বিদেশ ভালো: বার্লিনের নাইট লাইফ

বার্লিনের রাত শুধু ঘুমিয়ে সকালে সক্কাল সক্কাল ওঠার জন্য নয়। এখানে অনেক মানুষ শুধু দিনে ঘুমায় রাতে জাগার জন্য।

রিনভী তুষার, জার্মানির বার্লিন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2017, 11:19 AM
Updated : 13 March 2017, 11:19 AM

আমি ফেরত। মানে আই অ্যাম ব্যাক। অনেক দিন ছাই-পাশ লিখছি না। তাই আপনার, তোমার আর তোদের দরজায়... জানতে চাই- ছাই রাখবেন নি গো, ছাই?

গত তিন সপ্তাহ ঘুরান্তিস ফিরান্তিস করলাম। কই কই টই টই করলাম? শুনতে চাইলে লাইনে থাকুন। আসিতেছে...

বাংলাদেশে আমার একটা নাইট লাইফ ছিলো। প্রথম কাজ ছিলো- আমার কুকুরসম (আদুরে নাম) বন্ধু তৌহিদ আহমেদের বাবার গাড়ি চুরি করা। চুরি মানে গাড়ি বাসার গ্যারেজ থেকে ঠেলে ঠেলে মেইন রোড পর্যন্ত আনো, তারপর স্টার্ট দিয়ে মাওয়া। ভরপেট ইলিশ খাও। পদ্মার হাওয়া ফ্রি। এই পার্টটুকুই অ্যাডভেঞ্চেরাস। তারপর মাওয়া টু মিরপুর হৃৎপিণ্ডের উপর হালকা হাত বুলাতে বুলাতে বাসায় ফেরা।

দশদিন চোরের, একদিন গেরস্থের। তৌহিদের ধমকে ধামকে গাড়ির ড্রাইভার চুপ থাকতো। কিন্তু একদিন আঙ্কেল মানে তৌহিদের বাবা বিষয়টা ধরে ফেললেন। তাও আবার অকাট্য প্রমাণসহ। গাড়িতে পাওয়া গেলো মাওয়া যেতে পার হওয়া ব্রিজের টোলের রশিদ। রাতের বেলা গাড়ি নিয়ে হাওয়া খেতে মাওয়া কে যায়? এটা যে তৌহিদের এক বাচ্চার বাপ, বড় ভাই নয়, সেটা বুঝতে আইনস্টাইন হতে হয় না। সেই থেকে রাত করে মাওয়ার ইলিশ খাওয়া, হাওয়া!

সেই স্মৃতিসহ এক বুক বেদনা চেপে আর হাতে জীবনানন্দের রাত্রিসহ প্যাঁচাকে  নিয়ে চলে আসা বার্লিন। এখানে রাতের জীবন দিনের জীবন থেকে পুরাই আলাদা। বার্লিনে দিনে জীবন আর রাতে লাইফ। নাইট লাইফ।

রাত এমনিতে ভালো। আরও ভালো শুক্রবার, শনিবার। এখানে  রাত এতোই ভালো যে শুক্রবার সকাল থেকেই রাতের শুরু হয়। অফিসের বসরাও শুক্রবারে সপ্তাহের বাকি চার দিনে করা চার খুন পর্যন্ত মাফ করে দেন।

রাতের জীবন থেকে নাইট লাইফ হবার একটা ইতিহাস আছে। এটা অবশ্যই জানা উচিত। না জানলেও ক্ষতি নাই।

রাতের বেলা বিশেষ জায়গায় নর্দন-কুর্দনের ইতিহাস বেশিদিনের নয়। ইউরোপ-আমেরিকায় এটা বিংশ শতাব্দীর বিষয়। ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালের মাঝে লাইভ জ্যাজ মিউজিক, সাথে নৃত্য, স্ট্যান্ডআপ কমেডি, জাদু, পানীয়- এসব জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। যে জায়গায় এসব হতো, তার ইংরেজি নাম ‘ভোডাভিল’। যাকে এখন বলা হয় ভ্যারাইটি। গোটা বিংশ শতাব্দি ধরেই এই নাইটক্লাবের ধারণা জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। বিশেষ করে ১৯৫০ সালে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। তরুণরা মিউজিক, ফ্যাশন- এসব নিয়ে তাদের চিন্তা-চেতনার প্রকাশে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে। ১৯৬০ সালের দিকে বড় হলরুমে তরুণদের জড়ো হওয়া, লাইভ রক অ্যান্ড রোল মিউজিক, ডিস্ক জকির মিউজকের সাথে সাথে ডান্স- এসব নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায়। নর্দন-কুর্দনের এই জায়গাকে বলা হত ডিসকোটেক।

১৯৭০ সালে এই ডিসকোটেক-এর লেজ কাটা গেলো। জন্ম নিলো নতুন কালচার ‘ডিসকো’। ডিস্কো জকিরা হয়ে গেলো ‘ডিজে’। এই ডিজেদের সাথে বাংলাদেশে আমাদের পরিচয় হলো নব্বইয়ের শেষের দিকে। প্রায় খুলে যাচ্ছে যাচ্ছে প্যান্ট, হাঁটু পর্যন্ত পাঞ্জাবির মতো টি-শার্ট, মাথায় ডাবল টুপি- এসব লেবাস দেখে আমরা ডিজে চিনে নিতাম।

ডিসকো মানেই অনেকটা মিউজিক। কিছুটা ড্রাগস। ব্ল্যাক মিউজিক আর ইলেকট্রনিকার মিশ্রণে তৈরি মিউজিক যেমন- র‌্যাগে, ফাংক, সউল ছিলো ডিসকোর মূলে। এরপর বির্বতনে জন্ম নেয় হিপহপ মিউজিক। ১৯৭০ এর শেষটা তো কেঁপেই গেলো হিপহপের তালে। হিপহপ মিউজিকের সাথে যোগ হলো  ব্রেইক ডান্স।

১৯৮০ সালে ডিসকোকেন্দ্রিক মিউজিকের আরও শাখা-প্রশাখা জন্মালো। যেমন- হাউজ, গথ,গারাজ, ইন্ডি, রাগা এবং টেকনো। তবে এর মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো হাউজ মিউজিক। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি শিকাগোতে জন্ম এই মিউজিকের । জলবত তরলং মিউজিক। উচ্চমাত্রায় ধুম-ধারাক্কা। কণ্ঠের গান প্রায় নাই নাই। পুরাই ইলেকট্রনিক এই মিউজক নাচের জন্য বেস্ট। এই মিউজিকের চল শুরু সমকামীদের হাত ধরে। এরপর ভালোলাগা ছড়িয়ে গেলো সর্বত্র।

মিউজিকের তালে তালে সময়ের সাথে ডিসকো হয়ে গেলো নাইটক্লাব। সেই ডিসকোর বর্তমান নাম এখন ‘নাইটক্লাব’। শুদ্ধ বাংলায় কি বলা যায় নাইটক্লাবকে? রাত্রিখানা? এর চেয়ে যুতসই কিছু মাথায় আসলে ইমেইল করবেন প্লিজ।

আমরা বাঙালিও কিন্তু ডিসকোতে কম যাই না। উপমহাদেশের প্রথম ডিসকো ড্যান্সার কিন্তু বাঙালিই। ১৯৮২ সালের কথা। ভুলে গেছেন মিথুন চক্রবর্তীর নাম? ‘আই অ্যাম অ্যা ডিসকো ড্যান্সার, বিড়ি খাইলে হয় ক্যান্সার’-  ছোটবেলার এই প্যারোডি দেখেন তো মনে করতে পারেন কি না?

