জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হওয়ার ৬৪ দিনের মাথায় নাবিকদের নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসার পর সেই ঘটনার কথা বলছিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন।
Published : 14 May 2024, 08:15 PM
ছোট আকারের একটি নৌযান আসছিল দ্রুতই। জাহাজের গতির চেয়ে তিনগুণ বেগে এসে ভেড়ে জাহাজের পাশে। দ্রুতই অস্ত্র হাতে উপরে উঠে যায় জলদস্যুরা। সব কিছুই ‘অনেক দ্রুত’ ঘটে যায়।
অস্ত্রধারী সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার শুরুর ঘটনা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন এমভি আবদুল্লাহর ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ।
"আমরা আক্রান্ত হই তখন সেকেন্ড অফিসার ব্রিজে ছিল। সবকিছু অনেক দ্রুত ঘটে যায়। জলদস্যুরা ৩০-৩৫ মাইল গতিতে এসে ব্রিজে উঠে যায়। আমাদের গতি ছিল ১০ মাইল। যেহেতু পণ্য বোঝাই ছিল," জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হওয়ার ৬৪ দিনের মাথায় চট্টগ্রাম বন্দরে আসার পর বলছিলেন তিনি।
জাহাজের ক্যাপ্টেন বলেন, সোমালি জলদস্যুরা একে-৪৭ নিয়ে উপরে উঠেই তাকে ও সেকেন্ড অফিসারকে আটক করে। পরে অন্যদের অস্ত্রের মুখে এক স্থানে জিম্মি করে পুরো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয়। আবদুল্লাহর গতি কম থাকায় দস্যুদের নৌযানকে এড়ানো যায়নি।
ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ কথা বলছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি-১) জেটিতে তৈরি মঞ্চে। দস্যুদের কবল থেকে সুস্থভাবে ছাড়া পেয়ে ঠিকঠাক দেশে ফেরা ২৩ নাবিককে অভ্যর্থনা জানাতে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সেখানে ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। নাবিকদের হয়ে তিনি শুভেচ্ছা জানান; দুর্বিষহ সেই দিনগুলোর কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, "আমরা আজ মুক্ত হয়ে দেশে ফিরেছি। এ অনুভূতি জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।”
গত ১২ মার্চ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিকে যাওয়ার সময় সোমালি উপকূল থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে জলদস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। অস্ত্রের মুখে জাহাজ ও ২৩ নাবিককে জিম্মি করে দস্যুরা।
জাহাজে জলদস্যুদের আক্রমণের প্রথম ভিডিওতে চিত্রে দেখা যায়, একটি ছোট দ্রুতগতির নৌযান থেকে একজন জলদস্যু অস্ত্র নিয়ে এমভি আবদুল্লাহতে উঠে পড়ছেন।
সেসময় ভারত মহাসাগরের সোমালি উপকূল ও আশেপাশের অঞ্চলে নিরাপত্তায় নিয়োজিত ইইউএনএভিএফওআর-অপারেশন আটলান্টা জানায়, একটি মাঝারি আকারের নৌযান ও কয়েকটি স্পিডবোট নিয়ে এমভি আবদুল্লাহকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
কয়লাবাহী এমভি আবদুল্লাহ সোমালি উপকূলের উচ্চ ঝুঁকির এলাকার বাইরে দিয়ে চলছিল বলে দাবি করেছিল মালিকপক্ষ এসআর শিপিং। তবে জাহাজটিতে কোনো সশন্ত্র নিরাপত্তা কর্মী ছিল না। জাহাজের দু'পাশে তারের বেষ্টনিও ছিল না।
মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বন্দরে ক্যাপ্টেন রশিদ বলেন, "জলদস্যুরা যখন জাহাজে ওঠে তার আগেই অন্য সব নাবিককে নিরাপদ কক্ষে পাঠাই। সেকেন্ড অফিসার ব্রিজে ছিল।
"তারা সেকেন্ড অফিসারের দিকে চারটা একে-৪৭ তাক করে। তখন জানতাম না, পরে জেনেছি এগুলো একে-৪৭। আর আমার দিকে দুইটা তাক করে ধরে।"
জলদস্যুরা জাহাজে ওঠার পরের পরিস্থিতি তুলে ধরে ক্যাপ্টেন বলেন, "আমি বলি- আমরা রোজা, বাংলাদেশি মুসলিম। তখন আর আমাদের তেমন কিছু বলেনি।
"নাবিকরা কান্না করতেছিল। জীবনে প্রথম এরকম ঘটনা। আমারও মনে ভয় ছিল। কিন্তু বডি ল্যাঙ্গুয়েজে তা প্রকাশ করিনি। একটাও অফিসারের যেন ক্ষতি না হয় সে খেয়াল রাখি।"
এমভি আবদুল্লাহর আরেক নাবিক এমডি নাজমুল হক বলেন, "আমাদের জলদস্যুরা শুরুতে ভয়ভীতি দেখাত। পরে সব ঠিক হয়ে গেছে। আমাদের মারেনি, শুধু ভয় দেখাত।"
আরেক নাবিক শামসুদ্দিন শিমুল বলেন, "জিম্মি দশার ৩৩ দিন ৩৩ বছরের মত লেগেছে। জাহাজে হেলিকপ্টার ধ্বংসের অস্ত্র ছিল। তাই খুব ভয়ে ছিলাম।"
শেষ পর্যন্ত সোমালি উপকূলে আটক থাকা অবস্থায় জলদস্যুদের সঙ্গে মুক্তিপণ নিয়ে আলোচনা শেষে ১৩ এপ্রিল রাতে এমভি আবদুল্লাহ ছেড়ে চলে যায় অস্ত্রধারী দলটি। তারপর সংযুক্ত আরব আমিরাতের উদ্দেশ্যে রওনা হয় জাহাজটি।
সেখানে পণ্য খালাস শেষে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুটি বন্দর থেকে পণ্য বোঝাই শেষে দেশের পথে রওনা করে এমভি আবদুল্লাহ। সোমবার সন্ধ্যায় কুতুবদিয়া চ্যানেলে নোঙর করে পণ্য খালাস শুরু করে জাহাজটি। পরদিন জিম্মি ২৩ নাবিক একটি ছোট জাহাজে (লাইটার) করে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়, যেখানে অধীর আগ্রহে তাদের অপেক্ষায় ছিলেন স্বজনরা।
অপেক্ষার অবসান, পরিবারের কাছে ফিরলেন এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা