বিদেশ ভালো: ও- তে ওয়ারশ, ও-তে ওরাংওটাং

কথার কথা বলছি, ও-তে ওড়না ছাড়া ওরাংওটাংও হয়।

রিনভী তুষার, জার্মানির বার্লিন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Jan 2017, 06:56 AM
Updated : 23 Jan 2017, 02:10 PM

লেখালেখি করা ভালো। তবে না করা বেশি ভালো। সিরিজ লিখলে সপ্তাহের বিশেষ বিশেষ দিন জাম্বুলিনি জাম্বুলিনি ( আমাকে কম্বল দিয়ে চেপে ধরো) জপতে হয়। কারণ যাকে লেখাটা দেব, তিনি অমাবস্যা কি আর চাঁদনি রাত, সবসময়ই ঠাণ্ডা পানির বালতি হাতে।

দুই সপ্তাহ রিসার্চের চাপে বিদেশ ভালো লিখতে পারি নাই। সবাইকে শুভ নবর্বষ। আশা করি গল্পের ‘অজ’, আই মিন ছাগল এখনও আপনাদের গাছের সব আম খেয়ে শেষ করতে পারে নাই।

তবে মাঝখানে এই চরম অপ্রয়োজনীয় লেখাটা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলাম। এই লেখার অনেক উদ্দেশ্যের একটা হলো বিনোদন। কিন্তু বঙ্গদেশে বিবিধ রতনের বদলে এখন বিবিধ বিনোদন। সেখানে আমার এই লেখা তো ডলা শেষের শিরিষ কাগজের চেয়েও মূল্যহীন।

তবে এবার আর জার্মান লেবু চিপবো না। আমার হাতের লেবু এখন অনেকের হাতে। এক লেবু এক দেশ। এই মতবাদে দীক্ষিত হয়ে অনেকেই একই জার্মান লেবু চিপে যাচ্ছেন। চেপার চাপে কোনটা লেবু আর কোনটা করল্লা- বোঝা মুশকিল!

তখনও এরকম মোনোটনিই ছিলো। পাঁচ দেশের পাঁচজন মিলে ঠিক করলাম, পোলান্ড যাব। গন্তব্য ওয়ারশ আর ক্রাকাও। পাঁচজনের সাথে যোগ হলো একজন চায়নিজ বন্ধু। চায়নিজ বন্ধুর নাম সু রান।

চায়নিজ এই বান্দাকে চিনে রাখেন। সে এক মহা চিজ। আমেরিকান নিকি (মহা কামচোর)। ইথিওপিয়ান বেজা। মেক্সিকান ব্রুনো। জার্মান মারাইকে। এই আমাদের টিম।

পোলান্ডের এই কিস্তি একটু চামে দিয়ে বামে টাইপ। পরের কিস্তি একটু ঝাঁজালো। সোজা বাংলায় এটা দিনের গল্প। পরেরটা রাতের।

বার্লিন টু পোলান্ড। বাসের টিকিট মহা সস্তা। আরও সস্তা হোস্টেল। হোস্টেলের নাম ‘ওকিডকি হোস্টেল’। হোস্টেল মানে ধরেন যে বাংলাদেশের বোর্ডিং। যারা ইউরোপ টুরের প্লান করছেন, তাদের জন্য হোস্টেলে থাকা বাধ্যতামূলক। কারণ বিবিধ। প্রথম কারণটাই বলি- ইহা মহা সুলভ। বাকি কারণ জানার দরকার আছে?

জার্নির আগের দিন রাতে আমার এক রুমে চারজন ঘুমালো। সকাল বেলার নাস্তা হিসাবে রাতে ল্যাও ল্যাও খিচুড়ি রান্না করেছিলাম। আমেরিকান নিকিকে একবার সাধলাম। মাথা নৃত্য করে বললো, নাহ্‌, খাবো না। কিছুক্ষণ পর বললো খাবে। তারপর যা খেলো,সেই খাওয়ায় বাংলার খাদ্যবীর খালেদ সাইফুল্লাহ ফেইল!

সকাল বেলার ঘুম ভাঙলো দুপুরে। দৌঁড়ে দৌঁড়ে বাস স্টপ। ওয়ারশ পৌঁছালাম রাত প্রায় সাড়ে দশটায়। টাকা ভাঙালাম।  পোলান্ড ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সদস্য। কিন্তু এখানে ইউরো চলে না। মুদ্রার নাম ‘স্লতে’। উচ্চারণের সময় মনে হবে, আপনাকে কেউ ভেঙাচ্ছে।

ক্ষুধা আর শীতে আমরা বলদের মতো একটা টার্কিশ রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। মামারা আমাদের দেখেই অদৃশ্য হাতে হাত তালি দিয়ে বললেন- এতো দিন কোথায় ছিলেন!

বিল এলো। বিলের চেহারা দেখে মনে হলো, আমি লাস ভেগাসে! আহারে বুদ্ধি খুলে। সিদ্ধান্ত হলো আমরা রান্না করে খাব। দিন পনেরোর ট্রিপ। বাইরে খেলে ভিক্ষা করেও বার্লিন ফেরা হবে না। কারণ পোলিশরা জার্মানী থেকে আসছি শুনলে ভিক্ষাও দেবে না।

বাজার করলাম। গরুর মাংস,চাল,সবজি,ডাল,ডিম,জ্যাম,দুধ,ব্রেড। হোস্টেলের কিচেনে রান্না। প্রতিটা খাবারের গায়ে স্টিকার।  যাদের ট্রিপ শেষ তারা কেউ কেউ আবার ফাও ফাও খাবার বিলায়। সুতরাং হয়ে যাচ্ছিলো প্রায়।

দুই দল ভাগ করা হলো। আমি কুক। দুইজন রান্নায় সাহায্য করবে। আর দুইজন রান্না শেষে বাসন কোসন পরিষ্কার করবে। আর প্রতিদিনই একজন রেস্ট করবে। আমাদের পাঁচজনের ভাগে কোনদিনও  সেই রেস্ট জোটে নাই। যতো রেস্ট নিয়ে গিয়েছিলো আমেরিকার কামচোর নিকি নয়েমান। ওর আমেরিকান চিকন ধান্দাবাজির কাছে আমরা অসহায় ছিলাম। রান্না শুরু আর খাবারের পরপরই নিকির অদ্ভুত এক মাথাব্যাথা শুরু হয়ে যেতো।

প্রথম দিন ডিমের তরকারি রান্না করেছিলাম। প্রায় ২৪টা ডিম। প্রজেক্ট- ডিম আনি, ডিম খাই। কিন্তু রাতে রান্না করা ডিম সকালেই সব শেষ। ডিম রহস্য সন্ধান করে যা জানলাম, তা বললে জাতিগত মারামারি বেঁধে যেতে পারে।

কিছু ভারতীয় সবজিভূক আমাদেরকে ডিম কারি রান্না করতে দেখেছিলেন। অনেক ভাব জমানোর চেষ্টা করেছিলেন। ওনাদের কথার চিড়া আমরা ভিজতে দেইনি। শেষমেষ গভীর রাতে ওনারা ডিমগুলো নিজেদের মনে করেন। রাতে কম্ম শেষ করে সকালবেলা চেক-আউট করেন। এমনকি নিজেদের রান্না করা ডিম বলে এক কানাডিয়ান কাপলকে জোর করে আপ্যায়নও করেন।

গোটা ঘটনা কানাডিয়ানদের মুখে শুনলাম। আবারও একবার বুঝতে পারলাম, ভারতীয়রা আমাদের ডিমতুতো ভাই-বোন। ভারতের ডিমের ঋণ কিছুটা শোধ করতে পেরেছি, এই বলে নিজেকে সান্তনা দিলাম।

এবার খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নতুন ফন্দি আটলাম।  ডিনারে হোস্টেলের ম্যানেজারকে দাওয়াত করলাম। চুরি যাওয়া খাবারের কথা জানালাম। কাজ হলো। কিচেন ম্যানেজারকে বলে দেয়া হলো। ব্যস, খাদ্য নিরাপদ।

ঘোরাঘুরির প্ল্যান করলাম। আমার প্ল্যানের মোটা অংশ  হোস্টেলের বিছানায় ঘোরাঘুরি করা। জাস্ট চিল। বাকি চারজনেরও দেখলাম একই অবস্থা। কিন্তু চাইনিজ সু রান পুরাই উল্টা। আম বাগানে গাব। সে প্রতিদিন ভোরবেলা লিস্টি হাতে বের হয়া যাচ্ছে। ফিরছে আমরা যখন হোস্টেল থেকে বের হচ্ছি তখন। মহা যন্ত্রণা!

দুই-তিন দিন পর সে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। আমি দেখি অবস্থা বেগতিক! বললাম- যে যার মতো ঘুরো। আমি ভাই লেইট নাইট সিটি দেখবো। চিড়িয়াখানা আমার কাছে অপাশবিক লাগে। তাই আমি যাবো না। জাদুঘরে আগ্রহ আছে। তবে শুধু ফ্রি জাদুঘরে যাব। বাপ-দাদার জিনিসপত্র দেখার জন্য পয়সা খরচে আমি নাই। এর চেয়ে আইরিশ পাবে গিয়া গ্লাসের গভীরতা মাপা ভালো।

টিমের সবাই জুটে গেলো চায়নিজ ট্যুরিস্টের সাথে। সকাল-সন্ধ্যা দৌঁড়ের ওপর।

আমি একা একা ঘুরি। ঘুরতে ঘুরতে গেলাম কোর্পানিকাস সায়েন্স সেন্টারে। বিস্মিত হবার মতোই। আধুনিক জ্যোর্তিবিজ্ঞানের জনক কোর্পানিকাস সূর্যকে সৌর জগতের কেন্দ্র বলে দাবি করেছিলেন। আবিষ্কার করেছিলেন সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে পৃথিবী। এই আবিষ্কার ছিলো বাইবেলের বর্ণনার উল্টা। তারপরেই ছিলেন দৌঁড়ের উপর।

একই দাবি করায় খ্রিস্টান মোল্লারা পুড়িয়ে মারলো ব্রুনোকে। ক্যাথলিক মোল্লা হবার পরও সমালোচনার হাত থেকে রেহাই মেলে নাই কোর্পানিকাসের। মার্টিন  লুথার বললেন- আরে কোর্পানিকাস কি জানে? এইসব ওর বুজরুকি কথাবার্তা! 

পোলান্ড এখনও ক্যাথলিক দেশ। এইখানে সবাই ঘোমটা দিয়ে খেমটা নাচে। কারণ একটাই, ধর্মের ঢোল ফুঁ দিয়ে বাজানো। সেই দেশের জ্ঞানের প্রতীক এখন কোর্পানিকাস। লাখ লাখ পয়সা কামানো হচ্ছে এই বিজ্ঞানীর নাম বেচে। অথচ বেঁচে থাকতে!!

সায়েন্স সেন্টারের পাশেই পোলান্ডের বিখ্যাত ভিস্টুলা নদী। নদীর পাশে নতুন বানানো ফুটবল স্টেডিয়াম। অসধারণ প্লানেটোরিয়াম। ঠিকঠাক পয়সা উসুল। সায়েন্স সেন্টারে গাদা-গাদা বাচ্চা-কাচ্চা। মনে হলো, পোলান্ডের সব বাচ্চা এইখানে।

ওয়ারশতে দেখার মতো আরও বেশ কিছু মিউজিয়াম আছে। ইতিহাস জাদুঘর। শিল্পকলার জাদুঘর। সেনাবাহিনী জাদুঘর। ইহুদি জাদুঘর। তবে সামরিক বাহিনীর জাদুঘরে গিয়ে মনে হলো- সামরিক বাহিনীকে যদি সত্যি সত্যিই জাদুঘরে পাঠানো যেতো....আহা!!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ওয়ারশকে হিটলার গুড়াগুড়া করে দিয়েছিলো। সেই ওয়ারশ’র ভগ্নাংশের উপর দাঁড়িয়ে আছে ওল্ড টাউন। নতুন টাউন একদম ঝকঝকে। আমি এতো এতো শহর ঘুরেছি কিন্তু ওয়ারশর মতো উজ্জ্বল শহর দেখি নাই। সেন্ট্রাল পার্ট রাতের বেলাও অনেকটা দিনের মতো জ্বলজ্বলে ।

তো এবার ফেরত আসি টিমের কাছে। তারা দুইদিনে যথেষ্ট বিরক্ত চাইনিজ ট্যুরিস্টের উপর। চাইনিজ ট্যুরিস্ট আমার বন্ধুমহলে এখন গালিসম। আমরা এবার চাইনিজ ট্যুরিস্টকে পাশ কাটালাম। দিনে কম কম ঘোরা। বিছানায় চিল। রাতে ধুমায়া আড্ডা দেওয়া।

প্রায় ভোররাতে পাঁচজন মিলে খুচরা পয়সা চাঁদা তুলে দামি রেস্টুরেন্টে পিৎজা খাওয়া। রাস্তায় হিসুর ভান করে পুলিশের দৌঁড়ানি খাওয়া। ড্রাংক ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছ থেকে ফ্রি রাইড নেওয়া। কি করি নাই এই ট্রিপে!

