২০১৩ ও ২০১৫ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর নির্মম অভিজ্ঞতার মধ্যে আবার ফিরেছে হরতাল-অবরোধ; আবার আগুন দেওয়া হচ্ছে গাড়িতে।
Published : 12 Nov 2023, 12:47 AM
শাহবাগে বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাসে ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর ছুঁড়ে দেওয়া পেট্রোল বোমার আগুনে দগ্ধ ১৯ জনের মধ্যে ছিলেন কলেজছাত্র ওহিদুর রহমান বাবু। তিন দিন পর মৃত্যু হয় তার। তখন নানা মহল থেকে তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও আর্থিক সাহায্য করার কথা বলা হয়েছিল। পরিবারটি জানাচ্ছে, এত দিন পরও সেই সহায়তা জোটেনি।
সেই সময়ে আগুনে পোড়া অনেককেই প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে অনুদান দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি; তাদের সবার পাশে দাঁড়ানো হয়নি সমানভাবে।
তখনও বিরোধীপক্ষের আন্দোলন ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন আর প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে ২০১৩ সাল থেকে হরতাল-অবরোধে সহিংসতা ছিল সেই সময় এক নিয়মিত চিত্র।
যাত্রীবোঝাই চলন্ত গাড়িতে পেট্রোল বোমা বহু পরিবারে নিয়ে আসে বিভীষিকা। আক্রমণের শিকার হয়েছে পণ্যবাহী ট্রাকও।
এসব ঘটনায় ট্রাক ও বাস চালক, শ্রমিক আর যাত্রী মিলিয়ে প্রাণ হারান বিপুল সংখ্যক মানুষ; দগ্ধ হয়ে জীবনটাই পাল্টে গেছে আরও বহু মানুষের। বহু পরিবার উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে আর্থিক সংকটে পড়েছে। বহু পরিবার ট্রমা থেকে বের হতে পারছে না।
কেউ কেউ হাসপাতালে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরলেও হারিয়ে ফেলেছেন স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা, আয় কমে গিয়ে তাদের পরিবারও আছে কঠিন পরিস্থিতিতে।
পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা ছিল; তবে সবাই পায়নি প্রত্যাশিত সহায়তা, ১০ বছর পরেও দ্বারে দ্বারে ঘুরছে বহু পরিবার।
তাদের জীবনের গল্পগুলো খুব কঠিন। একটি ক্ষেত্রে স্বামী হারিয়ে অন্যত্র বিয়ে হয়েছে তরুণীর, তার শিশুকন্যা আবার আলাদা। আরেকটি ক্ষেত্রে এক সন্তান হারিয়ে বৃদ্ধা মা তার অপর সন্তানকে রাজনৈতিক গোলযোগের মধ্যে ঘরের বাইরে যেতে দেন না।
চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে ১০ বছর ধরে শারীরিক নানা জটিলায় ভুগতে ভুগতে জীবন কারও কারও কাছে হয়ে গেছে যন্ত্রণাক্লিষ্ট।
২০১৩ ও ২০১৫ সালে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর কেউ কেউ এখনও সহায়তার আশায় ধর্ণা দিচ্ছে এখানে সেখানে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই দেশের মানুষ ভুলে যায়। ওই লোকগুলোকে মনে হয় সবাই ভুলেই গেছেন।”
‘নাশকতার সংবাদ, দুর্ঘটনা কোনো না কোনো রাজনৈতিক পক্ষকে উপকৃত করছে’ মন্তব্য করেন তিনি বলেন, “নাশকতায় আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারকে সহায়তা দিতে হবে।”
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ২০১৩ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই বছর বিভিন্ন যানবাহনে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের কারণে এবং বোমা বানাতে গিয়ে দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলসহ দেশের সাতটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৯৭ জনের মধ্যে ২৫ জন মারা যান।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর একটি বছর কাটে মোটামুটি স্বস্তিতে। তবে সেই নির্বাচনের এক বছর পূর্তিতে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ফের অবরোধ, পরে হরতাল এবং এরপর একসঙ্গে হরতাল ও অবরোধে মানুষের জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ। ফের পেট্রোল বোমায় ঝলসে যেতে থাকে জীবন, পণ্যবাহী গাড়ি এমনকি মুরগি বোঝাই গাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
এক দশক পর দেশ আবার ফিরেছে সেই টানা অবরোধের বৃত্তে। ২০১৩ ও ২০১৫ সালের তুলনায় সহিংসতা এখন পর্যন্ত কিছুটা কম। ২৯ অক্টোবর হরতালের পর দুটি কর্মদিবস বাদ দিয়ে প্রতিদিনই বিরোধী পক্ষের অবরোধের মধ্যে জীবন ও জীবিকা নিয়ে ভয়ে কাটছে দেশের মানুষের।
এরই মধ্যে শতাধিক বাস পুড়েছে আগুনে। কিছু কিছু ট্রাকেও হয়েছে হামলা। ছোট গাড়িও বাদ যায়নি আক্রমণ থেকে। এরই মধ্যে একজন পরিবহন শ্রমিকের প্রাণ ঝরেছে, বার্ন ইনস্টিটিউটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন আরও একজন। শহর বা আন্তজেলায় কমে গেছে চলাচল, অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ার ধাক্কায় নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবন পড়ে গেছে অনিশ্চয়তায়।
সরকার ও বিরোধী পক্ষ তাদের অবস্থানে অনড়। বিরোধীদের তত্ত্বাবধায়কের দাবি মানা হবে না, বলছে সরকার। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষ বলছে, তাদের কর্মসূচি চলতেই থাকবে।
২০১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত ১৪৬ জন গাড়ি মালিককে ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান দেন। একেকজন সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সহায়তা পান।
ওই অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, অনুদানের জন্য ৮২৩টি ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি মালিক আবেদন করেন। যার মধ্যে ২৮৭টিতে আগুন দেওয়া হয়েছিল, ৫৩৬টি ভাঙচুর করা হয়।
দশম সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধে ১ হাজার ৮০০টি গাড়ি আগুন ও ভাঙচুরের শিকার হয় জানিয়ে সবাই ক্ষতিপূরণ পাবেন বলেও আশ্বাস দেন মন্ত্রী। তবে সবার পাশে দাঁড়ানো যায়নি এই সময়েও।
এসব ঘটনায় সরকার ও বিরোধী পক্ষ এক দশক ধরে কেবল একে অন্যকে দোষারোপ করে গেছে। সরকার পক্ষের মন্তব্য হলো, বিরোধী পক্ষ সাধারণ মানুষের ওপর বেপরোয়া আক্রমণ চালিয়েছে। বিরোধী পক্ষের দাবি, তাদের আন্দোলনের বদনাম করতে সরকারই এজেন্সি দিয়ে এসব ঘটনা ঘটিয়েছে।
প্রতিটি ঘটনায় মামলা হয়েছে, সুনির্দিষ্টভাবে দায়ীদের চিহ্নিত করা যায়নি, নিশ্চিত করা যায়নি সাজাও।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তবে এটাও তো অনুসন্ধান হয়নি এই ঘটনাগুলো আসলে কে করেছে, ক্ষতিগ্রস্তরা কী ক্ষতিপূরণ পেলেন, সেটাও অনুসন্ধান হয়নি।
“কিন্তু এসব ঘটনা কারা ঘটিয়েছে তা সরকারকে প্রমাণ করতে হবে এবং সেই দায় সেই পক্ষের ওপরই চাপাতে হবে।”