১৯৮৯ সালে বার্লিন ওয়ালের পতন ঘটে। এর ফলে এক হয় পূব-পশ্চিম জার্মানি। চিন্তা-চেতনা-সংগীত-শিল্প-ভালোবাসা-আবেগের যাতায়াত হয়ে ওঠে বাধাহীন। বার্লিন ওয়ালের পতন এবং সমসাময়িক ঘটনায় অনেক ভবন পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে। তরুণরা শুরু করে সেসব পরিত্যাক্ত ভবনে অবৈধ পার্টির আয়োজন। পার্টিতে বাজানো হতো ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি  ডেট্রয়টে জন্মানো ‘টেকনো অরিজিনেটেড’ মিউজিক।

পরিত্যাক্ত পাওয়ার স্টেশন, হ্যাঙ্গার, বাঙ্কার, আন্ডারগ্রাউন্ড  রেলস্টেশন- এসব জায়গায় গজিয়ে ওঠে অস্থায়ী নাইটক্লাব। তখনকার সময়ে এসব নিয়ে খুব একটা আইনী ঝামেলা হবার কথাও শোনা যায় না।

ট্রেজর, ডেয়ার বাংক, এ-ভার্ক। এই তিন নাইটক্লাবের বদৌলতে বার্লিন আজ টেকনো মিউজিকের রাজধানী। ট্রেজর তিন বছর ধরে অবৈধভাবে পার্টি আয়োজনের এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৭ সালে নতুন করে চালু হয়েছে ট্রেজর। ট্রেজরে বড় বড় করে লেখা ‘ট্রেজর কখনো ঘুমায় না’।

বাংকার বন্ধ হয়ে গেছে। এ-ভার্ক এখন সাধারণ মানের নাইটক্লাব। তবে এই তিন ক্লাবের হাত ধরে নাইটক্লাবের মার্কেট ছাড়িয়ে গেছে ১ বিলিয়ন ইউরো।

আমার প্রথম নাইটক্লাব ছিলো ‘দা ম্যাট্রিক্স’। গেলাম। এদিক-ওদিক ঘুরি। মিউজিকের দমকে অজ্ঞান হবার দশা। স্টুডেন্ট নাইট ছিলো না সেদিন। পকেট গড়ের মাঠ। ড্রিংক্সের দামে কিডনি মেলে। এসব বড় বড় নাইটক্লাবে কিছু হানি থাকে। এরা মূলত ক্লাব প্রমোটার। এদের কাজ- হানিট্র্যাপ বা মধুফাঁদে শিকার ধরে নিজেদের ক্লাবে নিয়ে যাওয়া। যতো শিকার, ততো টাকা। আমি আর আমার বন্ধু এমন হানির খপ্পরে পড়ে ওর ক্লাবে গেলাম।  গিয়ে দেখি সেই ক্লাবে ক্লাবের ম্যানেজার আর গেট কিপার। অন্য কোন জনমানুষের চিহ্নও নাই।

আমাদের ভগ্ন মনোরথ ঠেলতে দেখে এক জার্মান তরুণের দয়া হলো। নিজে থেকেই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলো ‘বেয়ারঘাইন’। এই নাইটক্লাব সবার চেয়ে আলাদা। বার্লিন তো বটেই, ইউরোপের সেরা ক্লাব এই বেয়ারঘাইন।  এই ক্লাবে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ভিআইপি’ও গুরুত্বহীন এবং সবার সমান। চকচকে কোন ফ্লোর নাই। ক্লাবের কোথাও কোন আয়না নাই। ছবি তোলা নিষেধ। শুক্রবার রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত নাচানাচি চলে।

পরিত্যাক্ত পাওয়ার স্টেশন বিল্ডিংই বেয়ারঘাইন আর প্যানোরামার ঠিকানা। বেয়ারঘাইনে গেলে পাবেন দুনিয়া কাঁপানো ডিজে আর টেকনো মিউজিক। প্যানোরামায় চলে হাউজ মিউজিক। প্যানোরামায় একটু পান করবেন। কিছুটা জিরোবেন। সাথে সাথে ক্লান্ত হবার প্রস্তুতি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়বেন বেয়ারঘাইনের ড্যান্স ফ্লোরে।

এই ক্লাবে আপনাকে যেতেই হবে। না হলে বার্লিন দেখা হবে না। ক্লাবে ঢোকার পূর্বে কী করিতে হইবে এবং কি করিলেই নয়? বিনা পয়সায় কিছু পরামর্শ দিচ্ছি। বেয়ারঘাইনে বড় দল-বল নিয়ে যাবেন না। দামী জামাকাপড় পরেও যাবেন না। ভুলেও পকেটের ফোন হাতে নিয়ে অযথা নাড়াচাড়া করবেন না। বেয়ারঘাইনে আপনি যাবেন নাচতে আর নাচাতে। সো নো ফোন। দশ ইউরো টিকেটের দাম।  এই ক্লাবের বাউন্সাররা কাউরেই পরোয়া করে না। অহেতুক হৈ-হুল্লোর করার জন্য আমার সামনেই বেশ কজনকে লাইন থেকে বের করে দিলো। সেসব পার্টিবাজরা আর ঢুকতেই পারলো না ক্লাবে।

আপনি কি একেবারেই ক্লাবিং করতে চান না পয়সা খরচের ভয়ে? কিংবা জাত-পাত-ধর্মের ভয়ে? কিংবা আপনি ভালোই নাচতে জানেন, কিন্তু পৃথিবীর সব উঠান বাঁকা! তবু আপনার জন্যও বার্লিনের নাইট লাইফ। জার্মানরা যে কোন অ্যাভারেজ বাঙালির চাইতে খারাপ নাচে। ভাংগা রাস্তায় বাসের ঝাঁকুনিতে তৈরি হওয়া নাচের মুদ্রা জার্মানদের নাচের মুদ্রার চেয়ে সুন্দর।

নাচতে না চান, চলে যান রাতের ওয়ারশ স্ট্রিটে (ভারশাও স্ট্রাসে)। সেখানে নানা রঙের মানুষ। দেশ বিদেশের গান-বাজনা। স্ট্রিট ফুড। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত দিয়ে গান শুনবেন না। পকেট থেকে কয়েনসহ হাত বের করে মাঝে মাঝে সে মহান মিউজিশিয়ান বা গায়কের দিকে ছুড়ে দিবেন। আই মিন, তার গায়ে কিংবা মুখে না। সামনে রাখা ব্যাগে।

রাতের বেলা নীরবতা ছুঁতে চাইলে চলে যান লেকে। টেগেল এয়ারপোর্টের পাশের লেকে যেতে পারেন। তবে ভুলেও লেকের পাশের বেঞ্চে শুয়ে পড়বেন না। মাতাল ভেবে পুলিশ ধরে নিয়ে যেতে পারে।

ক্লাবিংয়ের কিছু মন্দ দিক না বললে গল্পের পুরোটা বলা হয় না। ক্লাবিং থেকে অবৈধ ড্রাগসকে আলাদা করা মোটামুটি অসম্ভব।  অতিরিক্তি নর্দন-কুর্দন এবং শরীর ঝাঁকাতে প্রয়োজন হয় এক্সট্রা অ্যাবসার্ড এনার্জির। এসব অজুহাতে ক্লাবার্সরা ঝুঁকে পড়ে ড্রাগসের দিকে। জার্মানিতে ড্রাগসের ট্রেন্ড অতোটা শক্তিশালী নয়। কিন্তু ইউরোপ মোটেও ড্রাগসের কড়াল গ্রাস থেকে মুক্ত নয়। ইউরোপের কোকেন ক্যাপিটাল বলা হয় লন্ডনকে।

রাতের শহর পুরনো আশ্রয়ের মতো। পৃথিবীর যে প্রান্ত মনে ধরবে, সেখানে রাতটা কাটানোর চেষ্টা করবেন। দিনে সুন্দরের যেটুকু  চোখে পড়েনি, রাতে তা ধরা দেবে। রাত একান্তই নিজের। রাতের সৌন্দর্যে কেউ ভাগ বসাতে পারে না। রাতে মন জীবনানন্দ হয়ে বলে উঠে-

“দেখেছি যা হল হবে মানুষের যা হবার নয়-

শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।”

লেখক: গবেষণা আর লেখালেখির চেষ্টা করেন

লেখকের ই-মেইল: kurchiphool@gmail.com

রিনভী তুষারের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com । সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!