জিম্মি দশার ৩৩ দিনকে ৩৩ বছর বলে মনে হয়েছে এমভি আবদুল্লাহর নাবিক মোহাম্মদ শামসুদ্দিনের কাছে।
Published : 15 May 2024, 12:15 AM
ভারী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মাঝ সাগরে যখন জলদস্যুরা ঘিরে ধরেছিল, তখন কেবলই মনে হচ্ছিল আর বুঝি ফেরা হবে না ঘরে; বেঁচে ফেরার শঙ্কার মধ্যে চোখে ভাসছিল ফেলে আসা প্রিয়জনদের মুখগুলো।
উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে সোমালিয়া উপকূলে আটকে রাখা জাহাজে অস্ত্রের সামনে ২৩ নাবিকের কেটে যায় ৩৩ দিন। সেই দিনগুলোকে ৩৩ বছর বলে মনে হয় মোহাম্মদ শামসুদ্দিনের কাছে।
জিম্মি অবস্থায় সোমালি জলদস্যুদের সঙ্গে কাটানো ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফেরা এমভি আবদুল্লাহর এই নাবিক বলেন, “দিনের সময়টাও আমাদের পার হত না। সারা দিন জলদস্যুদের অস্ত্রের মাঝখানে থাকতে হত। বার বার মনে হত জীবন নিয়ে স্বজনদের কাছে ফিরতে পারব কি না। ঈদের দিনও নামাজ পড়েছি জলদস্যুদের রাইফেলের মাঝখানে থেকে।”
সেই দুঃসময় পার করে দেশে যে ফিরেছেন, ফের পরিবারের কাছে সুস্থ হয়ে ফিরেছেন, সেটাকেই বড় পাওয়া বলে মনে করেন তিনি।
মঙ্গলবার জিম্মি দশার ৬২ দিন পর তিনসহ তার সঙ্গীরা ফিরেছেন স্বজনের কাছে। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি-১) জেটিতে এদিন কথা হয় শামসুদ্দিনের সঙ্গে। তিনিসহ আরও ২৩ নাবিক ফিরেছেন জলদস্যুদের হাতে জিম্মিদশার অভিজ্ঞতা নিয়ে।
জেটি ঘাটে পা রেখেই প্রিয়জনদের কাছে পেয়ে আবেগ্লাপুত হয়ে পড়েন নাবিকরা। কান্নায় ভেঙে পড়েন বেশির ভাগই। কেউ জড়িয়ে ধরেন মা-বাবাকে; কেউবা প্রিয় সন্তানদের।
আবেগঘন এক পারিবারিক মিলনের মধ্যেই তাদের ঘিরে ধরেন সাংবাদিকরা। আনন্দের মুহূর্তের অনুভূতিগুলো জানতে চান, শুনতে চান তাদের দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা।
নাবিকদের আরেকজন মো. আনোয়ারুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা যখন নামাজ পড়তাম তখনও জলদস্যুরা রাইফেল তাক করে রাখত। একরকম বিভীষীকাময় পরিস্থিতি আমরা পার হয়ে এসেছি।”
নাবিকরা জলদস্যুদের হাত থেকে ৩৩ দিন পর মুক্ত হলেও দেশে ফিরতে লেগেছে তাদের আরও এক মাস। মুক্তির পর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা থেকে নিস্তার পেলেও স্বজনদের অপেক্ষা যেন শেষ হচ্ছিল না। অবশেষে মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে নাবিকদের নিয়ে আসা জাহাজ। আনন্দের লহর ছুটে যায় জেটিঘাটে।
পরিবারের সদস্যরা নাবিকদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। আবেগে জড়িয়ে ধরেন তাদের। কেউবা কপালে চুমু দেন। স্বজনদের সঙ্গে মিলনের খণ্ড খণ্ড দৃশ্য অন্যরকম ভিন্ন এক পরিবেশের সৃষ্টি করে।
শিশুকে কোলে নিতেই গড়িয়ে পড়ে অশ্রু
এমভি আবদুল্লাহর নাবিক নুরুদ্দিনকে বরণ করতে বন্দরে এসেছিলেন তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস। সঙ্গে ছিল আড়াই বছর বয়সী সাদমান নূর। জাহাজ থেকে নামতেই নুরুদ্দিনসহ অন্য নাবিকদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন জাহাজের মালিকপক্ষ এসআর শিপিংয়ের কর্মকর্তারা।
