বিএনপি ছেড়ে আসা এই নেতার দাবি, দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ‘নিশ্চয়তা না’ পেয়ে ২০১৪ সালে দলটি ভোটে যায়নি। বিএনপি সরকারি অফিস থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামাতে চায়, সেজন্য দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার।
Published : 08 Dec 2023, 06:01 PM
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে আওয়ামী লীগে আসা শাহজাহান ওমরের দাবি, তিনি শুরু থেকেই ‘জয় বাংলার লোক’। বিএনপি দিয়ে রাজনীতি শুরু করলেও এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালেই ‘নৌকায় চড়তে’ চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন তাকে না নেওয়ায় বিএনপিতে থেকে যান।
টানা ৪৮ বছর বিএনপি করে এলেও দলটির রাজনীতি তার ‘পছন্দ নয়’। তার দৃষ্টিতে, একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বারবার ভোট বর্জন করতে পারে না, তাহলে নেতাকর্মীদের ধরে রাখা সম্ভব নয়।
বিএনপি যেভাবে চলছে, তাতে দলটি জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে বলেও মনে করছেন মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বীরউত্তম খেতাব পাওয়া শাহজাহান ওমর।
তার ভাষ্য, যখন কারাগারে ছিলেন, তখন তার সঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের শীর্ষ নেতাদের ভোট নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। বিএনপি মহাসচিব তিনটি শর্তে ‘রাজিও ছিলেন’। এরপর তাকে অন্য কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে কী হয়েছে তা তিনি জানেন না।
বিএনপির ভোট বর্জনের মধ্যে দল পাল্টে আওয়ামী লীগে আসাকে ‘স্খলন’ হিসেবেও দেখতে চান না শাহজাহান ওমর। তার দাবি, রাজনীতিতে এটা ‘একেবারেই সাধারণ বিষয়’। দেশে দেশে এমন ঘটনা হয়ে আসছে।
গত ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার দিন শাহজাহান ওমরই ছিলেন সবচেয়ে বড় চমক। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপি-পুলিশের সংঘর্ষের পর গাড়িতে আগুনের মামলায় ৫ নভেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৯ নভেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পান। বিএনপির একমাত্র জ্যেষ্ঠ নেতা হিসেবে জামিন পাওয়া নিয়ে সেদিনই শুরু হয় নানা আলোচনা।
পরদিন ঝালকাঠি-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয় শাহজাহান ওমরকে, যদিও তার তিন দিন আগে সেই আসনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনবারের সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মুখোমুখি হয়ে দল বদল, ভোটে আসা এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা শাহজাহান ওমর।
এক সময় তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ইউনিটে, মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য জিয়ার মতোই বীরউত্তম খেতাব আছে তার।
শাহজাহান ওমর প্রথম সংসদ সদস্য হন ১৯৭৯ সালে। এরপর বিএনপি থেকেই ১৯৯১, ১৯৯৬ সালের দুটি নির্বাচন এবং ২০০১ সালে ঝালকাঠি-১ আসনের সংসদ সদস্য হন। ২০০৮ সালে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি, ২০১৮ সালের নির্বাচনে হেরে যান।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর থেকে ছয় মাস ভূমি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তিনি। এরপর হন আইন প্রতিমন্ত্রী। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে শাহজাহান ওমরকে পদ ছাড়তে হয়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনি বলেছেন জিয়ার রাজনীতির চেয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ভালো। সেই হিসাবে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে আসা পদোন্নতি। এই উপলব্ধি নতুন, নাকি আগের?
