বিএনপি ছেড়ে আসা নেতার দাবি, তিন শর্তে ভোটে যেতে রাজি থাকার কথা বলেছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরে কী হয়েছে, তা তিনি জানেন না।
Published : 30 Nov 2023, 09:25 PM
নাটকীয় ‘ইউটার্নে’ বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে এসে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর কোনো চাপের কথা অস্বীকার করেছেন শাহজাহান ওমর। প্রশ্ন তুলেছেন, তিনি আর কতবার নির্বাচনের বাইরে থাকতেন।
বিএনপির ২০১৪ সালে নির্বাচনে যাওয়া উচিত ছিল বলে মত প্রকাশ করে তিনি জানান, বিএনপি এবার যেন ভোটে আসে, সে জন্য কারাগারে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা ইতিবাচক মনোভাবও দেখিয়েছিলেন। পরে কী হয়েছে জানেন না।
আগামী ৭ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে সামনে রেখে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন বৃহস্পতিবার নৌকার প্রার্থী হিসেবে ঝালকাঠি-১ আসনে মনোনয়পত্র জমা দেওয়ার পর গণমাধ্যমের সামনে আসেন বিএনপির সাবেক এই ভাইস চেয়ারম্যান।
সন্ধ্যায় কারওয়ান বাজারে নিজের আইন পেশার চেম্বারে শাহজাহান ওমর বলেন, “এই মুহূর্ত থেকে আমি আর ‘বিএনপি ম্যান’ নই।”
‘‘আই উইথ দ্য হ্যাপি হার্ট আফটার ফোরটি ফাইভ ইয়ার অব বিএনপি সার্ভিস, আই হেয়ার বাই ডিক্লেয়ার… আই অ্যাম নো মোর অ্যা বিএনপি ম্যান। আই রিজাইন ফ্রম অল পোস্ট অব বিএনপি।”
ভোট বর্জনে বিএনপির নীতির সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে দলটির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, “‘আর কতবার আমরা নির্বাচনের বাইরে থাকব? বিএনপির দোষ-গুণ বিবেচনার সামর্থ্য আমার নাই। আমি মনে করি, বিএনপির ২০১৪ সালে নির্বাচনে যাওয়া উচিত ছিল। ২০১৮ সালে যাওয়া মিসটেক ছিল এবং এবার যাওয়া উচিত ছিল।
‘‘নির্বাচনে গিয়ে দেখতাম কত প্রকার কারচুপি হয়, জালিয়াতি হয়… সেটা পরীক্ষা হতো। জনগণ দেখত বিএনপি নির্বাচনে আসছিল ভোট সুষ্ঠু হয়নি, কারচুপি হয়েছে।”
২০২২ সালেই রাজনীতি করবেন না জানানোর পর মির্জা ফখরুল তাকে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেন বলেও জানান শাহজাহান ওমর। বলেন, “এখন আমার বয়স ৭৭। নির্বাচন আবার আসছে। তা কী করার আছে? বিএনপি তো নির্বাচনে যাচ্ছে না।”
তিন শর্ত মানলে ভোটে যেত বিএনপি?
এক প্রশ্নে শাহজাহান ওমর বলেন, “আমি আন্দোলন করেছি একটা অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য, যে নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করতে পারে।”
বিএনপিকে ভোটে আনতে রাজি করাতে অনেক চেষ্টা করেছেন উল্লেখ করে তিনি জানান, তিনটি শর্তে ভোটে আসতে রাজি ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, ‘‘আমি মহাসচিব (মির্জা ফখরুল), মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মজিবুর রহমান সরোয়ার কেরানীগঞ্জে (ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার) একসঙ্গে ব্রেক ফাস্ট করলাম। সেখানে আমি বলেছি, নির্বাচনে যাওয়া উচিত।
“মহাসচিব (ফখরুল) বললেন, ‘হ্যাঁ যাব, তিন কন্ডিশন। ম্যাডাম খালেদা জিয়ার মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার, ফ্রি ফেয়ার নির্বাচনের একটা অঙ্গীকার বা প্রেক্ষাপট’।
‘‘আমরা এগ্রি করেছি। পরে আমি, আলাল (মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল), আলতাফ চৌধুরী (আলতাফ হোসেন চৌধুরী) কাশিমপুরে (কারাগার) গেলাম। এরপর আমরা আলাদা আলাদা, উনারা কী করেছে জানি না।”
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ২০১৪ সালের মতো এবারও ভোট বর্জনের ডাক দিয়েছে বিএনপি। সঙ্গে আছে সাবেক ২০ দলীয় জোটের বেশিরভাগ শরিক এবং নতুন কিছু দল ও জোট।
গত ২৯ অক্টোবর থেকে বিএনপির টানা অবরোধ ও হরতাল চলছে। এটি চলতেই থাকবে, এমন ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে দলের পক্ষ থেকে।
‘নৌকায় চড়া’ শাহজাহান ওমরকে বিএনপির বহিষ্কার
এক প্রশ্নে শাহজাহান ওমর বলেন, “গত ১৭ বছর আমার এলাকার জন্য আমি কিছু করতে পারিনি। এলাকার লোকজন মামলা-মোকাদ্দমায় জর্জরিত। তারা অতীতে আমাকে এমপি করেছিল। এখন আমার কিছু দায়িত্ব তাদের প্রতি রয়েছে। সেজন্য নির্বাচনে অংশ নিতে আমি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছি।”
নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু হবে বলে মনে করেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘নেত্রী (শেখ হাসিনা) তো বলেন, ইলেকশন ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার হবে।”
‘কীসের চাপ, নো চাপ’
কোনো চাপে পড়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘কীসের চাপ। নো চাপ।”
এটি আকস্মিক কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘২০২২ সালে আমি বিএনপি থেকে পদত্যাগের চিঠি দিয়েছি। তারপরেও আমি বিএনপিতে ছিলাম। নাউ আই ফিল আনকনফোরটেবল উইথ বিএনপি। আমি আওয়ামী লীগে জয়েন করেছি।”
অন্য এক প্রশ্নে শাহজাহান ওমর বলেন, “জিয়ার রাজনীতি ছেড়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে আসা আমি তো মনে করি প্রমোশন, জিয়া্উর রহমানের রাজনীতি থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি বেটার।”
আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ নতুন নয় জানিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সময়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর সঙ্গে অনেকদিন ঘুমিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘‘আমি তো প্রাইম মিনিস্টার বা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কখনো কোনো বক্তৃতায় কিছু বলিনি। গণমাধ্যমের কেউ কেউ খোঁচাতে চেয়েছিল, আমি কখনো বলিনি, নেভার।”
অন্য এক প্রশ্নে জবাব আসে, ‘‘উন্নয়ন একমাত্র ফ্যাক্টর না। উন্নয়ন তো গাদ্দাফিও করেছিল, সাদ্দামও করেছিল। আমি জনগণকে শান্তি দিতে চাই বলে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছি, যেটা এখন নাই।”
তার জামিন আদেশের সঙ্গে ভোটে আসার সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নেই বলেও দাবি করেন সাবেক বিএনপি নেতা।
তিনি বলেন, “সুপ্রিম কোর্টে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে বিচারিক আদালত জামিন আবেদন বিবেচনা করেছে।
“আমার আগে অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন, নিতাই রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন…তিন আইনজীবী আগাম জামিন পেয়ে জেলা আদালতে হাজির হয়েছেন, জামিন পেয়েছেন। আমি জামিন পেয়েছি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বিবেচনায়।”
সেনাবাহিনী থেকে মেজর হিসেবে অবসরে যাওয়া শাহজাহান ওমর পরে আইন পেশায় জড়ান। তিনি একজন ব্যারিস্টারও, যাকে ২০১৬ সালে বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান পদ দিয়েছিল।
বুধবার বিকালে জামিন পেয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কারামুক্ত হওয়ার পর থেকে গুঞ্জন ছিল শাহজাহান ওমর নির্বাচন অংশ নেবেন। বৃহস্পতিবার সকালে তিনি পরিবারসহ গণভবনে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।
এ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি মুচকি হেসে তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হতেই পারে।”
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষের পর গাড়ি পোড়ানোর মামলা ৫ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন শাহজাহান ওমর। ২৪ দিন পর বুধবার বিকালে জামিনের আদেশ এলে সন্ধ্যাতেই মুক্তি পান তিনি।
পরের দিন বিকালে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত মনোনয়নপত্র ফেইসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়।
গত রোববার আওয়ামী লীগ যে ২৯৮টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে, সেখানে ঝালকাঠি-১ আসন দেওয়া হয় তিনবারের সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুনকে। তবে শেষ মুহূর্তে তা পাল্টেছে ক্ষমতাসীন দল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরত্বের জন্য বীরউত্তম খেতাব পাওয়া শাহজাহান ওমর ১৯৭৯ সালে বিএনপির হয়ে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনে ঝালকাঠি-১ আসনে একটি ছাড়া সব কটিতেই বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। কেবল ২০০৮ সালে অন্য একজনকে প্রতীক দেয় দলটি।
তারেক রহমানের নেতৃত্ব প্রসঙ্গ
বিএনপিতে তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছিল কি না, এই প্রশ্নে শাহজাহান ওমর বলেন, ‘‘আমি তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে বলছি না। তরুণ বলেন, সবুজ বলেন আর বৃদ্ধ বলেন, এটা কেমন যেন একটা রাজনীতি। আমার চরিত্রের সঙ্গে মিলমিশ হয় না।
‘‘বিএনপির রাজনীতি ইয়াং ছেলেপেলে কন্ট্রোল করবে নাকি মেধাবী ও রাজনৈতিক সচেতনরা কন্ট্রোল করবে, এটাই আমার ক্ল্যাশ। আমি দেখেছি এখন রাজনীতিতে আছে কচিকাঁচার দল। এটা তো আমি মানতে পারি না। ৭৭ বছর বয়স হয়েছে। জানি কী হবে গড নোজ।”
তাহলে কি তারেক রহমানের নেতৃত্ব পছন্দ হয় না বলে দল ছাড়লেন? এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘নট রিয়েলি। শুধু তারেক রহমান একা না। আরও যারা আছে, সব মিলিয়ে আমি তাদের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে পারছিলাম না।”
শাহজাহান ওমর বিএনপিতে জড়িত তার জন্মলগ্ন থেকেই।
এই দলটির প্রতি কোনো পরামর্শ আছে কি না- প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘‘আমি পদত্যাগ করেছি, পরামর্শ দেয় কে?”
শাহজাহান ওমরের মতে উন্নত বিশ্বের আর উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য থাকবে। তিনি বলেন, “আমাদের লোকজন তুলনামূলক গরিব, তুলনামূলক শিক্ষা-দীক্ষায় নিচে, সামাজিক কাজকর্মে নিচে, আমরা ইনডিভিজুয়ালিজমে বিশ্বাস করি, কালেকটিভিজমে বিশ্বাস করি না।
“প্রকৃত পক্ষে আমাদের দেশে ট্রু সেন্স অব ডেমোক্রেসি গ্রো করতে আরও ৩০/৪০ বছর লাগবে।”
‘তৃণমূল বিএনপি-বিএনএম রাবিশ’
এবারের জাতীয় নির্বাচনে আলোচনায় আসা দুই দল তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএমের তীব্র সমালোচনা করেন শাহজাহান ওমর।
তিনি বলেন, ‘‘রাবিশ, এগুলো তো ফিকিন্নি পার্টি। দুই/তিন কোটি টাকা পাইছে, এটা নুইসেন্স। তৃণমূল-বিএনএম-ফিএনএম ননসেন্সিকাল পার্টি, নুইসেন্স পার্টি।”
‘ওদের কী হেডাম আছে’ নিজেই প্রশ্ন করে শাহজাহান ওমর বলেন, ‘‘হেডাম থাকলে ডাইরেক্ট যাও। যেমন আমি একটার সময়ে গেছি (গণভবনে), ২টার মধ্যে তো নেত্রী (শেখ হাসিনা) নমিনেশন দিয়েছে। হেডাম আছে বিধায় তো নেত্রী আমাকে নমিনেশন দিয়েছে এক ঘণ্টার ভেতরে। যেটাকে দিছিল, দিছে কাইট্টা। আই গট এ হেডাম।”
ভোটে জয়ী হতে কতটা আশাবাদী- সে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘আমি নির্বাচনে গেলে নৌকা বলেন, ধানের শীষ বলেন, গলার গামছা দেন, আমি নির্বাচিত হব ইনশাল্লাহ।”
স্বতন্ত্র প্রতীকে নির্বাচন করতে চাননি কেন- এই পশ্নে তিনি বলেন, ‘‘স্বতন্ত্র কেন করব? স্বতন্ত্র মানে নিরপেক্ষ, নিরপেক্ষ বলে কিছু নাই। আমি ডাইরেক্টে বিশ্বাসী। রাস্তায় নেমেছি, ঘোমটা দিয়ে হবে নাকি।’’
‘বেগম জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ দেখি না’
১৯৭৮ সালে বিএনপিতে যোগ দেওয়ার কাহিনীও উঠে আসে সংবাদ সম্মেলনে।
শাহজাহান ওমর বলেন, ‘‘জিয়াউর রহমান আমার টিচার ছিলেন পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে। উনার ডাকে আমি সাড়া দিয়েছি। উনি আমাকে স্নেহ করতেন। বেগম জিয়াও আমাকে স্নেহ করেন। তিনি আমাকে ভালো জানেন। বেগম জিয়ার আমি তো এখন কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ দেখি না।”
তিনি বলেন, ‘‘জিয়া্উর রহমানের রাজনীতি করেছি, হি ওয়াজ গুড ম্যান, ফ্রিডম ফাইটার বীরোত্তম। বেগম জিয়ার রাজনীতি করা সাজে। এরপরে কতখানি সাজে?”
বিএনপি ছাড়লেও এখনও খালেদা জিয়ার মুক্তি চান জানিয়ে তিনি বলেন, “তার মতো একজন নেত্রী একজন অ্যারিস্ট্রোক্রেট লেডি, তিন বার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনি অসুস্থ, ওই ইস্যুতে আমি ঠিকই আছি। আমি তাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানোর পক্ষপাতি।”