বিদেশ ভালো: মূত্রস্নানে বার্লিনে বর্ষবরণ

নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন আমার না আপনার? এটা জানার আগে আসেন একটু ইতিহাস জানি।

রিনভী তুষার, জার্মানির বার্লিন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2016, 07:21 AM
Updated : 29 Dec 2016, 10:50 AM

পহেলা জানুয়ারি হ্যাপি নিউ ইয়ারের কালচার এই তো সেদিনের।

প্রাচীন মেসোপটোমিয়াতে যিশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ২০০০ বছর আগে ‘নিউ ইয়ার’ পালনের কালচার শুরু হয়। তবে সেটা উদযাপন করা হতো মার্চের মাঝামাঝি। মাঝামাঝি বলতে ভার্নাল ইকুইনক্সের (মানে বসন্তের) আশেপাশের সময়ে।

৭০০ খ্রিস্টপূর্বের আগে জানুয়ারি মাস বলে কিছু ছিলোই না। পৃথিবীর ইতিহাসে জানুয়ারির এক তারিখে ‘নিউ ইয়ার’ উদযাপন করা হয় ১৫৩ খ্রিস্টপূর্বে। রোমের দ্বিতীয় রাজা নুমা পন্টিলিয়াস ক্যালেন্ডারে জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি সংযোজন করেন।

তারপরও ‘নিউ ইয়ার’ উদযাপনের মাস আর সময় নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। মার্চ আর জানুয়ারি নিয়ে হয়েছে ‘তু তু ম্যায় ম্যায়’।

১৫৮২ সাল থেকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আমরা পহেলা জানুয়ারিতেই ‘নিউ ইয়ার’ উদযাপন করি। কিন্তু এটাও সবাই মেনে নেয়নি। ক্যাথলিক রাষ্ট্ররা খুব সহজে মেনে নিলেও মানেনি প্রোটেস্ট্যান্ট রাষ্ট্ররা।

ব্রিটিশরা ১৭৫২ সালের আগ পর্যন্ত এই রির্ফমড ক্যালেন্ডার ফলোই করতো না। মোটাদাগে এই হলো নিউ ইয়ারের ইতিহাস।

ইতিহাস বড় লোভনীয় মিষ্টি। একবার স্বাদ পেয়ে গেলে প্রেমিকা তেলাপোকাসম।

এবার ছোট্ট করে ‘নিউ ইয়ার’ রেজ্যুলশানের ইতিহাস জানিয়ে দেই। যতদূর জানা যায়, প্রাচীন ব্যবলিয়রাই প্রথম ‘নিউ ইয়ার’ রেজ্যুলশনের চালু করে। তবে প্রথম দিকের খ্রিস্টানদেরও এরকম কিছু একটা বিশ্বাস ছিলো বলে জানা যায়।

তবে চোখ ধাঁধানো আতশবাজির ইতিহাস কিন্তু চায়নিজদের দখলে। আতশবাজির জন্ম চীনে। আর উদ্দেশ্য খুবই মহৎ- শয়তান তাড়ানো। দেশে দেশে প্রতি বছর আতশবাজি পোড়ানোর বাহার দেখে পৃথিবীটাকে মাঝে মাঝে শয়তানেরই মনে হয়।

ঢং ঢাং বাদ দিয়া আসল কথায় আসেন। মনে মনে নিশ্চয়ই শ খানেকবার বলা হয়ে গেছে এ কথা।

হুমম.. জার্মানিতে ‘নিউ ইয়ার’কে বলা হয় ‘সিলভেস্টার’। ৩৩৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ত পোপ ‘সিলভেস্টার’ মৃত্যুবরণ করেন। তার নামেই এই দিনের নামকরণ।

বাংলা বর্ষবরণ নিয়ে আছে নানা রকম সংস্কার। কুসংস্কার। জার্মানরাও এ বিষয়ে পিছিয়ে নাই।

বছরের এই দিনে কাপড় ধোয়া মানা। কারন ধোয়া কাপড় মেলে দিলে ওডিনের চলাফেরায় সমস্যা হয়। ‘ওডিন’ ছিলেন উত্তর জার্মানীর প্রধান দেবতা। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন কাপড় ধুইলে কাছের মানুষ মারা যায়!

জার্মানরা এই দিনে ডাল খায়। আর খায় সাওয়ারক্রাউট (এক ধরনের ফার্মেন্টেড বাধাঁকপি)। এই খটমট সাওয়ারক্রাউট বিষয়টা যে ওইদিনই কেন জার্মানদের খাইতে হয়..তা জার্মান জাতি নিজেরাও জানে কিনা সন্দেহ আছে।

অনেক করার মাঝে আরো একটা মজার কাজ জার্মানরা করে। এক টুকরা ছোট মতো সীসার টুকরা, সাথে একটা চা চামচ। মোমের উপর চামচ। চামচের উপর সীসার টুকরা। সীসা গলে তরল। তারপর সেটাকে ঠান্ডা পানিতে স্নান। সীসার যে আকার নতুন বছরের সেই প্রকার। এমনই সংস্কার এখানে।

শুধু শুধু লাফিয়ে লাফিয়ে ‘নিউ ইয়ার’ করলে চলে? ইতিহাসও জানতে হয়। ইতিহাস জেনে আমি আর আমার পাঁচ বন্ধু প্রস্তুত। চলে গেলাম ব্রান্ডেনবুর্গার টর। মানে ব্রান্ডেনবুর্গের দরজা। প্রাচীন বার্লিন ওয়ালের পাশেই।

বন্ধুর দুইজন আমেরিকান (ডানিয়েল দ্য গ্রেট মেয়ে পটান্তিস। জেরেমি দ্য জেন্টলম্যান)। ম্যাক্রিকান মারিও (দ্য মামদোবাজ)। পেরুভিয়ান হোর্হে (র্জজ দ্য চাপাবাজ)। আগের রাতে আমরা পাঁচজন কোথায় যেন ছিলাম। মনে নাই। আসলে মনে করতে চাই না।

সেটা বার্লিনের বাইরে ছিলো। সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে কয়েকটা স্টেশন ঘুরে ঘুরে বার্লিন যাবার স্টেশন বার করলাম। ট্রেনে বিন্দুমাত্র জায়গা নাই। সবার হাতে হাতে আতশবাজির মাল-মশলা।

বলে রাখি জার্মানিতে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য ২৭ ডিসেম্বর থেকে আতশবাজি বিক্রি শুরু হয়। সেটা ফোটানো যায় দুই দিন। ‘সিলভেস্টার’ আর ‘নিউ ইয়ার ইভ’। অন্যদিন ফোটাতে চাইলে? আতশবাজি আপনার কিন্তু মামলা পুলিশের। চোখ বন্ধ। বুঝে নেন।

আমরা ক্লান্ত। পারলে  ট্রেনের ফ্লোরেই শুয়ে যাই। দলে দলে সবাই বার্লিনের দিকে। মাত্র একরাত্রের মামলা। সবার গন্তব্য ব্রান্ডেনবুর্গার টর। গেট খোলে দুপুর একটায়। বন্ধ হবে ছয়টা ৩০ মিনিটে। এরপর যতোই ক্রন্দন নো প্রফিট।

জার্মান পুলিশ একটা অভিশাপ তখন। আমরা পৌছালাম পাঁচটায়। সারা রাস্তায় ভয়ংকর টেনশনে ছিলাম। কারণ পাঁচ জনের কারোরই সাথে টিকেট নাই। স্টুডেন্ট কার্ডও নাই। ধরা পরলে নির্ঘাত জরিমানা।

প্রায় দুই কিলোমিটারেরও বেশি জায়গা জুড়ে লোক সমাগম। শুনলাম প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ আসবে। ১৭ কোটির দেশের মানুষ। ১৫ লক্ষ কোন বিষয় হলো?

কিন্তু আস্তে আস্তে টের পেলাম ১৫ লক্ষে কতো কোটি! যতো মানুষ তার চেয়ে বেশি শীত। তার চেয়েও বেশি অজানা অচেনা মানুষের ওমের আকুতি।

ডেনিয়েলকে আমরা আগেভাগেই আজ রাতের জন্য মাফ করে দিয়ে রেখেছি। হ্যান্ডসাম ছেলের বছরের শুরুতে একটা উড়তা বান্ধবী না হলে সারা বছর বাজে যাবে। নে বাবা চরে খা।

 

জেরেমি আর আমি দুই বন্ধু মিলে একটা ষড়যন্ত্র করলাম। মামদোবাজ মারিও আর চাপাবাজ হোর্হেকে আমরা হারিয়ে ফেলবো। কারণ জার্নি শুরুর এই পর্যন্ত একটা পয়সার মুখও তার দুজন আমাদের দেখায়নি। কথা মতো কাজ। ওরা হারিয়ে গেলো। হারিয়ে কয়েকবার ফোন দিলো। কিন্তু আমাদের তো নেটওয়ার্ক থাকে না! তার উপর আবার মানুষের কিচিরমিচির। 

হারাধনের দুটি ছেলে। আমি আর জেরেমি। হঠাৎ জেরেমি বলে -চলো ম্যাকডোনাল্ডসে যাই।

-ওকে চলো যাই। তবে আমি খাবো না। হিসু করবো।

-আমিও তাই।

আজকের রাতে একজন ভিলেন মহাশয় আমাদের মাঝে আছেন।  রাজাধিরাজ হিসু। যার কাছে নাথিং ইজ ইস্যু। প্রতিটা টয়লেটে লম্বা লাইন।

ম্যাকের টয়লেট ইউজিং চার্জ একটু আগেও ৫০ সেন্টস ছিলো। এখন গুনে গুনে এক ইউরো। যা হোক পয়সার চেয়ে ইজ্জত বড়। মানির মান টয়লেট রাখে।

আবার আর্চওয়ে। আবার সিকিউরিটি চেক। ভেন্যুতে প্রবেশ। এবার নো ড্রিংকস পলিসি।

চিল্লাচিল্লির চোটে কার গান শুনছি। কার গানে নাচছি কিছুই বুঝতে পারলাম না। জেরেমি বললো বুঝে কাজ নাই। পরে দেখে নিবো কে কে আসছিলো গাইতে আর নাচতে।

যতদূর চোখ যায় মানুষ আর মানুষের কাঁধে বাচ্চা-কাচ্চা। আমরা একটা জায়গায় নোঙর গাড়লাম। আসলে দাঁড়ালাম। বসার কোন জায়গাই নাই। লোহার ফ্রেমের বেড়া। ক্রাউড ম্যানেজমেন্টের জন্য। সেই বেড়ায় পালা করে দুই বন্ধু পশ্চাত ঠেকাচ্ছি।

শীতের ধাক্কায়  টেকা দায়। সাথে যোগ হলো দুইজন তরুণী। মানুষের সাথে মানুষের উষ্ণতা বিনিময় যে একটা অতীব জরুরি বিষয় সেই শিক্ষা সে রাতে আমরা লাভ করলাম।

ডারউইনের থিওরি ফলো করে ভালোই সময় কাটাচ্ছি। হঠাৎ দেখি জেরিমি আমাকে আস্তে আস্তে ঠেলছে। আমি ভাবলাম এম্নি এম্নি । কিন্তু নাহ ! সিরিয়াস। একবার ভাবলাম উষ্ণতা সেইমসাইড হয়ে গেলো না তো। নাহ! এবার আর পারা গেলো না।

- জেরেমি পারিমাউল ( জেপি)। হোয়াটস রঙ।

- নাথিং, জাস্ট মুভ ম্যান।

- হোয়াই?

- আই থিংক আই গট স্পটেড।

- স্পটেড? স্পটেড বাই?

- আই থিংক সাম আগলি ফ্যাগটস স্পটেড মি।  দেখো আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

আমি তাকালাম। একটু দাঁত বের করলাম। এই রে। ভুল হয়ে গেছে। গোটা গ্রুপ আমাদের দিকে।

- ইন্ডিয়ান? হিন্দি?

- নো। উই ডোন্ট স্পিক হিন্দি অ্যাট অল। আমরা ইন্ডিয়ানও না। বলা হয়নি। জেপির বাবা গায়ানিজ। মা আমেরিকান শ্বেতাংগ। জেপি দেখতে একদমই ভারতবর্ষের মানুষের মতো।

- ওহ সরি।

কিন্তু সরি বলেও কেটে পরার নাম নেই। জেপিকে আগাপাশতলা দেখছে। এবার একটু কড়া হলাম। যা বললাম, তার বাংলা তর্জমা হলো- যারেই দেখো কালা, ভাবো বাপের শালা?

ইন্ডিয়ানরা নাই হয়ে গেলো। জেপির মন খারাপ। সবাই ওকে ইন্ডিয়ান ভাবে। আমি বললাম, মন খারাপের কিছু নাই। তোমার খুশি হওয়া উচিত। কারণ তোমারে কেউ ‘পাকি’ (পাকিস্তানি) ভাবে না। ‘পাকি’ লন্ডনে একটা কুৎসিত গালি।

সেই মাহেন্দ্রক্ষণের আগমন। গোটা বার্লিনের আকাশ যেন জ্বলে উঠলো। কান তোলপাড় করা মিউজিক। চোখ ধাঁধানো আতশবাজি। এই হলো নিউ ইয়ার। এই অভিজ্ঞতা ভাষায় বর্ণনার না। বুঝতে হলে আপনাকে বার্লিন আসতে হবে। 

আমরা ট্রেনের টিকেট কাটিনি কারন টিকেট বিক্রি হচ্ছিলো না। আমরা জানতামই না। সারারাত ট্রান্সপোর্ট ফ্রি। কারণ মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়ে মরার চাইতে সরকারের পকেটের কিছু টাকা গচ্চা যাওয়া ভালো। গোটা ইভেন্টাই ফ্রি। লন্ডনের মত না- দশ পাউন্ড করে টিকেট কেটে আতশবাজির নাচন দেখতে হয়েছিলো। দশ পাউন্ডের টিকেট বিশ পাউন্ডে কিনতে হলো। বেচঁলো কে জানেন? জাস্ট গেজ..একটা চায়নিজ মেয়ে। হায় চায়না ..হায় ব্যবসা।

অনুষ্ঠান শুরু সন্ধ্যা সাতটায়। যতোক্ষণ মানুষের নাচন চলবে ততোক্ষণ পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলবে। মানে যতোক্ষণ নায়িকার নূপুর ততোক্ষণ নায়কের দম। এই রাতে সবাই সবার বন্ধু। গোটা আয়োজন মোটামুটি নিখুঁতই। কারণ খুঁত খুঁজতে চাইলে এই ইভেন্ট ভুল জায়গা।

তবে মাহেন্দ্রক্ষণ শেষ হতেই যা দেখলাম তা সারাজীবনেও ভুলবার নয়। লাইন ধরে ছেলে-মেয়ে-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মূত্র বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে।

নববর্ষে এক বছরের ভাত আরেক বছরে খাবার কথা শুনেছি। কিন্তু এইভাবে গণহারে এক বছরের মূত্র আরেক বছরের ত্যাগ! তাও পুলিশের সামনে।

জেপি বললো মানে? পুলিশের সামনে মানে। পুলিশ কি করবে? পুলিশ কি ওদেরকে আবার যার যার মূত্র তার তার ব্লাডারে ফেরত নিতে বলবে? কথায় যুক্তি আছে।

মুহূর্তেই গোটা ব্রান্ডেনবার্গের একপাশ মূত্রে ভেসে গেলো। এ যেন এই ঐতিহাসিক স্থানকে বলা হচ্ছে- লিখে রাখো এক গ্যালন, দিলাম...

জেপি দ্য জেন্টালম্যান সেই দলে যোগ দিলো। আমিও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। অনেক চেষ্টার পরও নো ড্রিংক্স পলিসি কাজ করেনি। তাই সোজা মুত্র উৎসবে। তাছাড়া বার্লিন পুলিশের নাকের ডগায় এহেন কর্ম সাধন বছরে এক বারই করা যায়।

কোন কারণ ছাড়াই আনমনে রবি ঠাকুরের ..এসো হে বৈশাখের ‘অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’ লাইনটা বারবার গুনগুন করে উঠলাম। এ যেন মূত্র স্নানে শুচি হোক ধরা।

বার্লিনের বর্ষবরণ ভোলার মত না। দেশের বাইরে কোথাও ‘নিউ ইয়ার’ উদযাপন করতে চান? তবে বার্লিনকে বেছে নিন। নাহ, বিশ্বসেরা কনসার্ট বা আতশবাজি শো- এর জন্য না। মানুষের জন্য। ওই রাতে সবাই সবার বন্ধু। কতো না জানা না চেনা মানুষের সাথে ছবি তুলেছি। জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে নিউ ইয়ারের গান গেয়েছি। এই অভিজ্ঞতার তুলনা হয় না।

তবে ১ জানুয়ারির বার্লিনেরও তুলনা হয় না। ওই রকম ভাঙাচোরা বার্লিন শুধু ওই দিনই দেখা যায়।

বার্লিন মানুষের শহর। উৎসবের। প্রাণের। আমরা তো মানুষ। আমাদের শেষ আশ্রয় মানুষ। মানুষের কাছেই আমাদের যেতে হবে।

আইন গুয়েকলিসেস নয়েস ইয়ার। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।

লেখক: গবেষণা আর লেখালেখির চেষ্টা করেন

লেখকের ই-মেইল: kurchiphool@gmail.com

ছবি এবং ভিডিও ঋণ: জেরেমি পরিমাউল এবং রিনভী তুষার

রিনভী তুষারের আরও লেখা