শাহজাহান ওমর: জিয়াউর রহমান যখন রাজনীতি করেছেন, তৎকালীন সময়ে যুগোপযোগী ছিল। উনি শাহাদাৎ বরণ করার পরে বিএনপির বর্তমান রাজনীতির চেয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি উন্নতমানের। আমি এইটা বোঝাতে চেয়েছি।
৪৮ বছর একটি দল করলেন। সেটি ছেড়ে দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দলে চলে এলেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া কতটা কঠিন ছিল।
মোটেও না, জন স্বার্থে। অনেক বড় বড় নেতা, আপনি জেনে থাকবেন, উইনস্টন চার্চিল, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নায়কও ছিলেন, যুদ্ধের পরে তিনি অন্য দল করেন, দুইবার।
পাকিস্তানের ফাদার অব দ্য নেশন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, উনি প্রথমে কংগ্রেস করেছেন, পরে মুসলিম লীগ করেছেন।
আমাদের বরিশালে শেরেবাংলা ফজলুল হক, তিনি প্রথম করেছেন কংগ্রেস, পরে করেছেন মুসলিম লীগ, পরে করেছেন কেএসপি, পরে করেছেন যুক্তফ্রন্ট।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন, জনস্বার্থে, জনকল্যাণে এগুলো অনেক সময় প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমি মনে করেছি জনস্বার্থে… ।
আমি তো একটা এলাকার প্রতিনিধিত্ব অনেকবার করেছি, কয়েকবার এমপি ছিলাম। এই ১৭ বছরে আমি কিছুই করতে পারিনি।
জাতীয় সংসদ তো বাংলাদেশব্যাপী। হয়ত কোনো নির্দিষ্ট এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়ে আসে। জাতির বর্তমান যে প্রেক্ষাপট, অমুকে ধমকায়, অমুকে স্যাংশন দেয়, ওমুকে এইটা বলে সেইটা বলে। একটা স্বাধীন দেশ, যুদ্ধ করে স্বাধীন করলাম, এই দেশে বিদেশি এসে হস্তক্ষেপ করবে, এটা আমি মেনে নিতে পারি না। আমি মনে করি এটা স্বাধীনতা লঙ্ঘন।
নেত্রী (শেখ হাসিনা) আমাকে বললেন, “আমেরিকা এখানে একটা ঘাঁটি চায়।” তো ঘাঁটি কেন হবে স্বাধীন দেশে? আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি তো ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়।’ আমাদের দেশে বিদেশিরা ঘাঁটি করবে, অন্য দেশে বোমা মারবে, এটা তো স্বাধীন দেশে হতে পারে না। নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে এখানে আমি একমত হয়েছি।
বিএনপি বারবার নির্বাচন বয়কট করে। একটা গণতান্ত্রিক দল তো নির্বাচন করার জন্য, জনমত যাচাই করার জন্য। জনগণ যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয় আমরা দেশ চালানোর দায়িত্ব পাব, আর জনগণ কম দিলে বিরোধী দলে থাকব। কিন্তু নির্বাচনই করব না, এটা কেমন কথা?
আমি সব সময় নির্বাচনের পক্ষে। যার জন্য আমি নেত্রীর (শেখ হাসিনা) প্রজ্ঞায়, রাষ্ট্র চালানোর অভিজ্ঞতায় মুগ্ধ হয়ে দল পরিবর্তন করেছি।
আপনি যে বিএনপি ছাড়লেন, বা আওয়ামী লীগে এলেন, সেই সম্ভাবনার শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?
আমি তো শুরু থেকেই জয় বাংলার লোক। মাঝখানে ৭৯ সালে যখন এমপি হলাম তখন তো আওয়ামী লীগ সেই রকম ছিল না, নেত্রীও তো দেশে ছিলেন না। তখন আওয়ামী লীগ যারা করেছেন, সেভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলেন না। জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে।
জিয়াউর রহমান আমাকে ডাকলেন, “এসে, আমরা একসঙ্গে রাজনীতি করি।”
যেহেতু উনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীর উত্তম এবং আমার শিক্ষকও ছিলেন অ্যাকাডেমিতে, তাই তার ডাকে সাড়া দিয়েছি। উনার শাহাদাৎ বরণের পরে এরশাদের আমলে ৯ বছর আমি রাজনীতিতে যাইনি।
৯১ সালে (এরশাদ পতনের পর পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের বছর) আমি বলেছিলাম আওয়ামী লীগ করব। নেত্রী (শেখ হাসিনা) বললেন, ‘আচ্ছা দেখি’। ‘দেখির’ পর আমাকে আর নিলেন না বা যেতেও পারলাম না।
এরপর বিএনপি থেকেই ৯১ সালে হলাম (সংসদ সদস্য), ৯৬ সালে হলাম, ২০০১ সালে হলাম। এখন দেখা যাচ্ছে (বিএনপি) নির্বাচন করে না। আমার ধারণা হল, নির্বাচন না করলে কর্মীদের বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যায় না।
আরে অপজিশনে গেলে সেটাও তো ক্ষমতার অংশ। অপজিশনে থাকার মানে কী? সরকারি দলের ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া, যাতে তারা সংশোধন হতে পারে। কিন্তু কেউ (ভুল) ধরাবে না, এটা কেমন কথা। সেজন্য আমি বললাম, জনস্বার্থে, দেশের স্বার্থে আমার এই দলে থাকা সমীচীন নয়।
আর সত্যি কথা বলতে কি, এই দলের যে কাঠামো, তার সঙ্গে আমার মিলমিশ হয় না। আমি বিএনপিতে একেবারে অস্বস্তিতে ছিলাম।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক কবে নির্ধারণ হল, সেখানে কী কী কথা হয়েছে?
