রাশেদ খান মেনন বরিশালের দুটি আসনের একটি পেতে আত্মবিশ্বাসী। রাজশাহী সদরে এবার নিজেদের প্রার্থী চাইছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। জাসদের হাসানুল হক ইনু অনেকটাই নির্ভার।
Published : 04 Dec 2023, 12:22 AM
আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার আগেও ধারণা করা যায়নি এবারের নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনে সবশেষ তিনবারের সংসদ সদস্য বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ছাড় পাচ্ছেন না।
এ আসনে এবার নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম। এরপর মেনন ফিরে যান তার নিজ জেলায়, মনোনয়নপত্র জমা দেন বরিশাল-২ ও ৩ আসনে।
এই দুটি আসনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী আছে। তবে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, একটি আসন মেননকে দেওয়া হবে সেখানে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৩ আসন ওয়ার্কার্স পার্টিকে দেওয়া হয়েছিল। মহাজোটের মনোনয়ন পান ওই সময় দলটির সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান।
আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো চেয়ারম্যান ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ রোববার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে বলেন, “কাল ১৪ দলের বৈঠক, এর পরেই আপনি জানতে পারবেন।”
বরিশাল-২ থেকে ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকেই জয় পান মেনন। তবে পরের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারেননি। ১৯৯৬ সালে সেখানে জেতেন জাতীয় পার্টির গোলাম ফারুক অভি। ২০০১ সালে জয় পান বিএনপির সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।
২০০৮ সালে সেখানে নৌকা নিয়ে জেতেন আওয়ামী লীগের মনিরুল ইসলাম। দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তালুকদার মোহাম্মদ ইউনূস ও একাদশে জয় পান একই দলের শাহে আলম।
অন্যদিকে বরিশাল-৩ আসনে ১৯৯১ থেকে অংশগ্রহণমূলক তিনটি নির্বাচনে জেতেন বিএনপির মোশাররফ হোসেন মংগু।
২০০৮ সালে সেখানে জয় পান জাতীয় পার্টির গোলাম কিবরিয়া টিপু, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের সমর্থনে জেতেন ওয়ার্কার্স পার্টির টিপু সুলতান। ২০১৮ সালে আবার জেতেন জাতীয় পার্টির গোলাম কিবরিয়া টিপু।
বরিশাল-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনূস এবং বরিশাল-৩ আসনে পেয়েছেন বাবুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সরদার খালেদ হোসেন।
এদের মধ্যে তালুকদার ইউনুস ২০১৪ সালে এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে গত নির্বাচনে সেখানে মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হন শাহে আলম তালুকদার।
আগামী ৭ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন জাতীয় পার্টি তাদের নিজের শক্তিতে লড়াই করলে ‘খুশি হবেন’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তবে ১৪ দলের শরিকদের যে ছাড় দেওয়া হবে, সেটাও তিনি বলেছেন।
১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সোমবার সন্ধা ৬টায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে শরিক নেতাদের বৈঠক হবে গণভবনে। সেখানেই সব আলোচনা হবে।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে রাশেদ খান মেনন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকা-৮ আসনে আমি তিনবার জয় পেয়েছি। এবার যেহেতু বাহাউদ্দিন নাছিমকে মনোনয়ন দিয়েছে, আমি বরিশালের দুইটা আসন থেকেই মনোনয়ন নিয়েছি। কোনটা পাব সেটা জোটের সমন্বয় সভার পরে বলা যাবে।”
আওয়ামী লীগের বিরোধিতায় বাদশা, ইয়াসিন
বর্তমান সংসদে ওয়ার্কার্স পার্টির যে তিনজন সদস্য আছেন, তাদের মধ্যে নিজ এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রবল বিরোধিতায় পড়েছেন রাজশাহী-২ আসনের ফজলে হোসেন বাদশা।
তিনি তিনটি নির্বাচনে জিতেছেন আওয়ামী লীগের সমর্থনে। ক্ষমতাসীন দল পাশে না থাকলে তার পক্ষে জয়ী হয়ে আসা সম্ভব কি না, তা নিয়ে আছে সংশয়।
এবার আসনটিতে নিজেদের প্রার্থী দাবি করে আসছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগ। পরে আসনটিতে নৌকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামালকে।
মোহাম্মদ আলী ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শফিকুর রহমান বাদশা, তবে বাছাইয়ে তার মনোনয়ন বাতিল হয়ে গেছে।
ফজলে হোসেন বাদশা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আমরা জোটগতভাবে নির্বাচন করতে চাই। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি আশা করি এবং বিশ্বাস করি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত তিনবারের মত এবারও আমাকে নৌকা প্রতীক দেবেন।”
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘‘ফজলে হোসেন বাদশা তিনবার নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। এবারও হয়ত চাইবেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি খায়রুজ্জামান লিটন মনে করি, এটি রাজশাহী বিভাগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আসন। এই আসনে আওয়ামী লীগের নিজস্ব প্রার্থী থাকাটাই ভালো। আশা করি দলের কেন্দ্র থেকে এটা সুবিবেচনা করা হবে।”