এক সন্তান হারানো মা আগলে রাখেন আরেকজনকে
২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর রাজধানীর রামপুরায় লেগুনায় দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা যান ২২ বছর বয়সী চালক মোজাম্মেল হক। তার ভাই মো. সোহেল জানান, তাদেরকে ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে একটি অনুষ্ঠানে ডেকে নিয়ে সান্ত্বনা দেওয়া হয়। তার মা পেয়ারা বেগমকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে পাঁচ লাখ টাকাও দেওয়া হয়েছিল।
সোহেল নিজেও গাড়ি চালক। বলছেন, ভাই মারা যাওয়ার পর তাদের পরিবারে ভয় ঢুকেছে। হরতাল-অবরোধে তার মা তাকে আর গাড়ি চালাতে দেন না।
ওই ঘটনার দুদিন পরেই ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর শাহবাগে বিহঙ্গ পরিবহন বাসে বাইরে থেকে ছুঁড়ে দেওয়া পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হন ১৯ জন। তাদের মধ্যে মারা যান আটজন।
আলোচিত ওই ঘটনায় প্রাণ হারানো ঢাকা কলেজের ছাত্র ওহিদুর রহমান বাবুর পরিবার বলছে, তারা অনুদান পেতে এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তার বড় ভাই মজিবুর রহমান রুবেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার বাবা ওয়াজিউল্লাহ ২০১১ সাল থেকে নিখোঁজ। বাবাকে ফিরে পেতে ভাইটা সব দৌড়াদৌড়ি করত, সবার সঙ্গে যোগাযোগ করত। আমি গ্রামেই থাকতাম। ভাই মারা যাওয়ার পর বাবার খোঁজও বন্ধ হয়ে গেল।
“তখন কতজনে কইছিল সাহায্য করব, ক্ষতিপূরণ দেবে। কিন্তু আমরা একটা টাকাও পাইনি। পরে আমাগো আসনের এমপি সাহেব (নোয়াখালী- ৩ আসনের মামুনুর রশীদ কিরণ) একটা ডিও লেটার দিছে। সেইটাসহ গত ১২ ফেব্রুয়ারিতে আবারও প্রধানমন্ত্রীর অফিসে জমা দিছি।”
প্রধানমন্ত্রী বরাবার পাঠানো ওই ডিও লেটারে ওহিদুর রহমান বাবুকে ‘আওয়ামী পরিবারের সন্তান ও শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের সদস্য’ উল্লেখ করে সংসদ সদস্য মামুনুর রশীদ লেখেন, তিনি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন ও জানেন।
বর্তমানে তাদের পরিবারে আয় রোজগার করার মতো কেউ না থাকায় পরিবারটি ‘নিরূপায়’ বলেও উল্লেখ করেন সংসদ সদস্য।
একই বাসের আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন পোশাক শ্রমিক রবিন মাতবরও। তার স্ত্রী মাবিয়া তখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্ত্রীকে দেখতে মাদারীপুর গিয়েছিলেন রবিন। কর্মক্ষেত্র সাভারে ফেরার পথে এই ঘটনা ঘটে যায়।
রবিনের বড় ভাই নূরে আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রবিনের মৃত্যুর পর তাদেরকে এককালীন এক লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে ৫০ হাজার টাকা তারা বাবা নেন, বাকি টাকা রবিনের মেয়ের নামে রাখা হয়।”
রবিনের স্ত্রীর আরেক জায়গায় বিয়ে হয়েছে, মেয়েটা মায়ের বাসার পাশের একটি আবাসিক মাদ্রাসায় পড়ে।
“সরকার যদি বাপমরা এই মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করে দেয়, তাও হয়,” বলেন নূরে আলম।
১২ ব্যাগ রক্তে জীবন রক্ষা, তবে কমেছে কর্মক্ষমতা
