ভারতীয় আবহাওয়া অফিস বলছে, সম্ভাব্য এই ঘূর্ণিঝড় রোববার দুপুর নাগাদ বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের কিয়াউকপিউয়ের মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
Published : 11 May 2023, 10:08 AM
দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোসাগরে অবস্থনরত গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ের রূপ পাওয়ার পর দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
সাইক্লোন সংক্রান্ত আঞ্চলিক সংস্থা এসকাপের তালিকা অনুযায়ী এ ঘূর্ণিঝড় নাম পেয়েছে ‘মোখা’ (Mocha)। এটি ইয়েমেনের দেওয়া নাম।
আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় এ ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১২৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-
দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ১২২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ১২৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ১২২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিল।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ছিল ৬২ কিলোমিটার; যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে সাগর বিক্ষুব্ধ থাকায় দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এই সংকেতের মানে হল, দূরে গভীর সাগরে একটি ঝড় সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার। বন্দর এখনই ঝড়ের কবলে পড়ছে না, তবে বন্দর ত্যাগকারী জাহাজ পথের মধ্যে বিপদে পড়তে পারে।
উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে এবং গভীর সাগরে বিচরণ না করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ বলছেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা আরো ঘণীভূত হয়ে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত উত্তর-উত্তরপশ্চিম দিকে এবং পরবর্তীতে দিক পরিবর্তন করে ক্রমান্বয়ে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হতে পারে৷
সম্ভাব্য গতিপথ
এই ঘূর্ণিবায়ুর চক্র কবে কোন এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে সে বিষয়ে এখনও কোনো আভাস দেয়নি বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস।
তবে ভারতীয় আবহাওয়া অফিস বলছে, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরের বর্তমান অবস্থান থেকে উত্তর উত্তর-পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলার পথে ঘূর্ণিঝড় মোখা আরও শক্তি সঞ্চয় করে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে পরিণত হতে পারে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে।
এরপর ঝড়টি ধীর ধীরে বাঁক নিতে শুরু করবে এবং উত্তর উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হবে। শুক্রবার তা আরও শক্তিশালী হয়ে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপ পেতে পারে।
ভারতীয় আবহাওয়া বিদরা বলছেন, এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যে অনুমান তারা করছেন, তা ঠিক থাকলে শনিবার সন্ধ্যা নাগাদ এ ঝড়ের শক্তি সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছাবে। শনিবার মধ্যরাত থেকে সামান্য কমে আসতে পারে মোখার শক্তি। রোববার দুপুর নাগাদ বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের কিয়াউকপিউয়ের মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে এ ঝড়।
জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারও রোববার এ ঝড়ের কক্সবাজার-মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হানার পূর্বাভাস দিয়েছে।সে সময় বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ হতে পারে দেড়শ কিলোমিটারের কাছাকাছি।
অবশ্য কোনো পর্যায়ে এর গতিপথ পাল্টে গেলে উপকূলে আঘাত হানার সম্ভাব্য স্থানও বদলে যেতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় স্থলভাগ অতিক্রম করার সময় উপকূলীয় নিচু এলাকা স্বাভাবিকের চেয়ে দেড় থেকে দুই মিটার বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে ভারতের আবহাওয়া অফিস।
যেভাবে পরিণত হল ঘূর্ণিঝড়ে
বাংলাদেশের স্থলভাগে তাপপ্রবাহ বয়ে চলার মধ্যে সোমবার দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোসাগর ও এর সংলগ্ন আন্দামান সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হয়।
তখন থেকে এর আরও ঘনীভূত হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল। মঙ্গলবার এটি সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়।
এটি আরও ঘনীভূত হয়ে মঙ্গলবার রাতে নিম্নচাপে এবং তারপর বুধবার সকালে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়। পরদিন তা পরিণত হল ঘূর্ণিঝড়ে।
ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে বাতাসের বেগ দাঁড়ায় ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার। বাতাসের গতিবেগ ৮৯ থেকে ১১৭ কিলোমিটার হলে তাকে বলে প্রবল ঘূর্ণিঝড়, গতিবেগ বেড়ে ১৮০ থেকে ২১৯ কিলোমিটার হলে তাকে হারিকেনের গতিসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড় বলে, আর তার চেয়ে বেশি গতিবেগ হলে তাকে সুপার স্লাইকোন বলা হয়।
ঝড়-জ্বলোচ্ছ্বাসপ্রবণ বাংলাদেশে মূলত এপ্রিল-মে এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এ সময়ে উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ঝড় ও প্রচুর বৃষ্টিপাতও হয়ে থাকে।
আবার ব্যাপক বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢল, জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিধসের ঝুঁকিও তৈরি হয়।
সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘ম্যানদাউস’ ভারতের তামিলনাড়ু ও পুদুচেরি উপকূলে আঘাত হানার পর দুর্বল হয়ে পড়েছিল, এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়েনি।
প্রস্তুতি
ঘূর্ণিঝড়ের আভাসে ইতোমধ্যে উপকূলে আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করেছে বাংলাদেশ সরকার। সমুদ্রবন্দরগুলোকেও সতর্ক করা হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বুধবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ উপকূলীয় এলাকায় যত আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে, তা প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে।
“উপজেলার শেল্টার প্রিপারেশন কমপ্লিট। সেখানে ১৪ টন শুকনো খাবার ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে। আগামীকালের মধ্যে ২০০ টন চাল চলে যাবে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছি শেল্টার ম্যানেজমেন্টর জন্য। আমরা সব দিক থেকে প্রস্তুত রয়েছি। প্রতিবারের মতো এবারও আমরা সফলভাবে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা করতে সক্ষম হবো।”
লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসতে সেনাবাহিনী, পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের কাজ করার বিষয়টি তুলে ধরেন।
প্রতিমন্ত্রী জানান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ পরিবহন, জনবল ও লোকজন আনা নেওয়ায় সহায়তা করে আসছে। লোকজনকে জোর করে আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে পুলিশ সহায়তা করে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, আনসার, কোস্টগার্ড প্রস্তুত রয়েছে।
“ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়ার পর থেকে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ক্ষয়ক্ষতি ও জনমালের ক্ষতি শূন্য পযায়ে নিয়ে আনতে পারব,” বলেন প্রতিমন্ত্রী।