জার্মান প্রেম: এক ফুল দুই মালি

ম্যাক্সিম গোর্কি লিখেছেন- 'মহামারীতে যতো লোক মরে প্রেমে কিন্তু তার চেয়ে কম লোক মরে না'। আব্দুল আলীম গেয়েছেন- ‘প্রেমের মরা জলে ডোবে না।'

রিনভী তুষার, জার্মানির বার্লিন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Nov 2016, 11:44 AM
Updated : 28 Nov 2016, 12:53 PM

শুরুতে একটা গল্প বলি- এক বিবাহিত দম্পতি। স্ত্রী ঘুমানোর আগে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে স্বামীকে জিজ্ঞেস করছেন, "আচ্ছা আমি মরে গেলে তুমি আরেকটা বিয়ে করবে, তাই না?" স্বামী বলেন, "আরে না! মাথা খারাপ! আবার?"

স্ত্রী আনমনে এটা সেটা বলেই যান। শেষে বলেন, "নিশ্চয়ই সেই মেয়েটা রাতের বেলায় শুতে যাবার আগে, এখানে বসে চুল আঁচড়াবে!..."

স্বামীও আনমনে বলে ফেলেন- "আরে নাহ! ওর বয়কাট চুল।"

গল্পের আগে হুদাই কথাবার্তা। খানিকটা ফালতু প্যাচাল। আমার ভালো লাগে। এতে আপনার ধৈর্য্য আরও মজবুত হয়। তবে আমার প্রতিদিনই মনে হয়, একটা সিরিয়াস লেখা লিখি। প্রেম, বিয়ে এসব তো সিরিয়াসই তাই না! এই লেখার কথাই ধরেন। প্রথমে শিরোনাম দিয়েছিলাম- জার্মানিতে প্রেম, বিয়ে এবং অত:পর...। এই শিরোনাম দিয়ে লেখা শুরু করতে আমারই ঘুম পাচ্ছিলো। আপনাদের আর কি বলবো!

জার্মানির প্রেম বিয়ে এসব নিয়ে বাংলাদেশে অনেক আজগুবি গল্প শুনেছি। এরা কেউই বিয়ে করেন না, লিভ টুগেদার করেন। কেউই বাচ্চা নেন না, বাচ্চা দত্তক নেন...এসব। তবে এর সবই মিথ্যা নয়। আবার সব মিথ্যা নয় মানে কিন্তু সব সত্যও নয়।

যেহেতু চোখ আর মাথা দত্তক নেওয়া যায় না সেহেতু নিজে যা কিছু দেখলাম, জানলাম তাই আপনাদের বলি আজ।

আমি ঘটনা এক, রটনা দুই, ব্রাকেটে ছদ্মনাম এসব লিখতে পারি না। তাই সরাসরি ঘটানায় নিয়ে যাই। আরাম লাগে।

জার্মানরা বিয়ে, প্রেম এসবের বিষয়ে বেশ খোলামেলা।

আমার এক জার্মান বন্ধু, নাম স্যামুয়েল। এখানে নাম আমাকে বলতেই হলো। অভিযোগ আছে আমি গল্প করার সময় নাম বলি না। যাই হোক, একদিন সে আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় বললো, "হেই তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।"

এটা বলেই ওর পাশের মেয়েটাকে টেনে ধরে ফরাসি জাতের চুম্বন কষে দিলো। আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। নাহ, এই মেয়ের সঙ্গে তো আমার কখনোই কিছু ছিলো না। আমাকে দেখাবার কী আছে! ও বললো, "নাহ, জনে জনে দেখিয়ে দিচ্ছি কারণ আমরা এখন কাপল।"

এ যেন শামসুর রাহমানের কবিতা, 'তারায় তারায় রটিয়ে দিবো তুমি আমার'।  এদেশে এটা একটা সুবিধাই বটে। বাঙালি কাপল বিয়ের পরও সবার সামনে হাত ধরতে লজ্জা পায়। কিন্তু বিদেশে এসে ট্রেনে, বাসে, হাটে, মাঠে, ঘাটে কয়েক মিনিট পরপরই একজন আরেকজনকে জড়িয়ে স্যামুয়েল আর হানা'র মতোই রটিয়ে দেন- 'তুমি আমার'।

ভালো লাগে। আমি তাদের দেখি আর ভাবি, হুমম একদিন আমিও...। কিন্তু আমি 'হতে চাই' মার্কা গবেষক। আমার জানার বিষয়- জার্মানিতে প্রেম কীভাবে হয়!

প্রেম কীভাবে হয়? জানতে চাইলাম থমাসের কাছে। থমাস কষে একটা চাপড় দিলো পিঠে। বললো- "ব্যথা পেলে?"

আমি বললাম, "নাহ অমৃত। ব্যাটা বদমাইশ। এটা আমার উত্তর?"

ও বললো, "ধরো চাপড়টা তোমাকে বাংলাদেশের মাটিতে মারলাম। ব্যথা কী একই রকম পাবা?" আমি বললাম, "ব্যথার আবার রকমফের কি?" ও বলে, "সেটাই তো কথা। প্রেম কি জার্মানিতে আলাদা করে হয়? নাকি জার্মানির প্রেমটা ঠিক প্রেম নয়?"

আসল কথা হলো থমাস ব্যাটা নিজেও তখন প্রেম করে। কিছুদিন পর বিয়ে। এরা আংটি কিন্তু ডায়মন্ডের কিনেন না। সবাই মনে করেন বিয়ের আংটি মানেই ডায়মন্ডের আংটি। জার্মানরা এদিক থেকে আলাদা।

তিন মাসের বেতন জমিয়ে, পকেট ফাঁকা করে এরা বাংলাদেশিদের মতো আংটি কিনেন না। এদের বিয়ের আংটি একদমই প্লেইন এবং সিম্পল। নো ঢিংচাং ফিংচাং। যারা সামনে বিয়ে করবেন ভাবছেন তারা জার্মান কায়দায় আংটি কিনুন। নিজে বাঁচুন। পকেট বাঁচান।

বলছিলাম থমাসের কথা। থমাসের প্রেম খুবই ম্যাড়ম্যাড়ে। একদমই ল্যাও ল্যাও টাইপ। নো উত্তেজনা। থমাসের মুখে তার প্রেমের বর্ণনা এমন- "একই শহরে ওর আর আমার কিছু বন্ধু থাকতো। সেই শহরের বন্ধুদের কাছে প্রায়ই যেতাম। কয়েকবার পার্টিতে গিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়েছে। কয়েক বছর আগে জানলাম, ও সিঙ্গেল। আমিও তখন সিঙ্গেল। ব্যস, প্রেম হয়ে গেলো।"

জার্মানে প্রেমের বিয়েতে বাপ ভাইয়ের দৌড়ানি নাই। রিকশা ফলো করা নাই। পাড়াত ভায়ের মাইর নাই। ফ্ল্যাক্সিলোডের দোকান থেকে নাম্বার নেওয়া নাই। বাথরুমের দেয়ালে, ক্লাসের বেঞ্চে 'সৈকত+ইন্দিরা' লেখা নাই। লিটন আর রফিকের ফ্ল্যাট নাই। এটা কোন প্রেম হলো! পুরাই ল্যাও ল্যাও। মোটাদাগে জার্মান প্রেম এরকমই।

আমার বন্ধু মার্সেল একটু বেটার। প্রেম করছিলো আমারই বেস্ট ফ্রেন্ডের সঙ্গে। ফ্রেন্ডের নাম! কিছু কথা থাক না গোপন। মেয়েটার আদি নিবাস দক্ষিণ ভারতে। মেয়ে পটাতে মার্সেল তখন দিন-রাত ভারতীয় কালচার গিলছে। মেয়ে যখন পটে গেলো। মার্সেল তখন সরে গেলো। কেন!

সে এক বিশাল স্টোরি। মেয়ের যখন 'দিন কাটে না, রাত কাটে না' টাইপ অবস্থা মার্সেল তখন কিছুদিন বিরহবদনে ঘুরে বেড়ালো। ওইটুকুই। দিন দশেক পর দেখি মার্সেল সুন্দরী ডাইয়ার সঙ্গে। তোমরা দুজন একসঙ্গে! আমার ঘাবড়ানো প্রশ্ন। ওরা বলে, "আমরা দুজন হিব্রু শিখি।"

ডাইয়া কিছুদিন আগেও ইয়োনাথানের সঙ্গে ছিলো। সুতরাং তার তো মার্সেলকে  হিব্রুই শেখানোর কথা। আমরাও কম যাই না। থমাস আর আমি মিলে 'এক ফুল দো মালি' করে দিলাম।

মানে একই পার্টিতে তিনজনকে দাওয়াত দিলাম। ভাব করলাম 'উই অল আর ফ্রেন্ডস'। মার্সেল এবং ইয়োনাথানকে চাপাচাপি করলাম হিব্রু ভাষায় কবিতা পড়তে। প্রেমের কবিতা। দুজনই মানে মানে পালিয়ে গেলো। আর আমার সে ভারতীয় বন্ধু এতোদিন হয়ে গেলো, আহা! এখনো একা। বেচারি এখনও প্রেমের মরা ডোবাতে পারেনি।

এবার জার্মানে বাঙালির প্রেমের গল্প বলার পালা। ঘটনা সত্য। তবে ধার করা। যার জীবনের ঘটনা, আমি নিশ্চিত এই লেখা তিনি পড়বেন। তাই নাম বলা যাবে না। গল্পের খাতিরে মাইর খাবার কোন ইচ্ছা আমার নাই। তো সেই ভদ্রলোকের জার্মান ব্লন্ডের (সোনালি) চুলের সাথে প্রেম করবার অনেক ইচ্ছা।