২৯ (নভেম্বর) তারিখ আমার জামিন হওয়ার পর ৩০ তারিখ উচ্চপদস্থ একজন ফোন করলেন, “স্যার, আপনার সঙ্গে কথা আছে।”
আমি বললাম, “আসো।”
তিনি বললেন, প্রধানমন্ত্রী দেখা করতে বলেছেন, ডেকেছেন। এখন প্রধানমন্ত্রী যদি দেখা করতে বলেন, আমার কি ক্ষমতা আছে ‘না’ করার? সৌজন্যবোধও তো আছে।
আমি ওখানে গেলাম, নানা কথা হল। দেশের রাজনীতি, প্রেক্ষাপট, পররাষ্ট্রনীতি, আমাদের প্রতিরক্ষা নিয়ে নানান আলোচনা হল।
তিনি আমাকে বললেন, “আপনি ইলেকশন করেন।”
আমি বললাম, “ইলেকশন করব কীভাবে?”
বললেন, “স্বতন্ত্র করেন।”
আমি বললাম, “না নেত্রী, স্বতন্ত্র তো কোনো দল না; না ঘারকা, না ঘাটকা। আপনার তিন ভাই শহীদ হয়েছেন, আপনি যদি আমাকে চতুর্থ ভাই হিসেবে গ্রহণ করেন, তাহলে আমি আপনার দলের হয়ে নৌকা মার্কায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারি।”
তিনি (শেখ হাসিনা) বললেন, “ওকে, আলহামদুলিল্লাহ, সাইন ইট।”
সাইন করলাম, চলে এলাম। ভেরি সিম্পল। আর উনি (শেখ হাসিনা) তো আমাকে অনেক আগে থেকেই চেনেন।
বিএনপিতে আপনার পদ ছিল অনেক উঁচুতে, ভাইস চেয়ারম্যানও ছিলেন। আওয়ামী লীগ কি কোনো পদ দিচ্ছে?
আমি তো পদের জন্য যাচ্ছি না। পদ আমার লাগবে কী জন্য? আমি বাংলাদেশের ছেলে হয়ে, বরিশালের ছেলে হয়ে কী না পেয়েছি? আমি পাকিস্তান আর্মির অফিসার, ক্যাপ্টেন; বাংলাদেশ আর্মির মেজর, আমি একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, একজন বীরউত্তম, ব্যারিস্টার, চারবার এমপি হয়েছি, মন্ত্রী হয়েছি। এই দেশের তো আমাকে আর কিছু দেওয়ার জায়গা নাই।
একমাত্র রাষ্ট্রপতি। তো সাহাবুদ্দিন চুপ্পু সাহেব রাষ্ট্রপতি, আমি রাষ্ট্রপতি হব নাকি? ভদ্রলোক সেখানেই থাকুক। আমি সব পেয়েছি, কোনো পদের জন্য আমি যাইনি। এটা আমার চরিত্রও না।
আমি কি বলব যে, ‘আপনার কাছে যাব, আপনি কী খাওয়াবেন বলেন তো?’ এটার জন্য আমি কোথাও যাই না। যদি মনে করে আমার যোগ্যতা আছে, তাদেরকেই ঠিক করতে দেন। হলে হবে, না হলে নাই। কোনো আফসোস নেই।
ভোটে আসা নিয়ে কারাগারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে জানিয়েছেন। আলোচনাটার পরে কী হল?