বিহঙ্গ পরিবহনের সেই বাসটির চালক মাহাবুবুর রহমান ঘটনার পর এক মাস হাসপাতালে কাটিয়ে, শরীরে ১২ ব্যাগ রক্ত দিয়ে বাড়ি ফেরেন। এখনও তার দুই হাতে শক্তি কম, তাই বাস চালাতে পারেন না, প্রাইভেট কার চালান।”
মাহাবুব বলেন, “পোড়া দাগগুলো রয়ে গেছে, বাচ্চারা দেখলে ভয় পায়।”
এরপর সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন থেকে তাকে এক লাখ টাকার একটি চেক দেওয়া হয়েছিল। তবে চিকিৎসা করাতে গিয়ে খরচ হয়েছে এর চেয়ে বেশি।
ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট থেকে ১১ দিনের মাথায় তাকে ছাড়পত্র দেওয়ার পর মাহাবুব মিরপুরের বেসরকারি গ্যালাক্সি হাসপিটালে ভর্তি হন। সেখানে ১৫ দিনে বিল আসে দুই লাখ টাকার মতো। আত্মীয়-স্বজন আর শুভাকাঙ্ক্ষীরা সেই টাকা দিয়েছিলেন।
নানা শারীরিক জটিলতার কারণে এক বছর কোন কাজও করতে পারেননি। পরে একজন সেনা কর্মকর্তার পরিবার দয়াপরশ হয়ে তাকে গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ দেন।
ডিউটি তেমন একটা ছিল না। কয়েক বছর ভালোই ছিলেন। কিন্তু গাড়ির মালিক সপরিবারে কানাডায় অভিবাসী হয়ে গেলে বিপদে পড়েন। এখন এক শিক্ষকের গাড়িচালক হিসেবে কাজ করছেন।
২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর দুপুরে যাত্রাবাড়ী থেকে আদমজী রুটে চলাচলকারী কমল পরিবহনের একটি বাসে পেট্রোল বোমা হামলায় নয়জন দগ্ধ হন। তাদের একজন মো. শুভ তখন পড়াশোনা করতেন, এখন চাকরি করেন।
তিনি বলেন, “পুড়ে যাওয়ার পর দীর্ঘ চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। বিভিন্ন মহল থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পরে দেয়নি কেউ।”
শুভ বলছেন, এখনও নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন।
একই বছরের ১০ নভেম্বর লক্ষ্মীবাজার এলাকায় চলন্ত লেগুনায় পেট্রোল বোমার আঘাতে দগ্ধ হন পাঁচজন; একজন মারা যান ঘটনাস্থলেই। দগ্ধদের একজন কামাল হোসেনকে তিন মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল।
দর্জির কাজ করা কামাল হোসেন জানান, কাজ শেষে পোস্তগোলা থেকে ফিরছিলাম। লক্ষ্মীবাজারে একটা স্পিডব্রেকার পার হওয়ার পরপরই গাড়ির ভেতরে ‘বুম’ করে কিছু একটা বিস্ফোরণ হয়ে আগুন ধরে যায়।
হুড়মুড় করে সবাই নামতে গিয়েও পুড়ে যান। মন্টু পাল নামে একজন পুড়ে সেখানেই মারা যান। বাকিরা সবাই কম বেশি পুড়ে যান। ১০ বছর আগের সেই ঘটনা এখনও তাড়া করে ফেরে তাকে।
কামাল হোসেনকে তখন তাকে তিন মাস বার্ন ইউনিটে থাকতে হয়েছে। তার হাতে-পায়ে শরীরের অন্য জায়গা থেকে আলগা চামড়া (স্কিন গ্রাফটিং) লাগানো হয়েছিল। তবে কখনো আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারেননি। শীত এলে চুলকানির কারণে ঘুমাতে পারেন না। চুলকায় বেশি হাতে। গরমে রোদে যেতে পারেন না। কখনও কখনও হাতে-পায়ে তীব্র জ্বালা-পোড়া করে। একটু বেশিক্ষণ পানিতে ভেজা থাকলে হাত বাঁকা হয়ে আসে। নখ দিয়ে চুলকাতে চুলকাতে হাত-পা ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেন।
কামাল হোসেন বলেন, “হাসপাতালে থাকার সময় একবার প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন। তখন ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় হাসপাতালে এসে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে যান। এরপর তিনমাসের বিভিন্ন সময় সরকারি কর্মকর্তা, নেতারা দেখতে এসে দুই-পাঁচ হাজার করে টাকা দিয়ে গিয়েছিল।”
এসব টাকা দিয়েই সামলেছেন তখন চিকিৎসা খরচ। তবে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর আর কেউ তার খোঁজ রাখেনি।
তিনি এই প্রতিবেদককে অনুনয় করে বলেন, “অনেক কষ্টে আছি ভাই। সরকারের কাছে একটু বলেন আমাদের দিকে যেন একটু তাকায়। একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিলেও হয়।”
‘সরকার যদি আমাগো কিছু দেয়’
কুমিল্লার চৌমুহনীর কচুয়ায় ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর রাতে সিএনজি চালিত অটোরিকশায় আগুন দিলে চালক রুবেল মিয়ার শরীরের ২৩ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট আনা হয়েছিল। হাসপাতাল থেকে বাড়িও ফিরেছিলেন। কিন্তু এরপর বাঁচেননি এক বছরও।
ওই অটোরিকশাটির মালিক মো. খোকন জানান, তার গাড়িটি চালকসহ উল্টে ফেলে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চালক রুবেল মিয়া কোনো রকমে জীবন নিয়ে বের হয়ে এসেছিলেন। তাকে ঢাকার বার্ন ইউনিটে নেওয়ার পর লোকজন কিছু সহায়তা করেছিল।
মাসখানেক পর কুমিল্লায় ফিরলেও পাল্টে যায় জীবন। এক দিন গাড়ি চালালে তিন দিন চালাতে পারতেন না। এভাবে কিছুদিন চলার পর ২০১৪ সালের শেষের দিকে মৃত্যু হয় রুবেল মিয়ার।
মো. খোকন জানান, সেই অটোরিকশার আয়ে তার সংসার চলত। পরে এনজিও থেকে ঋণ করে গাড়িটি মেরামত করে রাস্তায় নামাই, খরচ হয় প্রায় তিন লাখ টাকা। তখন উপজেলা প্রশাসন থেকে বলা হয়েছিল ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। তৎকালীন ইউএনও একটা তদন্তও করেছিলেন। সেই তদন্ত প্রতিবেদন পরে ডিসি অফিস হয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের অফিসে পাঠানো হয়। সেখান থেকে সেটি ঢাকায় পাঠানো হয়েছে বলে শুনেছেন তিনি।
খোকন বলেন, “এই ফাইলের পিছে দৌড়ায়া আমার ম্যালা টেকা গেছে। মাঝখান থিকা দুইবার স্ট্রোক কইরা এখন আমি বিছানায়। গাড়ি দ্যাখতে পারি না বইলা অনেকদিন পইরা থাকল (অটোরিকশাটি)। পরে দিছি বেইচা। এখন দুই মাইয়া নিয়া কষ্টে আছি ভাই। আপনারা দ্যাখেন, সরকার যদি আমাগো কিছু দেয়। আমাগো তো অপরাধ আছিল না।”
তাৎক্ষণিক আর্থিক সহয়তার সুপারিশ মানবাধিকার কর্মীর
মানবাধিকার কর্মী ও টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল মনে করেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী মারা গেলে বা কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেললে রাষ্ট্রের উচিত সেই পরিবারের সদস্যদের দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, জীবন ধারণ ও পড়াশোনা যেন ব্যাহত না হয় সেটা নিশ্চিত করার মতো সহায়তা ও সমর্থন দেওয়া।
ক্ষতিগ্রস্তদের অভিজ্ঞতা ও আকুতির কথা তুলে ধরলে সুলতানা কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন, সেটাও সবাই সমানভাবে পান নাই, অনেকেই একেবারে কিছুই পান নাই। অর্থাৎ এই ক্ষতিপূরণ কোনো সুবিন্যস্ত নিয়ম অনুযায়ী দেয়া হয় নাই।”
এসব ক্ষতিপূরণ ‘দয়া-দাক্ষিণ্যের’ মতো হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “নির্দিষ্ট নিয়মানুযায়ী ক্ষতির পরিধি নির্ণয় করে তাৎক্ষণিক আর্থিক সহয়তা দেওয়া যেতে পারে।”