ইচ্ছা পূরণের সহজ উপায় অনলাইন ডেটিং। সেখানে তিনি গেলেন। উনার বয়স কম। তাই বয়স বাড়িয়ে রেজিস্ট্রেশন করলেন। একজনকে তিনি পেয়েও গেলেন। নাম ম্যারি (মাইরের ভয়ে মিথ্যা নাম)।

ম্যারি তো প্রথমে মানতেই চায়না যে তিনি বয়সে এতো বড়। যাই হোক ম্যারির চাপাচাপিতে তিনি স্বীকার করলেন বয়স। কিন্তু ম্যারি রাগের বদলে খুশি। খুশি'র চোটে বললো, "তুমি আমার আট নাম্বার অফিসিয়াল প্রেমিক।"

আমি ঘটনা জানামাত্র নতুন এই জুটিকে রাতে খাবারের নিমন্ত্রণ করি। ম্যারি ভালো। ব্লন্ড। দৈর্ঘ্যের চেয়ে প্রস্থে বেশ ধনী। তো ঘরে ঢুকেই ম্যারি আমাকে চমকে দিয়ে বাংলায় বললো, "কেমন আছো?" আমি বললাম, "সেহার গুট (মানে বেশ ভালো)। উন্ড দু (এবং তুমি)?" ম্যারি বললো, "আমি মোটা।"

এই শুনে আমার তো মাথা ঘুরে উঠলো। পরিষ্কার ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলাম, "আর ইউ শিওর?" ও বলে, "হ্যাঁ, আমি মোটা।" মনে মনে বললাম, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। আমার বাঙালি প্রেমিক ভাই তার প্রেমিকা ম্যারিকে এমনতরো বাঙলাই শিখিয়েছেন। সাদাকে সাদা বলো। মোটাকে মোটা।

ম্যারি একটা করে খাবার মুখে তুলছে আর বলে উঠছে, "আহ মোটা! মোটা!" প্রেমিকার এমন সত্য ভাষণে বাঙালি ভাইয়ের মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল। আমি ম্যারির ঝাল খেতে পারা আর বাঙলা বলতে পারার প্রশংসা করলাম। ম্যারি বলে, "আমি আরো মোটা বাঙলা শিখতে চাই।"

আমি বললাম, "তুমি গুগল ট্রান্সলেট কেন ব্যবহার করো না?" ও বলে, "নিশ্চয়ই।" আমি বলি, "সবার আগে, তুমি যে মোটা (মানে ভালো)। এটার ঠিকঠাক মানে জেনে নিও।"

বাঙালি ভাই এবার খেপে গেলেন। ভাই আপনি এটা কী করলেন?

আমি বলি, "না, মানে মেয়েটার এতো আগ্রহ।" যাই হোক, প্রেমিক ভাই কিছুটা রাগ করেই কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিলেন। তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে প্রেমিকা নিয়ে কেটে পড়লেন।

ম্যারি স্মার্টফোন ব্যবহার করতো। গুগলের ব্যবহারও ভালো জানার কথা। জার্মান ম্যারি পরদিন সকালে তার প্রেমকে মেরে সেই মরাকে জলেও ডুবিয়ে দিয়েছিলো।

সেই বাঙালি ভাই যদিও সহসা সেটা পারেন নাই। রাগ করে অনেকদিন আমার সঙ্গে কথাও বলেননি। তবে উনার প্রেমের মরা অবশেষে ডুবেছে। যিনি ডুবিয়েছেন তিনি একজন গোড়া ইহুদি জার্মান তরুণী। সেই বাঙালি তরুণ এখন প্রেমে মর মর। 

এবার জার্মানিতে আমার গোপন প্রেমের কথা। গত সপ্তাহের লেখা পড়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের ভবিষ্যত তারকা চারুশিল্পী, বন্ধুবর 'স্বর্গ ভট্টাচার্য' বলেছেন, 'নিজচর্চা' বাদ দাও। দিলাম।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো তার 'অর্ধেক জীবন'-এ বলেই দিয়েছেন, "নিজের জীবনের অনেক কথাই লিখেছি। তাই বলে নিজের সব কথা লিখে দিবো, এমনটা তো বলিনি।"

সুতরাং এখানে আমি সুনীলভক্ত। জার্মানিতে আমার দেখা নারীদের নিয়ে আলাদা করে লিখবো। তবে তার আগে দরকার বুকভরা সাহস আর মাইর না খাবার নিশ্চয়তা। ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে'। পড়ুন 'কে হায় হৃদয় খুড়ে মাইর খাবার সম্ভাবনা জাগাতে ভালোবাসে'।

লেখক : গবেষণা এবং লেখালেখির চেষ্টা করেন।

ইমেইল: kurchiphool@gmail.com