আমরা তখন ছিলাম কেরাণীগঞ্জ জেলে। আমরা তো ভিআইপি, পাশাপাশি রুম ছিল। সকাল বেলা ব্রেকফাস্ট করলাম একসঙ্গে। আমি প্রশ্ন করলাম, “ফখরুল সাহেব, ইলেকশনে না গিয়ে বারবার কীভাবে বয়কট করবেন?”
সেখানে মির্জা আব্বাস ছিল (বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য), আমীর খসরু (আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী) ছিল, আলতাফ হোসেন চৌধুরী ছিল, সরোয়ার (যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সরোয়ার) ছিল, আরো অনেকে ছিল।
আরও পড়ুন:
আওয়ামী লীগে এসে ‘বুলিংয়ের শিকার’ শাহজাহান ওমর
শাহজাহান ওমরের মনোনয়ন কৌশলগত: কাদের
ফখরুল সাহেব বললেন, “যেতে পারি, কিন্তু কীভাবে যাব?”
আমি তখন প্রস্তাব করলাম, যদি নেত্রীকে (খালেদা জিয়া) মুক্ত করে দেয়, ২৮ অক্টোবরের পর ‘গায়েবি মামলা’ হয়েছে, আমরা তো পুলিশের ওপর হামলা বা বোমাবাজির সঙ্গে জড়িত না, এসব ‘গায়েবি মামলা’ যদি প্রত্যাহার করে আর ফ্রি ও ফেয়ার ইলেকশনের যদি নিশ্চয়তা পাই তাহলে নির্বাচনে যেতে পারি।
আমরা সেখানে সবাই একমত হলাম। তারপর দুই ঘণ্টা পরে আমাকে, আলতাফকে, সরোয়ারকে আর স্বপনকে নিয়ে গেল কাশিমপুরে (গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার)। এরপর আর তাদের সঙ্গে আর কোনো কথা হয়নি। তাদের সঙ্গে অন্য কারো যোগাযোগ হয়েছে কি না, সেটাও আমার জানা নেই।
আপনি এলাকায় গিয়ে বন্দুক নিয়ে একটি বিতর্কে জড়ালেন। এলাকায় গেলে সব সময় বন্দুক আগেও রাখতেন? এই নিরাপত্তাহীনতার বোধ কেন?
ওহো, আমি তো একজন সৈনিক। এই যে পুলিশ অফিসার দেখেন (তার চেম্বারে বসেছিলেন একজন), তার যদি ইউনিফর্ম না থাকে আর অস্ত্র যদি না থাকে, তারে কেউ দাম দেয়? একজন মিলিটারি অফিসারের অস্ত্র তো যেদিন ট্রেইনিংয়ে গেলাম, সেদিন থেকেই। এটা বৈধ অস্ত্র, লাইসেন্স করা অস্ত্র।
এটা আমি সব সময় বহন করি না, গাড়িতেই থাকে। আমি যখন মিটিংয়ে গেলাম, তাকে (সঙ্গী) বললাম, “ভাই এটা রাখ।”
ও ভুল করে হাতে রেখেছে। এটা অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি। এ জন্য আমি দুঃখিত।
আপনার নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আপনাকে নিয়ে অনেক নেতিবাচক কথা বলেছেন। এবার যখন এলাকায় গেলেন তাদের মনোভাব কেমন ছিল?
আওয়ামী লীগের প্রধান নেত্রী আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন, ছোটামোটা কে কী বলল, আমি তা পাত্তা দিই নাকি? এটা ঘটনা নাকি? যদি আসে তারা ভালো, না আসলেও নেত্রী যখন বলেছেন, আমি লড়াই করব।
আওয়ামী লীগে আসার পর আপনাকে অনেক কটূ কথা শুনতে হচ্ছে। উচ্চ আদালতে আপনার সতীর্থদের আচরণও তো আপনার পক্ষে ছিল না। তারা কদিন আগেও আপনার সমর্থক ছিলেন। এমন সমর্থকই কি চেয়েছিলেন?
