বিদেশ ভালো: জার্মানে বাঙালির কর্মবিলাস

বাঙালি'র বিদেশ বলতেই ছিলো বিলাত। তখনকার সময় সমুদ্রের পানিকে বলা হতো কালা পানি। আর বিদেশ গমন ছিলো কালা কাজ।

রিনভী তুষার,জার্মানির বার্লিন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Dec 2016, 11:50 AM
Updated : 5 Dec 2016, 02:07 PM

রাজা রামমোহন রায়। প্রথম বাঙালি, বলা হয় তিনিই প্রথম শখের বসে এই কালা কর্ম সাধন করে বিলাতে যান। তার কিছুদিন পরে দ্বারকানাথ ঠাকুরও  ব্রিটেনে যান।

উনাদের যাওয়া ছিলো শখ করে।  উচ্চশিক্ষার জন্য চীন গমন করো টাইপ ব্যাপারটা শুরু হয় উনাদের হাত ধরে। দ্বারকানাথ ঠাকুর নিজের খরচে চারজন ছাত্রকে বিলাতে পাঠান ডাক্তারি পড়তে।

আরও একজনের কথা ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়। ঘটনা ১৭৫৯ সালের। এখানে আসলে একজন না বলে দু'জন বলা ভালো। একজন দ্বিপদী মানুষ নামের প্রাণী। আরেকজন চারপেয়ে বাঘসদৃশ প্রাণী।

দুজনই বিলাতে গিয়েছিলেন ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে। তাও আবার বঙ্গমুলুক থেকে ইস্যু করা ওয়ার্ক পারমিট। আমার ধারণা,ওটাই হয়তো বাঙালির প্রথম ওয়ার্ক পারমিটে বিদেশ গমন।

মানুষটার নাম আব্দুল্লাহ। বিড়ালের নাম জানি না। লর্ড ক্লাইভের মনোরঞ্জনে বাঙলার বেঈমান মীরজাফর একটি বন বিড়াল উপহার দিয়েছিলেন। ক্লাইভ আবার তার বসকে খুশি করার জন্য সেই বিড়ালকে পাঠান লন্ডনে।

আব্দুল্লাহ ছিলেন বন বিড়ালের কিউরেটর। বিড়ালসহ আব্দুল্লাহ থাকতেন রাজপ্রাসাদে, রাজপ্রাসাদ ‘টাওয়ার অফ লন্ডন’।

এতোক্ষণ যা বললাম, তা বলার পেছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদেশে কাজের মহিমা বাড়ানো। শুধু চেয়ার-টেবিলে বসে করা কাজই কাজ নয়। জার্মানিতে সব কাজের সমান গুরুত্ব।

জার্মানিতে আমার প্রথম কাজ ছিলো টিচিং অ্যাসিসটেন্টের। নামেই টিচিং অ্যাসিসটেন্ট। আসলে আমার বস ছিলো ফটোকপি মেশিন। তিনি কপি করতেন আর আমি স্ট্যাপল করতাম। আমি ফটোকপিয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য ঘণ্টা ধরে বেতন পেতাম। 

ফটোকপিয়ারের সাথে সময় কাটাতে কাটাতে উনার সাথে আমার প্রেম হয়ে গিয়েছিলো। আমি ঠিক বুঝতাম কখন উনি খারাপ হবেন। কখন ভালো। কখন ঝকঝকে সাদা প্রিন্ট প্রসব করবেন। কখন একটু একটু কালো।

ছাত্র মানুষ। তবুও এক কাজে নিজের একার সংসার চালানো কঠিন। আর আগেই বলেছি শুধু বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতে তো আর জার্মানি আসিনি। কতো কতো জায়গা আছে মুক হবার, মুখ গোঁজার!

এরপর আমার কাজ হলো গেস্ট হাউসে। টিচার অ্যাসিসটেন্ট'র মতো রেগুলার কাজ না। এই কাজের পুরোটাই প্রকৃতিনির্ভর। কিছুটা অদ্ভুত। পাতা কুড়ানির কাজ।

শীতের আগে আগে এখানে গাছের সব পাতা ঝরে যায়। আমার কাজ সেই সব পাতা কুড়ানো। আমি আর আমার জার্মান বন্ধু, দুইজনের এক কাজ। পাতা পরলে পাতা কুড়াও। সেই পাতা ব্যাগে ভরো। ব্যাগে ভরে নির্দিষ্ট একটা গাছের গোড়ায় রাখো। পরদিন সকালেই সেই ব্যাগসমেত পাতা গায়েব।

আমার কাজটা ভীষণরকম বিরক্ত লাগতো। আমার সবসময় মনে হতো পাতা সরানোর মতো পাতা এখনো গাছ থেকে পড়েনি। কিন্তু আমার বসের মনে হতো তার উল্টা।

বসের নাম ছিলো রুথ ভালজ। আমি নাম দিলাম রুথ লেস। কাজটা দেখতে শুনতে যদিও বোরিং। তবে এ কাজের গুরুত্ব ছিলো অনেক।

পাতা না সরালে সেই পাতা বৃষ্টির দিনে পঁচে যেতো। আটকে যেতো কংক্রিটের রাস্তায়। রাস্তা-ঘাট ভয়ংকর রকম পিচ্ছিল করে তুলতো সে পঁচা পাতা। তখন আবার সেই পাতা সরানোর জন্য বিশেষ ড্রায়ারসহ বিশেষ কোম্পানিকে ভাড়া করতে হতো।

তবে আমরা কিছু নির্দিষ্ট পয়েন্টে,নির্দিষ্ট গাছের পাতা কুড়াতাম। আর বাকি পাতা সরাতো সেই বিশেষ কোম্পানি। আগেই বলেছি কাজটা করতে বিরক্ত লাগতো। তাই আমি একটা বিশেষ ফন্দি বার করলাম।

আমাদের কাজের সীমানা আর আর কোম্পানির কাজের সীমানা আলাদা করেছিলো একটা রাস্তা। রাস্তার এপারের পাতা কুড়ানোর দায়িত্ব আমাদের আর ওপারের কোম্পানির। আমি বাংলাদেশ পুলিশের বিখ্যাত 'এই এলাকা আমার থানায় পরে না' থিওরি ফলো করলাম।

পাতা কুড়াতাম সন্ধ্যাবেলায়। আমার জার্মান বন্ধুর কাজ ছিলো মনোযোগ দিয়ে গাছের পাতা জমানো। আর আমার কাজ ছিলো সেই জমানো পাতাকে রাস্তা পার করে নিজেদের থানার বাইরে ফেলে আসা। কম শ্রমে বেশি বেতন।

এই ফাঁকিবাজি করতেও কষ্ট করতে হয়েছিলো অনেক। কারণ,আমার জার্মান বন্ধু। জার্মানরা কাজের বিষয়ে ভয়ংকর রকম নিষ্ঠাবান। ও কিছুতেই এমন ফাঁকিবাজি করতে রাজী হচ্ছিলো না। পরে অবশ্য রাজী করিয়েছিলাম। কিভাবে? কিছু কথা থাকনা গোপন! 

সেই কাজ শীত আসতেই ছেড়ে দিতে হলো। শীতে তো আর পাতা পড়ে না। পড়ে বরফ। বরফের মৌসুমে আমাদের কাজ ছিলো বরফকে জোর করে লবণ খাওয়ানো। বরফ জোর করে গেলানো লবণ খেয়ে গলে গলে পানি হয়ে যেতো।

তবে আমি শীতের শুরুতেই সেই চাকরি ছেড়ে দিলাম। কারণ আমার বরফ ভালো লাগে। বরফ ঝরার দিনে লেপ মুড়ে শুয়ে থাকতে ভালো লাগে। বরফ গলানোর মতো নির্মম কাজ আমাকে দিয়ে হবে না।

এরপর আমার কাজ হলো একটা স্টুডিওতে। সেখানে আমার ম্যালা কাজ। অল্প-স্বল্প ভিডিওগ্রাফি,ফটোগ্রাফি পারতাম। আর পারতাম সাউন্ড ইকুয়েপমেন্টের কাজ।

জীবনের কোন শিক্ষাই ফেলনা নয়। সে সব দিয়েই চলতো। কাজ করতাম কনসার্টে। প্রার্থনা অনুষ্ঠানে। মাঝে মাঝে বিয়েতে। আমাদের সাউন্ড কোম্পানি প্রতি সপ্তাহে চার্চে সাউন্ড সাপ্লাই করে।

একদিন সেই চার্চের অ্যাডমিন আমাকে ডাকলো। বললো, 'যিশুর সেবায় তুমি কি তোমার বেতন কম নিতে পারো না? যিশু খ্রিস্ট নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবেন।’ আমি বললাম, 'তা ঠিক। তবে পয়সা কম নিলে আমার ঈশ্বর না খেয়ে শুকিয়ে যাবে।'

এই জবাবের পর এই রকম পয়সা কমাও টাইপ অফার আর আসেনি। তবে আমি প্রতি সপ্তাহেই মহা আনন্দে গির্জায় কাজ করতে যেতাম। সবার আগ্রহ প্রার্থনায় ছিলো কিনা জানি না। তবে আমার আগ্রহ ছিলো খাবারে।

প্রতিবারই প্রার্থনা শেষে খাবার দেয়া হতো। সেই খাবার আমি পেট এবং পকেট দুটো পুরেই খেতাম।

সামারে আমি পেলাম আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় কাজ।  সেই কাজের গল্প তোলা রইলো পরের সপ্তাহের জন্য।

কাজের বিষয়ে অনেকেই চামড়াকে দোষারোপ করে থাকেন।  বলেন বর্ণপ্রথা'র কথা। তবে আমার অভিজ্ঞতা বলে সাদা চামড়ার চেয়ে বাদামী চামড়ার মানুষ (মানে পূর্ব এশিয়ান) বেশি বর্ণবাদী।

জার্মানরা কাজ এবং সময়, এই দুই বিষয়ে যতোটা সিরিয়াস,জীবনের আর কোন বিষয়ে এতোটা সিরিয়াস কিনা,আমার সন্দেহ আছে।

আমার এখনকার বস একজন ইংরেজ। ভদ্রলোক বিয়ে করেছেন জার্মান। উনার জার্মান স্ত্রী থাকেন জার্মানি। কিন্তু ম্যানেজ করেন তিনজন ইংরেজ বস। সেই তিন ইংরেজই বসেন লন্ডনে।

সেই ইংরেজত্রয় নাকি আমার জার্মান বসের বউয়ের পাঙ্কচুয়ালিটির জ্বালায় অস্থির হয়ে বলেছেন 'তুমি কি দয়া করে একটু ব্রিটিশ টাইম এবং ম্যানেজমেন্ট শিখতে পারো?'

আসুন আমরা খুশি হই। বাঙালির সময় নিয়ে বদভ্যাসের জন্মসূত্র আবিষ্কার করা গেছে। যতো দোষ ইংরেজ ঘোষ।

এখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে রেস্টুরেন্টে কাজ করা। বার্লিনের অনেক রেস্টুরেন্ট নামে ম্যাক্সিকান কিন্তু মালিক বাঙালি।

সেই সব রেস্টুরেন্টে আমার কখনোই কাজ করা হয়নি। যদিও শুনেছি উনারা খুব একটা ভালো বেতন দিতে চান না, তা আপনি বাঙালিই হোন আর জার্মান।

বাংলাদেশে শুয়োর খাওয়া নিষেধ। এমনকি উচ্চারণ করা কিংবা শুয়োর স্পর্শের কিছু খাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। সেই সব বাঙালি পরিবারের ছেলে-মেয়েরা ম্যাকডোনাল্ডস,বার্গার কিং-এ শুয়োরের বার্গার বানায়। বেকন ভাজে। শুয়োরের মাংসের কতো রকমের খাবার হতে পারে,তা জার্মানদের চেয়ে ভালো উনাদেরই জানা।

উনারা বারে,সুপার-শপে মদ বিক্রি করেন। কেউ খুশি মনে, কেউ সংকোচে। জীবন আর জীবিকা কি আর সংস্কার মানে?

বাংলাদেশ পৃথিবীজুড়ে খ্যাত অদক্ষ শ্রমিক রপ্তানীর জন্য। আমার মনে হয় এই রটনাটা ভুল। প্রথম দিকে বিদেশে এসে যে কাজ করতে হয় তার সবই অদক্ষ টাইপ কাজ। সুতরাং এখানে কাউকেই দক্ষ বলার সুযোগ নেই। যদি না আপনি যে কাজে পারদর্শী সেই কাজ নিয়ে আসেন।

কাজের এখানে কোন নারী-পুরুষ নাই। যাহাই নারী তাহাই পুরুষ। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম- এটা এখানে শুধু কর্তৃকারকের উদাহরণ।

রবিঠাকুর তাঁর বঙ্গমাতা কবিতায় বলেছেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি।’ রবী ঠাকুর যদি বাঙালির কর্মমুখীতা বা কাজের প্রবণতা নিয়ে এ কথা বলে থাকেন,তবে বাঙালিকে মানুষ করতে জার্মানি পাঠালেই হলো।

এখানে কাজের বিষয়ে নিয়ম খুবই সাধারণ  'শেইপ আপ অর শিপ আউট'। মানে 'শুধরাও নয় দূর হও'।

তবে এটা ঠিক যে,কালা পানি পাড়ি দেয়া বাঙালিরা জার্মানিতে সেই কর্মযজ্ঞ  চালিয়ে রবী ঠাকুরের আক্ষেপ মুছে যাচ্ছেন দিন রাত।

লেখক: গবেষণা আর লেখালেখির চেষ্টা করেন । 

ইমেইল: kurchiphool@gmail.com

ছবি কৃতজ্ঞতা: রিনভী তুষার