাইলাম মেলায় যাওয়া একটা মহৎ ব্যাপার। সেও গানের তালে তালে মাথা নাড়লো। বুঝলাম সেও মেলায় যাইতে চায়।

কিছুক্ষণ পর জোরে জোরে দরজায় কে যেন ধাক্কা দিল। আমি ভাবলাম, পাশের ফ্ল্যাটের আরো কেউ হয়তো মেলায় যাবার বিষয়ে ইন্টারেস্টেড।

হাসিমুখে দরজা খুললাম। ভাবতে পারেন,দরজা খুলে কি দেখি ? 'পুলিতসাই', মানে পুলিশ।

তেনারা কইলেন, "বিতে,আপনি একটু হাই-ভলিউমেই মেলায় যাইতেছেন। আস্তে আস্তে যান। প্রতিবেশীরা কমপ্লেইন করছে। আপনি কি ভুলে গেছেন এটা সপ্তাহের শুরুর দিন?"

আমি হাসবো না কানবো ? সিরিয়াসলি ! তোমাগের খেয়ে-দেয়ে কাজ নাই ? যাওনা একটু কাজ করো... চোর-টোর ধরো। আলেক্সজান্ডারপ্লাতসে যারা গাঁজা বেচে তাদের ধরো। এসবই বললাম। কিন্তু মনে মনে।

ভেজা বেড়ালের মতো মাকসুদ ভায়ের গলা চেপে ধরলাম। আওয়াজ করে মেলায় আর যাই না এরপর থেকে।

'বিদেশ ভালো' লিখতে গিয়ে আমার অনেক বদনামের এক নাম হলো, আমি বাংলাদেশকে ভালো পাই না। আর অস্ট্রেলিয়া থেকে শুনতে পাই, আমার লেখা সবাই বুঝে না। হাই থট টাইপ। এসব ভুল-ভাল। আমি ধনাত্নক মানুষ।

শেষ করি বাংলাদেশ পুলিশের ম্যানেজিং ক্যাপাসিটির দুর্দান্ত এক গল্প দিয়ে। ঘটনা নোয়াখালীর। একদমই সত্য ঘটনা।

পারিবারিক সূত্রে ঘটনার সাক্ষী আমি। ওয়্যারলেসে মেসেজ আসছে। রাত তখন প্রায় সাড়ে ১১টা।

জনৈক পুলিশ অফিসার, "স্যার,পেট্রোলিং-এ বের হইছিলাম গাড়ির তেল শেষ। কি করবো ?"

স্যার, "গাড়িতে তেল না নিয়ে আপনি বের হইলেন কেন ? টাকা দিয়ে তেল কিনেন।"

অফিসার, "স্যার, পকেটে টাকাও তো নাই।"

স্যার, "ওভার অ্যান্ড আউট (রাগে গজগজ)।"

আধঘণ্টা পর স্যারের মোবাইলে অফিসারের মিস কল।

শিশু ইয়াকব হত্যার আসামী ম্যাগনাস গায়েফগেন

স্যার ফোন করতেই অফিসার বললেন, "স্যার, তেল ম্যানেজ। গাড়ি চলছে।"

স্যার জিজ্ঞেস করলেন,"কিভাবে ম্যানেজ হলো ?"

অফিসার বললেন,"স্যার, যেখানে গাড়ি খারাপ হলো, ওইখানটার কাছেই এক লিস্টে থাকা চোরের বাড়ি ছিল। দাগী চোর। ওর বাড়িতে গেলাম। গিয়ে বললাম তেল নাই তেলটা কিনে দে। একটা ভালো কাজ কর। নইলে আবার চালান করে দেব। ব্যাস,তারপর ও তেল কিনে দিসে।"

যষ্মিন দেশে যদাচার, কাছা খুলে নদী পার।

লেখক: গবেষণা এবং লেখালেখির চেষ্টা করেন।

ছবি: ইন্টারনেট।  

ইমেইল: kurchiphool@gmail.com