“স্বজনদের কাছে পেয়ে, দেশের মাটিতে পা দিয়ে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে, যা প্রকাশ করা যাবে না,” বলেন জাহাজের চিফ অফিসার।
Published : 14 May 2024, 07:03 PM
জেটিতে ভেড়া জাহাজ থেকে নেমে এলেন হাসিমুখে, অপেক্ষায় থাকা সন্তানদের জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন; বললেন, দুঃসহ এক সময় পার করে ফিরেছেন মুক্ত জীবনে।
ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি দশার অভিজ্ঞতা নিয়ে সন্তানদের কাছে ফিরে এভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করলেন এমভি আবদুল্লাহর চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান।
আতিকুল্লাহকে নিতে এসেছিল তার দুই মেয়ে ফাতেমা, উনাইজা এবং ছোট ভাই আবদুর নুর খান আসিফ। জাহাজ থেকে নেমেই দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন তিনি।
পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমরা একটা বীভৎস সময় পার করে আলোয় এসেছি। স্বজনদের কাছে পেয়ে, দেশের মাটিতে পা দিয়ে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে- প্রকাশ করা যাবে না।”
সোমালি জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছেন মঙ্গলবার বিকালে, যাদের জন্য দুই মাস ধরে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় দিন কেটেছে স্বজনদের।
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি-১) জেটিতে বিকাল ৪টায় ভেড়ে নাবিকদের বহনকারী জাহাজটি। এর আগে সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় কুতুবদিয়ায় নোঙর করে এমভি আবদুল্লাহ। সেখান থেকে লাইটার জাহাজ জাহান মনি-৩ নাবিকদের নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়।
চট্টগ্রামে পৌঁছানোর পর নাবিকদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। আগে থেকেই অপেক্ষায় থাকা স্বজনরাও নাবিকদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতা থেকে বেঁচে ফিরে পরিবারকে কাছে পেয়ে এসময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন নাবিকরা।
সাধারণত নাবিকরা ছয় মাস বা আরো বেশি সময়ের জন্য জাহাজে করে দেশ ছেড়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যান। জাহাজ ভেড়ে বিশ্বের নানা বন্দরে। তাই দীর্ঘ সময় প্রিয়জনদের অনুপস্থিতিতে খানিকটা অভ্যস্ত থাকেন নাবিকদের স্বজনরা। কিন্তু এবারের ফেরা অন্য রকম।
জেটি ঘাটে আতিকুল্লাহ খানের দুই মেয়ে তাদের বাবাকে কাছে পেয়েই জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। বাবার হাতে ফুল তুলে দেয় তারা।
ছোট মেয়ে উনাইজা সাংবাদিকদের বলে, “বাবাকে কাছে পেয়ে ভালো লাগছে। দীর্ঘদিনের অপেক্ষা ফুরাল। বাবার জন্য চমকও রয়েছে আমাদের পক্ষ থেকে।”
বড় মেয়ে ফাতেমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, “আমার খুব ভালো লাগছে। সেটা বুঝাতে পারব না। বাসায় দাদি ও মা আব্বুর জন্য ভালো ভালো রান্না করেছে। বাসায় যাবার পর আমি বোনদের নিয়ে বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাব।”
আতিকুল্লাহর ছোট ভাই আসিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জিম্মিদশা থেকে মুক্তির পর থেকেই আমরা অপেক্ষায় ছিলাম কখন ভাইয়া আসবে। গত এক সপ্তাহ ধরে মা-ভাবিসহ ঘরের সবার সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। ভাইয়া প্রতিবারই জাহাজে গিয়ে দীর্ঘদিন পর দেশে ফেরেন, কিন্তু এবারে তার আসাটা অন্যরকম।”
জিম্মির খবরের পর থেকেই পুরো পরিবার উৎকণ্ঠায় ছিল জানিয়ে আসিফ বলেন “রোজার শুরু থেকেই টেনশনে ছিলাম। যখন জলদস্যুরা জাহাজ ছেড়ে দেয় তখন অন্যরকম আনন্দ ছিল আমাদের। কিন্তু এরপর থেকেই আমাদের মাথায় ছিল কখন ভাইয়া সুস্থভাবে দেশে এসে বাসায় ফিরবে। সেই প্রতীক্ষার অবসান হল।”
দুই মেয়ে ও ছোট ভাই আতিকুল্লাহকে আনতে গেলেও তার মা ও সন্তানসম্ভবা স্ত্রী এবং দুই বছর বয়েসী মেয়ে খাদিজা ছিলেন বন্দর নগরীর নন্দনকাননের বাসায়। জিম্মিদশার এক মাস তাদের পার হয়েছে আতঙ্কের মধ্য দিয়ে, আর দুস্যদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার পরবর্তী একমাস তাদের কেটেছে ঘরে ফেরার আশা নিয়ে।
আতিকুল্লাহর ফেরা উপলক্ষে তার মা ও স্ত্রী বাসায় থেকে তার জন্য পছন্দের বিভিন্ন খাবার রান্না করেছেন। বাসা গুছিয়েছেন নতুন করে।
আসিফ বলেন, “আম্মু ও ভাবিসহ আমাদের স্বজনরা ঘরে ভাইয়ার প্রতীক্ষায়। ভাইয়ার পছন্দের বিভিন্ন পদের রান্না করা হয়েছে। আমাদের ঘরের আজকের আনন্দ কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।
“তিনি সুস্থভাবে পৌঁছানোয় এমভি আবদুল্লাহর মালিকপক্ষ কেএসআরএম গ্রুপ ও সরকারসহ সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।”
জেটিঘাট থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে দিকে নন্দনকাননের বাসায় পৌঁছান আতিক উল্লাহ। ফিতা কেটে বাসায় প্রবেশ করে প্রথমেই মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। ছোট মেয়ে খাদিজাকে কোলে নিয়ে আদর করেন। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর সঙ্গে একান্তে কিছুটা সময় কাটান। পরে পরিাবরের সদস্যদের নিয়ে কেক কাটেন।
আতিকুল্লার মা শাহনুর আক্তার ছেলের মুখে খাবার তুলে দেন। আনন্দে জড়িয়ে ধরেন।
জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের বাসায় মঙ্গলবার আনন্দের দিন হলেও তিনিসহ আরও ২৩ নাবিককে ঘিরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছিল দুই মাস আগে। গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরের সোমালিয়া উপকূলে সশস্ত্র সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে আবদুল্লাহ; নাবিকরা হন জিম্মি।
পরিবারের সদস্যদের ফোন করে তারা জানান, মুক্তিপণ না দিলে তাদের একে একে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। সেই থেকে পরিবারের সদস্যদের ফিরে পেতে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ আর অনিশ্চিত অপেক্ষার শুরু।
আন্তর্জাতিক বাহিনী, সরকার ও জাহাজের মালিকপক্ষের বিভ্নি্নভাবে চেষ্টার এক মাস পর জিম্মি দশা থেকে জাহাজসহ মুক্ত হন নাবিকরা। কিন্তু বাড়ি ফিরতে লেগে যায় আরও এক মাস।
মুক্তির পর নাবিকরা জাহাজ নিয়ে যান আরব আমিরাতে। সেখানে পণ্য খালাস করে ফের মালামাল তুলে রওনা হন দেশের পথে।
আরও পড়ুন-
অপেক্ষার অবসান, পরিবারের কাছে ফিরলেন এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা