দলটির কর্মসূচিগুলো কার্যকারিতা হারাচ্ছে, বলছেন অনেকেই। হতাশ হচ্ছেন কর্মীরা। ভোট হয়েই যাবে, এমন ভাবছেন কেন্দ্রীয় নেতারাও। রুহুল কবির রিজভী অবশ্য বলছেন, নির্বাচন ‘হতে দেওয়া হবে না’।
Published : 10 Dec 2023, 12:02 AM
টানা কর্মসূচি কার্যকারিতা হারাচ্ছে, বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ মামলার আসামি, প্রকাশ্যে এলেই হচ্ছেন গ্রেপ্তার; এ অবস্থায় বিএনপির আন্দোলন আসলে কোন পথে?
দলটির নেতারা এখনও সরকারকে চাপে ফেলতে আশাবাদী, নির্বাচন ঠেকিয়ে দেওয়া যাবে- এমন একটি আশা তারা কর্মী সমর্থকদের এখনও দেখাচ্ছেন। সেই আশার ভিত্তিতেই ভোট ঠেকাতে অবরোধ-হরতালের টানা কর্মসূচি চলছে। যদিও একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলেছেন, বিএনপির আন্দোলন আসলে ‘ভুল পথে।’
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেন মনে করেন, যে লক্ষ্য নিয়ে বিএনপির আন্দোলন চলছিল, সেটির সুযোগ তারা এরই মধ্যে হারিয়ে ফেলেছে। সরকার এখন কোনো চাপে নেই।
তার বিবেচনায়, বিএনপির সামনে এখন কর্মসূচি পাল্টানো ছাড়া বিকল্প নেই।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “হরতাল- অবরোধকে নিরুপায় কর্মসূচি হিসেবে মনে হচ্ছে। তারা একটি অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরির চেষ্টা করছে। কিন্তু অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করে গণআন্দোলন হয় না।”
এক মাসের বেশি সময় ধরে সপ্তাহের মাঝে একদিন আর সাপ্তাহিক ছুটির দিন বিরতি দিয়ে বিএনপি অবরোধ ও হরতাল দিয়ে এসেছে। এসব কর্মসূচির দিনগুলোতে সড়কে গাড়ির চাপ বেড়েছে দিনকে দিন। দূরপাল্লার বাসগুলোও ইদানীং ছাড়তে শুরু করেছে টার্মিনাল থেকে। কিন্তু রাজপথে দেখা নেই বিএনপির নেতাকর্মীদের।
এরই মধ্যে ভোটের তফসিল ঘোষণা হয়েছে, ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে নির্বাচনে এসেছে ২৯টি। এর আগে ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট যখন ভোট বর্জন করেছিল, সে সময় অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ছিল ১২টি।
স্বতন্ত্রের রেকর্ড: প্রতিদ্বন্দ্বিতার হাতিয়ার না শঙ্কার
বর্জনের ভোটে সব আসনেই এবার প্রতিদ্বন্দ্বী পাচ্ছে নৌকা
ওই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে ভোট হয়েছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়; এবার তা হয়নি। মনোনয়ন যাচাই বাছাইয়ে সব আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছে আওয়ামী লীগ।
বহু আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া ক্ষমতাসীন দলের অনেকের মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে বাদ পড়ে যাওয়ার আগে আসনে আসনে ভোটের আমেজও ছিল অনেক বেশি। তবে এখনও শতাধিক আসনে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেই কঠিন লড়াইয়ের আভাস রয়ে গেছে।
এই পরিস্থিতিতে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে বিএনপির কর্মীরাই হতাশ। একজন প্রশ্ন তুলেছেন, কোনো কর্মসূচি ব্যর্থ হলে বিকল্প কোনো কিছু ভেবে রাখা হয়নি কেন?
এক মাসের বেশি সময় হরতাল-অবরোধের মত কর্মসূচির পর রোববার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে দেশজুড়ে মানববন্ধনের ডাক দিয়েছে বিএনপি। বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে নিখোঁজদের স্বজনরা তাতে হাজির হবেন।
তবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়া এ ধরনের জমায়েতের অনুমতির সিদ্ধান্ত দিতে চাইছে না পুলিশ।
আন্দোলন নিয়ে তৃণমূলে নানা প্রশ্ন, কী করবে বিএনপি
রোববারের পর একই সপ্তাহে আরও একটি দিবস আছে, সেটি হল শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৪ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার থাকবে রাষ্ট্রীয় আয়োজন। ফলে ওই দিনেও আন্দোলনের কর্মসূচি থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে জানিয়েছেন বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা।
আত্মগোপনে থাকা ওই বিএনপি নেতা জানান, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগের সময়টুকু ‘নরম’ কর্মসূচিতে থাকছেন তারা। এরপর আবারও ‘কঠোর’ কর্মসূচিতে যাবেন।
সেই কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি বলেন, “সরকারকে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না।”
প্রবীণ সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মনে করেন, ২০২২ থেকে বিএনপির কর্মসূচি সঠিক পথেই ছিল। কিন্তু অবরোধের মত চূড়ান্ত কর্মসূচি দিয়ে খেই হারিয়েছে তারা।
তিনি বলেন, “এক বছর আগে বিএনপি যে আন্দোলন করছিল, তারা কিন্তু বেশ ভালো এগিয়ে যাচ্ছিল। তাদের নিষ্ক্রিয় কর্মীরাও সক্রিয় হচ্ছিল, সমর্থকরাও সক্রিয় হচ্ছিল।
“বিএনপিকে অবিলম্বে সেই গণজমায়েতে ফিরতে হবে। তারা ‘জেল ভরো’ আন্দোলন করতে পারত। ব্রিটিশ আমলে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ওই আন্দোলন কিন্তু বেশ সাড়া ফেলেছিল। বিএনপির নেতারা আত্মগোপনে না থেকে গ্রেপ্তার হতে পারতেন। সেটা বরং সরকারকে কিছুটা চাপে ফেলতে পারত।”
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আবদুল মোমেনও মনে করেন, বিএনপির কর্মসূচির প্রভাব নগণ্য।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বিএনপি যেভাবে অবরোধ কর্মসূচি দিচ্ছে এর শেষ কোথায়? এটা তো ‘নো রিটার্নের মতো’ অবস্থায় চলে গেছে।
“বিএনপি অবরোধ ডেকে হঠাৎ হঠাৎ ঝটিকা মিছিল করে আত্মগোপনে চলে যাচ্ছে। কর্মসূচি প্রথম দিকে একটু কড়াকড়ি ছিল। এখন গাড়ি চলছে, মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রয়েছে। তাহলে সরকারের ওপর তো কোনো চাপ সৃষ্টি হচ্ছে না। তাহলে কী দাঁড়াল?”
বিএনপির বিকল্প ভাবনা কি ছিল?
কুমিল্লা উত্তরের বিএনপি কর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজিদা খানম টানা কর্মসূচির বিপক্ষে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এভাবে অবরোধ কর্মসূচির কোনো মানে হতে পারে না। এটার বিরতি দেওয়া প্রয়োজন।
“বিএনপিকে নির্বাচন মাঠ থেকে সরিয়ে নির্বাচন করবে এটা দেশের অনেক মানুষ আগে থেকে ভেবেছে। কিন্তু এর বিপরীতে বিএনপিরও একাধিক কৌশল ঠিক করা উচিত ছিল। অর্থাৎ ‘প্ল্যান এ‘, ‘প্ল্যান বি’ ও ‘প্ল্যান সি’।”
পেট্রোল বোমায় দুর্বিষহ জীবন: তাদের সহায় হবেন কে?
এই কর্মীর বক্তব্য হল, ‘প্ল্যান এ’ কাজ না করলে পরের বিকল্প পরিকল্পনায় যাওয়া যেত। তার বিচেনায় সেটি না থাকায় এখন দল ভুগছে।
তার ভাষ্য, “এখন কী দেখছি? সরকার সাজানো নির্বাচনের সব প্রক্রিয়া করে যাচ্ছে আর বিএনপি অবরোধে পড়ে আছে। এতে করে নির্বাচন তো আর ঠেকানো যাচ্ছে না।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য অবশ্য বলেছেন, “মারপিট, সন্ত্রাস করে সরকারকে পিটিয়ে তাড়াব, সেই নীতি বা পথ আমরা অবলম্বন করিনি। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করব, এটাই আমাদের লক্ষ্য। যারা গণতন্ত্রের বিশ্বাসী, সুশাসনের বিশ্বাসী তারা এই বিষয়টা উপলব্ধি করবেন।
“যারা ভাবছেন, কঠোর কর্মসূচি, মানে জ্বালা-পোড়াও, মারপিট, গান পাউডার দিয়ে যাত্রীবাহী বাসে আগুন জ্বালানো, তারা ভুল ভেবেছেন। আমরা সেই কর্মসূচিতে যাইনি।”
‘জনগণ নির্বাচন রুখে দেবে’
হরতাল-অবরোধের মতো চূড়ান্ত কর্মসূচির কার্যকারিতা কমলেও আন্দোলনে সাফল্যের আশা ছাড়ছেন না বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সরকার যত কৌশল করুক না কেন, একতরফা নির্বাচন করে পার পাবে না। তাদের একতরফা প্রহসনের নির্বাচন যে কোনো মূল্যে রুখে দেবে জনগণ।”
রিজভীও আত্মগোপনে। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে তিনি কর্মসূচি ঘোষণা বা দলের বক্তব্য তুলে ধরছেন ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে। একেক দিন একেক স্থান থেকে লাইভে আসছেন। সেই লিংক সংবাদমাধ্যমকর্মীদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
অবরোধ ও হরতালে সকাল বেলায় গুটি কয়েক কর্মী নিয়ে মিছিলও করছেন রিজভী। একাধিক ভোরে ঢাকায় ঝটিকা মিছিলের পর তাকে দেখা গেছে রাজশাহীতেও। অবরোধ চলাকালেই পরে আবার তিনি ঢাকায় ফিরে অনলাইনে লাইভে এসেছেন।
চল্লিশ জনের ঝটিকা মিছিলে ভোট রুখে দেওয়ার হুঁশিয়ারি রিজভীর
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, ভোট হয়ে যাবে, এটা তারাও মনে করছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা মনে করি, জনগণকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে। সরকার বার বার ‘একতরফা, সাজানো’ নির্বাচন করে যাচ্ছে। আমরা তো ভোট বর্জন করে চেষ্টা করেছি, ভোটে যোগ দিয়েও চেষ্টা করেছি। কিন্তু সংকটের সমাধান হয়নি।
“আমরা মনে করি, এই সরকার থাকলে আমরা যাই বা না যাই, কিছু আসবে যাবে না। তারা সেই সাজানো নির্বাচনই করবে।”
ভুল লক্ষ্যে আন্দোলন?
রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার মোজাম্মেল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি প্রথম থেকেই মনে করেছি, বিএনপির আন্দোলনটা ভুল লক্ষ্যের।
“তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা, সরকার পতন নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে সমাধান নয়, তা তো প্রমাণ হয়েছেই। আমাদের দলগুলো ক্ষমতার বাইরে থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়, আর ক্ষমতায় গেলে এটা চায় না বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে প্রভাবিত করতে চায়, তা তো দেখেছি।”
নির্বাচনে যাওয়ার লক্ষ্য একমাত্র ক্ষমতায় যাওয়া, এটাও মনে করেন না এই বিশ্লেষক। তিনি বলেন, “গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন করলে ক্ষমতায় যেতেই হবে, এটা ভুল। বিরোধী দলে থাকাও তো ক্ষমতাকাঠামোর অংশ।”
মোজাম্মেল বলেন, “জনগণ অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়, তারা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে চায়, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা রাস্তায় নেমে গুলি খেয়ে সরকার পতন চায় না।”
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলছেন, নির্বাচন বর্জন করে তারা কোনো ‘ভুল করেননি’।
“আমরা সঠিক পথে ছিলাম, সঠিক পথেই আছি। আন্দোলন ছাড়া ভিন্ন কোন পথ আমাদের সামনে নেই।”
অবশ্য বিএনপির দুইজন ভাইস চেয়ারম্যান মনে করেন, এই নির্বাচন বর্জনের নীতি ভুল।
আর কতবার নির্বাচনের বাইরে থাকব: শাহজাহান ওমর
আমি শুরু থেকেই জয় বাংলার লোক: শাহজাহান ওমর
বিএনপির ভুল ‘অনেক’, সংস্কার দরকার: হাফিজ
বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত: হাফিজ
এদের একজন শাহজাহান ওমর সদস্য দল পাল্টে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন ঝালকাঠি-১ আসনে। তিনি ১৯৭৮ সালেই যোগ দেন বিএনপিতে। দলের হয়ে ১৯৭৯, ১৯৯১, ১৯৯৬ সালের দুটি এবং ২০০১ সালে সংসদ সদস্য হন। বিএনপির সবশেষ শাসনামলে ছিলেন প্রতিমন্ত্রীও।
আরেকজন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ গত ১০ বছর ধরেই বলে আসছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেই রাজনীতিতে পিছিয়েছে তার দল। তিনিও চেয়েছিলেন, তার দল এবার ভোটে আসুক, সে কথা বলেছেন প্রকাশ্যেই।
অবশ্য হাফিজ উদ্দিন কয়েক বছর ধরেই বিএনপিকে অপাংক্তেয়।
‘ভুল’ একাধিক
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “বিএনপি বারবার সময় বেঁধে দিয়ে একটা ভুল করেছে। এটা তাদের নেতৃত্বের অপরিপক্কতা বলে মনে করছি। ওমুক তারিখের মধ্যে এটা করে ফেলব, ওটা করে ফেলব, এসব বক্তব্য আসলে তাদের কর্মীদের মনোবলে শেষ পর্যন্ত চিড় ধরিয়েছে।
“আবার কোনো নির্বাচনে যাব না, সংলাপে যাব না, এটাও ছিল। এমন ‘না বোধক’ অবস্থান নিয়ে কোনো দল কখনও সফল হয়নি।”
নেতৃত্বের সংকট বিএনপিকে ভুগিয়েছে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, “তাদের চেয়ারপারসন সাজাপ্রাপ্ত এবং বন্দি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাজা পেয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন। তাদের (বিএনপি) দেশে একটি কার্যকর নেতৃত্ব তৈরি করা উচিত ছিল।
“লন্ডনে অবস্থানকারী তারেক রহমানের নেতৃত্ব বিএনপির জন্য দুর্বলতা। সক্রিয় কর্মীরা তাকে জিন্দাবাদ দিতে পারে, কিন্তু জনগণের সমর্থন তার ওপর থাকার কথা না।”
বিএনপির রাজনীতির একটি ‘মৌলিক গলদ’ও দেখেন প্রবীণ এই সাংবাদিক। তিনি বলেন, “সেটি হল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করা। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শ ও চেতনাকে গ্রহণ করেও দক্ষিণপন্থি দল চলতে পারে।
“ভারতে কি বিজেপি মহাত্মা গান্ধিকে অস্বীকার করে? কিন্তু তাকে তো তারা আদর্শ মানে না বা পছন্দও করে না।”
বিএনপির কর্মী সমর্থকরা ইদানীং সামাজিক মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ নিয়ে কটাক্ষ ও নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এগুলো আসলে তাদেরকে রাজনীতিতে পিছিয়ে দিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে আসলে কেউ এখানে কার্যকর কিছু করতে পারবে না।”
সরকারও কি পুরোপুরি চাপমুক্ত?
নির্বাচন হয়েই যাবে, এ বিষয়ে এখনই নিশ্চিতভাবে বলতে চান না সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন। তিনি বলেন, “চায়ের কাপ ও ঠোঁটের মধ্যেও অনেক সময় ফাঁক থাকে। নির্বাচন হয়ত তারা করে ফেলতে পারে, আবার হবে না, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”
তবে ভোট হয়ে গেলেও সরকার খুব ভালো অবস্থানে থাকবে বলে বিশ্বাস করেন না তিনি।
এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “সরকার এখন চাপে নেই বলে সব কিছু তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী হবে, বিষয়টা এমনও না।
“আবার নির্বাচন করে ফেলতে পারলেও সরকারের ওপর থেকে অন্য চাপ সরে যাবে না। অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে কথা শুনতে হবে। অর্থনৈতিক যে সংকট এখন আছে, সেটি দুর্বল রাজনৈতিক সমর্থন নিয়ে পার করা কঠিন। ফল হিসেবে দেশবাসী কষ্টে থাকবে।”
ইতিহাস কী বলে
মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “আমরা অতীতে আন্দোলনে দুটি সরকারের পতন দেখেছি। এর দুটিই ছিল সামরিক সরকার। একটি হলো পাকিস্তান আমলের আইয়ুব খানের, আরেকটি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সরকার। কিন্তু গণতান্ত্রিক ধারায় নির্বাচিত সরকারকে কেউ আজ পর্যন্ত উৎখাত করতে পারেনি।
“১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে যে সরকার পদত্যাগ করেছিল, তারাও কিন্তু নির্বাচন করে এসে বিরোধীদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়ে পদত্যাগ করে নির্বাচন দিয়েছিল। সেটাকে সরকার পতন বলা যাবে না।”
বিরোধীদের বর্জনের মধ্যে আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশের ইতিহাসে কেবল একটি নির্বাচনই বানচাল হয়েছে। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নবম সংসদ নির্বাচনের ঘোষিত ভোট হয়নি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের তীব্র আন্দোলনের মুখে দেশে যখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, সে সময় ১১ জানুয়ারি হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী।
বিএনপির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের হাতে সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের দায়িত্বও ছিল। সেনাবাহিনীর চাপে সেই দায়িত্ব ছেড়ে তিনি জারি করেন জরুরি অবস্থা।
এরপর ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে প্রায় দুই বছর দায়িত্বে থেকে নির্বাচন দেয়।
এর আগে বাংলাদেশ বর্জনের ভোট প্রথম দেখে ১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে। সে নির্বাচনে আসেনি বিএনপি। তখন লড়াই হয় রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দল জাতীয় পার্টি বনাম আওয়ামী লীগে।
ভোটের ময়দানে ছিল জামায়াতে ইসলামীও। এই নির্বাচনটি জামায়াতের জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরে নিষিদ্ধ হওয়া দলটি প্রথমবারের মতো নিজেদের নাম ও প্রতীক ব্যবহার করে নামে ভোটযুদ্ধে।
প্রশ্নবিদ্ধ ফলাফলের সেই নির্বাচনের দুই বছরের মধ্যে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগ। ১৯৮৮ সালে আবার বাজে ভোটের বাদ্য।
সেই বছরের চতুর্থ সংসদ নির্বাচন একই সঙ্গে বর্জন করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বামপন্থি দলগুলো এবং জামায়াতে ইসলামী। বড় দুই দলের সম্মিলিত শক্তিতেও ঠেকানো যায়নি ভোট।
সেই নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধী দল নামে জোট করে অংশ নেন এখন বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা জেএসডি প্রধান আ স ম আবদুর রব।
ওই নির্বাচনের পৌনে তিন বছরের মাথায় অবশ্য গণ আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন এরশাদ।
১৯৯৪ সালে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তোলে, তখন অগ্রাহ্য করে বিএনপি। বিরোধীদের জোরাল অসহযোগ আন্দোলনে সারা দেশ বলতে গেলে অচল হয়ে পড়লেও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করে বিএনপি সরকার। টানা দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন খালেদ জিয়া।
সেই সংসদ একটি মাত্র অধিবেশনে বসার পর তা ভেঙে দেওয়া হয়। সেই সংসদে পাস হয় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। ১২ জুন আরেকটি নির্বাচন হয়। তাতে জিতে ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ।
২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার দুই বছরের অভিজ্ঞতার পর ২০১১ সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়। এরপর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে নির্বাচিত সরকারের অধীনে ভোটের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়।
এর প্রতিবাদে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে জোরাল আন্দোলনে যায় বিএনপি-জামায়াত জোট। ব্যাপক সহিংসতা হতে থাকে দেশজুড়ে। একের পর এক পেট্রোল বোমা হামলায় মানুষের চলাচল হয়ে পড়ে অনিরাপদ।
এর মধ্যেও ঘোষণা হয় নির্বাচনের তফসিল। ভোটের আগে আগে এবং ভোটের দিন বিভিন্ন এলাকায় হামলা হয় কেন্দ্রে। তার আগেই অবশ্য ১৫৩টি আসনে প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
৫ জানুয়ারি ভোটের দিন হামলা পাল্টা হামলায় নিহত হন ২১ জন। কিছু আসনে ফলাফল ঘোষণা করা যায়নি।
সাত দিন পর নতুন সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আসতে থাকে পরিস্থিতি। আন্দোলন স্থগিত করে বিএনপি।
সেই নির্বাচনের এক বছর পূর্তির দিন ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ফের অবরোধে ফেরে বিএনপি-জামায়াত জোট। আবার শুরু হয় সহিংসতা, পেট্রোল বোমা হামলা। গাড়িতে আগুন, প্রাণহানি, চালক ও যাত্রীদের ঝলসে যাওয়া ছিল এক নিত্য ঘটনা। কিন্তু এই আন্দোলন ভেঙে পড়ে দুই মাসের মধ্যে। একই সঙ্গে ডাকা হরতাল ও অবরোধ প্রত্যাহার না করেই ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যোগ দেয় বিএনপি-জামায়াত জোট।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “আসলে গাড়িতে আগুন দিয়ে সরকারকে চাপে ফেলা যাবে না। যতদিন এভাবে চলবে, ততদিন সরকার চাপমুক্ত থাকব। সরকার চাপে থাকত যদি তারা (বিএনপি) জনগণকে মাঠে নামাতে পারত।”
৩২ নয়, ভোটে আসা দলের সংখ্যা ২৯টি: ইসি
বিএনপির ভবিষ্যৎ খুবই অনিশ্চিত: শাহজাহান ওমর
বিরোধী দল কারা হবে? কাদের বললেন ‘দাঁড়িয়ে যাবে’