গত নির্বাচনে ঠাকুরগাঁও -৩ আসন ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সভাপতি ইয়াসীন আলীকে দিয়েছিল মহাজোট। তবে আওয়ামী লীগ নেতা ইমদাদুল হক তা মেনে না নিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন। ক্ষমতাসীন জোটে ভোট ভাগাভাগির সুযোগে জিতে যান বিএনপির জাহিদুর রহমান। নৌকা নিয়েও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা পৌনে ৩৮ হাজার ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে থাকেন।
এবার ইমদাদুল হককেই নৌকার মনোনয়ন দিয়েছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ জানিয়ে দিয়েছে, তিনবার শরিকদে ছাড় দেওয়া হয়েছে, এবার আর নয়।
ওয়ার্কার্স পাটির আরেক সংসদ সদস্য মোস্তফা লুৎফুল্লাহর সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফিরোজ আহম্মেদ।
একাদশের জোটের হিসাব
৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিল ২৫৮ জন।
১৪ দলের শরিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫টি আসন পায় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ পায় তিনটি আসন।
বিকল্পধারাও পায় তিনটি আসন।
জাতীয় পার্টি (জেপি) ও তরীকত ফেডারেশন জোটের মনোনয়ন পায় দুটি করে আসন।
বাংলাদেশ জাসদ পায় একটি আসন।
সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসনে মহাজোটের মনোনয়ন দেওয়া হয়।
ইনু ফুরফুরে, শিরীন নন
মনোনয়নের দিক দিয়ে ফুরফুরে মেজাজে আছেন কুষ্টিয়া-২ আসনে জাসদের হাসানুল হক ইনু। তার আসনে প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় এক নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এই আসনটি হাসানুল হক ইনুর জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছে।
তবে গত দুটি নির্বাচনে ফেনী-১ আসন থেকে দুইবার ছাড় পাওয়া জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতারের বিষয়টি ঝুলে আছে।
আওয়ামী লীগের ছাড়ে এই আসনে দুইবার সংসদ সদস্য হন তিনি। তবে এবার আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমকে।
এর আগের দুই নির্বাচনেও নাসিম মনোনয়ন চেয়েছিলেন, কিন্তু তাকে হতাশ করে আওয়ামী লীগ। তাকে মনোনয়ন দেওয়ার পর শিরিন আক্তারের কি সম্ভাবনা কমে গেল?
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে জাসদ নেত্রী বলেন, “আওয়ামী লীগ কাকে মনোনয়ন দিয়েছে সেটা আমি দেখছি না। জোটের বৈঠকে আমার আসন নিয়ে সিদ্ধান্ত আসবে। এখন এই বিষয় নিয়ে কিছু বলার নাই।”
জাসদ সভাপতি ইনু অবশ্য এবার গতবারের চেয়ে বেশি আসনে ছাড় পাওয়ার আশা করছেন। তিনি বলেন, “যে কোনো জিনিস সময়ে সময়ে বাড়ে, কমে না। আমাদের আসন সংখ্যা কমবে না, বরং বাড়বে বলে আশা করছি।”
গত নির্বাচনে জাসদকে তিনটি আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল।
জাসদের আরেকজন সংসদ সদস্য বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন টানা তিনটি জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে ছাড় পেয়েছেন।
গত সংসদ নির্বাচনে জয় পাওয়া বিএনপির মোশাররফ হোসেন ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পদত্যাগ করলে পরের বছরের ফেব্রুয়ারির উপনির্বাচনেও তানসেনকে সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগ।
এ আসনে অবশ্য কাহালু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হেলাল উদ্দিন কবিরাজকে মনোনয়ন দিয়ে রেখেছে ক্ষমতাসীন দল।
নজিবুল বশরের দাবি, তার আসন নিশ্চিত
শরিক জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবারও পিরোজপুর-২ আসনে প্রার্থী হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির নেতা থাকার সময় তাকে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয় দেওয়া হয়েছিল।
২০০৮ সাল থেকে এই আসনে মঞ্জু তার দলের প্রতীক বাইসাইকেল নিয়ে নির্বাচন করে আসছেন। তবে এবার তিনি নৌকা নিয়ে ভোট করতে চান।
আওয়ামী লীগ এই আসনে মনোনয়ন দিয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কানাই লাল বিশ্বাস।
তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী চট্টগ্রাম-২ আসনে টানা দুইবারের সংসদ সদস্য।
আওয়ামী লীগ এই আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের মেয়ে খাদিজাতুল আনোয়ারকে মনোনয়ন দিয়েছে। খাদিজাতুল বর্তমান সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য।
তবে নজিবুল বশর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার আসন নিয়ে কোনো সমস্যা নাই। জোটের বৈঠক হলে আমারটা এবং গতবার দুইটা পেয়েছিলাম এবার আরও বেশি পাব বলে আসা করছি।”
তরীকত মূলত মাজার বিশ্বাসীদের রাজনৈতিক দল। সারা দেশেই তাদের ভক্তকূল আছে। এবং সাধারণত তারা আওয়ামী লীগের পাশেই থাকে সব সময়।
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দীলিপ বড়ুয়া চট্টগ্রাম-১ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা মোশাররফ হোসেন। সেখানে তার ছেলে মাহবুব উর রহমানকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা অবশ্য বলছেন, এই আসনে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কারও মনোনয়নের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন রাজশাহী প্রতিনিধি বদরুল হাসান লিটন]
আরও পড়ুন-
জোট আছে, জোট থাকবে: তরীকত চেয়ারম্যান
কুষ্টিয়া-২ ফাঁকা রাখল আওয়ামী লীগ, নৌকায় ভোটের আশা ইনুর
জোটের আসন ভাগাভাগি কীভাবে, অপেক্ষা আরও এক সপ্তাহ