নুরুদ্দিনকে কাছে পেতেই ফুল তুলে দেন তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস; সঙ্গে সঙ্গে সংবাদমাধ্যম কর্মীরা ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন নিয়ে ঘিরে ধরেন এ দম্পতিকে। সাংবাদিকদের কাছে অনুভূতি প্রকাশের ফাঁকে ছেলে সাদমান নূরকে বাবা নুরুদ্দিনের হাতে তুলে দেন মা জান্নাতুল ফেরদৌস।
এসময় ডুকরে কেঁদে ওঠেন নুরুদ্দীন। আড়াই বছরের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। ছেলেটি বাবার বুকে মাথা রেখে চুপ করেছিল; যেন দীর্ঘ দিন পর বাবাকে কাছে পাওয়ায় জড়িয়ে রেখেছে মায়ার বাঁধনে। এ সময় নুরুদ্দিন আর কিছু বলতে পারছিলেন না, ভেঙে পড়েন কান্নায়।
একটু ধাতস্থ হওয়ার পর নুরুদ্দিন জিম্মি থাকার সেই দিনগুলোর কথা তুলে ধরে বলেন, “প্রথম যেদিন জলসদ্যুরা আমাদের জাহাজ আটকে ফেলে সেদিন মনে মনে ভেবেছিলাম, এই বুঝি আমাদের জীবনের শেষ সময়। আর হয়ত দেশে ফেরা হবে না। আর হয়ত ছেলের মুখ দেখতে পারব না।
“আশেপাশে আন্তর্জাতিক বাহিনীর জাহাজ দেখলেই জলদস্যুরা উত্তেজিত হয়ে যেত। তখন তারা আমাদের অস্ত্রের মুখে রাখত। এরকম কয়েকবার খুব ভয় পেয়েছি। আজ দেশে ফিরতে পেরে মনে হচ্ছে যেন সেইসব দিন কোন দু:স্বপ্ন ছিল।’’
সন্তানের জন্য পছন্দের খাবার রেঁধে এসেছেন মা
এমভি আবদুল্লাহর চতুর্থ প্রকৌশলী তানভীর আহমেদের মা জোৎস্না বেগম এসেছেন সন্তানকে বাসায় নিয়ে যেতে। সকাল সকালেই তার জন্য পছন্দের বিভিন্ন পদ রান্না করে এসেছেন। তানভীর জাহাজ থেকে জেটিতে নামার পরই তার মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ”ছেলে সুস্থ হয়ে ফিরছে এটাই বড় পাওয়া। জিম্মিদশা থেকে মুক্তির পর থেকেই তার সঙ্গে প্রতিদিনই কথা হত। এতদিন অপেক্ষায় ছিলাম সে কখন ঘরে ফিরবে।”
তার (তানভীর) পছন্দের গরুর কালা ভুনা, মুরগীর মাংস, ডালসহ বিভিন্ন পদ রান্না করে এসেছেন জানিয়ে আনন্দে আত্মহারা এই মা বলেন, তার ফিরে আসার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
এমভি আবদুল্লাহর আরেক নাবিক আইনুল হক অভির মা লুৎফে আরা বেগমও এসেছিলেন ছেলেকে নিয়ে যেতে। তিনি বলেন, “আমার ছেলে ২০১৬ সাল থেকে জাহাজে কাজ করছে। কোনবার এরকম বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটেনি।
”জলদস্যুরা যখন জাহাজ জিম্মি করছিল তখন ছেলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলাম “
বিপর্যয়কর সেই দিনগুলো কাটিয়ে তার সন্তানসহ অন্যরা সুস্থভাবে দেশে ফিরতে পেরেছেন এতে তিনি খুবই আনন্দিত।
আরও পড়ুন:
ছয়টি একে-৪৭ আর দ্রুত গতির ছোট নৌযানে জিম্মি হয় আবদুল্লাহ
অপেক্ষার অবসান, পরিবারের কাছে ফিরলেন এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা
'চাওয়া পূরণ হওয়ায়' এমভি আবদুল্লাহ ছেড়ে যায় জলসদ্যুরা
আবদুল্লাহর মত বিপদ ভবিষ্যতে যেন আর না ঘটে: হাছান মাহমুদ