ভারতীয় আবহাওয়া অফিস বলছে, ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানার সময় বাতাসের গতি ঘণ্টায় ১৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত উঠতে পারে।
Published : 12 May 2023, 04:29 PM
ঘণ্টায় দেড়শ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে বাংলাদেশ উপকূলের সাড়ে নয়শ কিলোমিটারের মধ্যে হাজির হয়েছে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাগর বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠায় দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে অতি দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়াবিদরা যেমন ধারণা করেছিলেন, সেভাবেই উত্তর উত্তর-পশ্চিম দিকের গতিপথ বদলে বাঁক নিয়ে উত্তর উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে এই ঘূর্ণিবায়ুর চক্র।
এভাবে চললে আগামী রোববার দুপুর নাগাদ ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের কিয়াউকপিউয়ের মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
ভারতীয় আবহাওয়া অফিসের বুলেটিনে বলা হয়েছে, অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের আকারে উপকূলে আঘাত হানার সময় মোখার বাতাসের শক্তি থাকতে পারে ঘণ্টায় ১৫০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে।
তবে টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার বলছে, সে সময় ২০০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যেতে পারে মোখার ঘূর্ণিবাতাসের শক্তি।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস বলছে, শুক্রবার দুপুর ১২টায় এ ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১০০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিল।
সে সময় ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের কাছে বাতাসের একটানা গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার, যা দমকা আর ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।
শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে পরবর্তী ছয় ঘণ্টায় এ ঝড় এগিয়েছে মোটামুটি ঘণ্টায় ১১ কিলোমিটার গতিতে। বর্তমান অবস্থান থেকে উত্তর উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে হতে মোখা আরও ঘনীভূত হতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় উপকূলের দিকে এগিয়ে আসার সময় প্রচুর বৃষ্টি ঝরাবে। সেই সঙ্গে উপকূলীয় নিচু এলাকা স্বাভাবিকের চেয়ে ২ থেকে ২.৭ মিটার বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পরে।
কতটা শক্তি নিয়ে আঘাত হানবে মোখা?
বাংলাদেশের স্থলভাগে তাপপ্রবাহ বয়ে চলার মধ্যে সোমবার দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোসাগর ও এর সংলগ্ন আন্দামান সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হয়। ধাপে ধাপে সুস্পষ্ট লঘুচাপ, নিম্নচাপ এবং গভীর নিম্নচাপ হওয়ার পর বৃহস্পতিবার তা ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেয়। এসকাপের আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এটি ইয়েমেনের দেওয়া ‘মোখা’ নাম পায়।
বৃহস্পতিবার রাতে মোখা অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোসাগর ও এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছিল। শুক্রবার সকালে সেটা অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপ পায় এবং দুপুরের দিকে দিক বদল শুরু করে উত্তর উত্তরপূর্ব দিকে এগোতে শুরু করে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, “উত্তর-পশ্চিম আর উত্তর-পূর্ব টোটালি ভিন্ন ডিরেকশন। উত্তর-পশ্চিম দিকে হলে ভারতের ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, খুলনা এসব এলাকা এফেক্টেড হত; যেহেতু নর্দার্নলি টার্ন নিচ্ছে, এবং আরও উত্তর, উত্তর পূর্ব দিকে টার্ন নেবে (মিয়নমান-বাংলাদেশ উপকূলের দিকে)।
জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার বলছে, মোখা উপকূলে আঘাত হানার সময় ঘূর্ণিবাতাসের শক্তি ২০০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই গতি ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে তাকে বলা হবে সুপার সাইক্লোন।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে আজিজুর রহমান বলেন, “এখনও ৪৮ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় রয়েছে। এটা সুপার সাইক্লোন হতেও পারে, যদি এগোনোর গতি আরও স্লো হয়ে যায়। ১৪ মে দুপুর নাগাদ উপকূল অতিক্রম করবে বলছি আমরা, এটা আরও ডিলে হতে পারে। সব কিছু নির্ভর করছে সাইক্লোন বডির মুভমেন্টের ওপর।”
উপকূলীয় এলাকায় সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে এই আবহাওয়াবিদ বলেন, “ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের মূল অংশটা যাবে সেন্টমার্টিন এলাকায়, সেজন্যে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন উপকূল ঝুঁকিতে রয়েছে বেশি। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ব্যস এখন ৭৪ কিলোমিটার। ওই সেন্টারটাই যখন একদম ক্লিয়ার হয়ে যাবে, এখানে কোনো ক্লাউড থাকবে না, তখনই বলা হয় আই ফরমেশন। ঘূর্ণিঝড়ের চোখ স্পষ্ট হলে সেক্ষেত্রে কিছু বৈশিষ্ট স্পষ্ট হয়, সাইক্লোনের চতুর্পাশে উইন্ড, বৃষ্টিপাত, ঝড়, বজ্রপাত বেড়ে যায।”
ঝরাবে বৃষ্টি
ঘূর্ণিঝড় এগিয়ে আসায় কক্সবাজারে শুক্রবার দুপুরে একদফা মাঝারি বৃষ্টির পর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়েছে। শনিবার থেকে উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টিপাত বাড়তে শুরু করবে বলে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে।
পুরো চট্টগ্রাম বিভাগ এর আওতায় থাকবে, সঙ্গে উপকূলীয় জেলাগুলোতেও অতি ভারি বর্ষণ হবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, “ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে শনিবার সন্ধ্যা নাগাদ উপকূলে বৃষ্টিপাত বেড়ে যাবে এবং দমকাসহ ঝড়ো হাওয়া বেড়ে যাবে।”
তিনি বলেন, এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি নেই, সব মেঘ গেছে সাইক্লোনের কেন্দ্রে। ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে সেই ঝড় স্থলভাগে ফিরবে।
এ ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়তে পারে কক্সবাজার জেলায়। তার মধ্যে টেকনাফ উপজেলা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকবে। বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে মাঝারি ধরনের প্রভাব পড়বে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভুইয়া জানান, আগামী ৪৮ ও ৭২ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলয় এলাকা ও পার্বত্য অববাহিকায় এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় এলাকায় কিছু স্থানে মাঝারি থেকে ভারি অথবা অতি ভারি বর্ষণের পূর্বাভাস রয়েছে।
“এসময় সংশি।রষ্ট নদ-নদীর পানি দ্রুত বাড়তে পারে এবং কিছুনিম্নাঞ্চলে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।”
কক্সবাজার হয়ে যত ঝড়
গবেষক মোহন কুমার দাশ জানান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছিল ১৯৯১ সালের ৩০ এপ্রিলের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়।
এর পরে কক্সবাজার উপকূলে আঘাত করেছে এমন ঘূর্ণিঝড়গুলো মধ্যে ২২ অক্টোবর ১৯৯২, ৩ মে ১৯৯৪, ২৫ নভেম্বর ১৯৯৫, ৮ মে ১৯৯৬ উল্লেখযোগ্য।
পরে ২০১৭ সালের ৩০ মে ‘মোরা’ ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম উপকূল দিয়ে অতিক্রম করলে এর প্রভাবে কক্সবাজারে ব্যাপক ক্ষতি হয়।
২০১৫ সালে রয়্যাল মিটিরিওলোজিক্যাল সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ইদ্রিস আলমের গবেষণা প্রবন্ধের তথ্য তুলে ধরে মোহন কুমার দাশ বলেন, ১৪৮৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলে সরাসরি আঘাত হেনেছে এমন ১৮৭টি ঘূর্ণিঝড়ের ক্যাটালগ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল এবং খুলনা উপকূল দিয়ে যথাক্রমে ৩০, ৪৬, ১৯, ৪১ এবং ৫১টি ঘূর্ণিঝড় অতিক্রম করেছে।
আবার ১৯৬০ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে কক্সবাজার দিয়ে অতিক্রম করেছে এমন ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ৫টি ক্যাটাগরি-১ (১১৯-১৫৩ কিমি/ঘ), একটি ক্যাটাগরি-২ (১৫৪-১৭৭ কিমি/ঘ), একটি ক্যাটাগরি-৩ (১৭৮-২০৩ কিমি/ঘ) এবং দুটি ক্যাটাগরি-৪ (২১০-২৪৯ কিমি/ঘ) মাত্রার ছিল। এ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চারটি ক্যাটাগরি-৪ (২১০-২৪৯ কিমি/ঘ) মাত্রার ঘূর্ণিঝড় অতিক্রম করেছে চট্টগ্রাম দিয়ে।
ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার দাশ বলেন, “অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দুর্যোগের ঘটনার ডেটাবেস খুবই অগোছালো, অপর্যাপ্ত এবং অসম্পূর্ণ।”