কুকুরকে ঘেউ ঘেউ করতে দিন, কী আসে যায়?
বিএনপিকে রেখে ভোটে আসা সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম বলেছেন, তাকে তিন দিনে লক্ষাধিক গালি শুনতে হয়েছে। আপনিও বলেছেন একই ধরনের কথা। যারা গালি দিচ্ছে তারা কী বলতে চায়?
সব কিছু যে সবার মনঃপুত হতে হবে, তা তো নয়। ওদের ভাষা, শব্দ আর উচ্চারণ খুবই নিম্নমানের। তারা বলে ‘বেঈমান’। আরে ঈমান তো আল্লাহর কাছে, ঈমান তো রসুলের কাছে। উনার সঙ্গে আমার মিলল না, উনি কি আমাকে বেঈমান বলতে পারেন? ওরা শব্দচয়ন জানে না।
বিএনপিতে আমার উপরে সাত জন ছিলেন স্থায়ী কমিটিতে। তারপর আবদুল্লাহ আল নোমান। ফলে আমার অবস্থান নয় নম্বরে। সেখান থেকে চলে এলাম। তাতে বিএনপির ওপর একটা আঘাত এসেছে। এটা তারা স্বাভাবিক, সুন্দরভাবে নিতে পারছে না। আমার যুক্তি যতই ভালো হোক না কেন, তাদের কাছে তো ভালো হওয়ার কথা না।
ওরা তো বলবেই, কী আসে যায়? বললে বলুক। কয়েক দিন পরে চুপ হয়ে যাবে।
এই দলবদল নিয়ে বিএনপির নেতাদের কারও সঙ্গে কি আপনার ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনো ধরনের কথা হয়েছে?
এই দলের সঙ্গে আমি মানিয়ে নিতে পারছি না। আমার যে চিন্তা ধারা, আমার যে স্টাইল, এদের সঙ্গে আমার যায় না।
আপনিও বলেছেন, মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদও বলেছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন বিএনপির বড় ভুল ছিল।
অবশ্যই।
সেই নির্বাচনে গেলে কী হত আসলে?
বিএনপি সরকার প্রতিষ্ঠা করত। কিন্তু করেনি কেন জানেন? তারানকো নামে এক লোক (২০১৩ সালে সমঝোতার চেষ্টায় আসা জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত) এসেছিলেন মনে আছে? আর্জেন্টিনার মধ্যস্থতাকারী। উনি বললেন, “আপনারা নির্বাচনে যান। আপনারা সরকার গঠন করবেন।”
আমাদের কেউ কেউ হুজুগে বলে, “আমাদের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে সরকারে নিতে হবে।’
তারানকো বলেন, “আমি সেই নিশ্চয়তা দিতে পারি না। দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিশ্চয়তা দিতে পারি না, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা…।”
আওয়ামী লীগ তো ছোট একটা দল না, কচুপাতার পানি না যে নাড়া দিলে পড়ে যাবে।
দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না দেওয়ায় তারা (বিএনপি নির্বাচনে) গেল না। আমি যতটুকু শুনেছি, ড. মোশাররফ (বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন) আমাকে বলেছেন, জাতির পিতার ছবি প্রতিটি অফিসে আছে, প্রতিটি মন্ত্রীর, প্রধানমন্ত্রীর পেছনে আছে। আমাদের কারো কারো তো অ্যালার্জি।
আমাদের দলে তো নানা মত। কেউ কেউ বলে, ‘ওই ছবি রাখা যাবে না।’
ওই ছবি রাখতে না হলে আপনার দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে। এটা বড় সিদ্ধান্ত। একটা ছবির জন্য দুঃখ এবং আফসোস এবং আক্ষেপ, বিএনপি নির্বাচনে গেল না। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেল না।
আরও পড়ুন:
আর কতবার নির্বাচনের বাইরে থাকব: শাহজাহান ওমর
শাহজাহান ওমরের পাশে বন্দুক নিয়ে বিএনপি নেতা, ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’ দাবি
২০১৮ সালে গেল (একাদশ সংসদ নির্বাচন), যেটা আমি মানা করেছি। ছয়টা এমপি গেল। তারা আবার শপথ না নেওয়ার শপথ নেয়, আবার সেই শপথ ভঙ্গ করে। ভাই, আমি এই তামাশা বুঝতে পারছি না।
এসব বিভিন্ন কারণে আমি বলেছি, আমি এই দলের জন্য উপযুক্ত নই।
তারেক রহমান বা তার অনুসারীদের সঙ্গে আপনি খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না বলে প্রচার আছে। বিষয়টা কতটা সত্য?