পোলিশরা অনেক ফ্রেন্ডলি। জানি না কেন, পোলিশদের সবাই রেসিস্ট বলে। আমি এমনটা দেখি নাই। হোস্টেলে যাবার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। জিজ্ঞেস করতেই হেল্প পেলাম। সাথে কফি খাবার ইনভাইটেশন। এমন শহর এমন মানুষ ইউরোপে পাওয়া খুবই মুশকিল!

ওদের পুরান টাউনে পেলাম শাঁখারি বাজারের ফ্লেভার। রাস্তার উপর নানা রকম উদ্ভট কাপড় পরা লোক দাঁড়ানো। সবাই রেস্টুরেন্টের জন্য কাস্টমার পটাতে ব্যস্ত। কিন্তু যেখানেই যাই খাবারের দাম দেখে হার্টফেল করার অবস্থা। কিন্তু ট্যুরেরও সংবিধান আছে। যে দেশে যাবেন, সে দেশের খাবার খেয়ে দেখতে হবে।

আমার বন্ধু ডানিয়েল আবার এই ক্ষেত্রে এক কাঠি উপরে। সে যস্মিন দেশে যদাচার,শুয়ে বসে নারীচারে বিশ্বাসী ছিলো।

সামর্থের ভেতর খাবারের রেস্তোরাঁ পেলাম। খাবারটা খাঁটি পোলিশ। নাম কাসতকা যেট জাবলকামি। এই নামের ঠিকঠাক উচ্চারণ যে করতে পারবেন, তাকে এই খাবার খাওয়াবো। পয়সা আমার। অর্ধেক রোস্টেড হাঁস সাথে আপেল। অসধারাণ খাবার। দুইজনের জন্যও সামান্য বেশি।

ওল্ড ওয়ারশ পুরোটাই যেন একটা জাদুঘর। ছড়ানো ছিটানো অসংখ্য ভাস্কর্য। ‘পালাস কুলটুরি আই নাউকি’- মানে প্যালেস অফ কালচার অ্যান্ড সায়েন্স। ১৯৫২ সালে রাশিয়া পোলিশদের জন্য উপহার হিসাবে এই বিল্ডিং বানিয়েছিলো।

প্রেসিডেন্ট প্যালেস, ওল্ড টাউনের সবচেয়ে বিখ্যাত মনুমেন্ট। সিগিসমুন্ডস কলাম। ক্যাসল স্কয়ার। রাজা সিগিসমুন্ড তৃতীয় ভাসা। এই ভদ্র রাজালোক ক্রাকাও হতে রাজধানী সরিয়ে ওয়ারশ এনেছিলেন।

গোটা শহরটাকে অনেক চেষ্টার পরও হিটলার ধ্বংস করতে পারেনি। এখনও এই পুরনো শহর অনেকটাই জান্তব। ঢাকার মতো ট্রাফিক জ্যামও আছে। কিন্তু শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাসের সাক্ষীরা সম্পূর্ণ নিরাপদ। কেউ ভেঙে ফেলছেনা।

কিন্তু আমাদের বেপরোয়া লিকলিকে জিভ সব গিলে খাচ্ছে। সাত গম্বুজ মসজিদের ‘অজানা সমাধি’র কোলে বানানো হচ্ছে সাততলা দালান। পৃথিবীর গর্ব সুন্দরবন গিলে খেতে বানাচ্ছি সর্বনাশা কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প।

পৃথিবীর সমান বয়সি এসব শহর ঘুরে আপনাদের সন্তানরা তার প্রত্নত্তত্বের হিসাব চাইবে।  সুকান্তের ‘বোধন’ কবিতার প্রতিটা লাইন জান্তব হয়ে উঠবে। শব্দেরা সাক্ষী হয়ে বলবে-

‘তারপর বহুশত যুগ পরে

ভবিষ্যতের কোনো যাদুঘরে

নৃতত্ত্ববিদ্‌ হয়রান হয়ে মুছবে কপাল তার,

মজুতদার ও মানুষের হাড়ে মিল খুঁজে পাওয়া ভার।’

লেখক: গবেষণা আর লেখালেখির চেষ্টা করেন

লেখকের ই-মেইল: kurchiphool@gmail.com

ফটো ক্রেডিট: নিকি নয়েমান এবং রিনভী তুষার।

রিনভী তুষারের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!