কেবল তারেক রহমান না। সে তো অনেক দূরে। তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ তো অনেক কম, মিটিংয়ে হয়ত ভার্চুয়াল দুই একটা হয়। সত্যি বলতে চার-পাঁচজন লোক ছাড়া বিএনপিতে কোনো রাজনীতিবিদ দেখি না।
ধরুন আপনি জিতলেন, সংসদে গেলেন, কী বলবেন আসলে?
যখন যা প্রয়োজন, সেটা বলব। অগ্রিম কী করে বলি? সংসদে গেলে কে কী জিজ্ঞেস করে, কার কী এজেন্ডা, আমি এখন কী করে বলব?
যদিও আপনি বিএনপি ছেড়ে এসেছেন, দলটি যেভাবে চলছে, কী ভবিষ্যৎ দেখেন?
খুবই অন্ধকার। খুবই নিম্নগতি হয়ে যাবে, আরও শেষ হয়ে যাবে। জামায়াত বিএনপিকে গ্রাস করে নিলে আমি অবাক হব না।
শেষ কথা, পিটার ডি হাসকে কি এখনও ভগবান বা অবতার হিসেবে দেখেন?
ওটা আমি মকারি (উপহাস) করে বলেছি। এটা উপমা। (বিএনপির) সবাই বলে, ‘পিটার হাস আমাদের এটা করবে ওটা করবে।’ আমি বারবার বলি যে, নিজের তাকত (শক্তি) থাকলে না পিটার হাস পারবে? ১৯কে তো ২০ করতে পারবে, ১ কে তো ২০ করতে পারবে না।
এটা আমি ব্যঙ্গ করে বলেছি। এটা আমি কখনও বোঝাইনি। যারা বুঝতে পেরেছে, তারা আমার ব্যঙ্গটা ধরতে পেরেছে। যারা বুঝতে পারেনি, তারা বলছে আমি অবতার বলেছি, ভগবান বলেছি। ভগবান একটা মানুষকে বলা যায়?
কিন্তু অনেকে মনে করে তিনি (ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস) সো পাওয়ারফুল, উনি বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়ে যাবেন, এটা কি সম্ভব? কোনোদিন সম্ভব না, যদি না জনগণ…।
আরও পড়ুন:
সাংবাদিকদের ওপর ক্ষেপলেন শাহজাহান ওমর, জড়ালেন তর্কে
আদালতে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের তোপের মুখে শাহজাহান ওমর
জনগণকে তো বিশ্বাস না করে পারা যায় না। নির্বাচনে তো জনগণই দেবে, আমি যদি তাদেরকে আস্থায় নিয়ে আসতে না পারি যে আমার পক্ষে ভোট দাও, আমি তোমাকে সাধ্যমত করার চেষ্টা করব, এই আস্থা না হলে জনগণ ভোট দেয় কাকে?
আজকাল জনগণ তো ভোট দিতে যায় না, ভোট দিয়ে করবে কী? আজকাল যে এমপি হয়, ওরা পার্লামেন্টে যাওয়ার মত কতখানি জ্ঞান রাখে? একেবারে যে নাই তাও নয়, অনেকের আছে, তবে অনেকের একটু ঘাটতিও আছে।
নেত্রী (শেখ হাসিনা) ঠিকই করেছেন। ৭২ জন এমপিকে উনি মনোনয়ন দেননি। যেহেতু উনার ধারণা আছে, উনি সবাইকে চেনেন, যেহেতু তার প্রজ্ঞা বলেছে, যারা এলাকার স্বার্থে, জাতির স্বার্থে ভূমিকা রাখে না, তাদের জায়গায় আমার মনে হয় নতুন প্রার্থী দিয়েছে।