কোনারপাড়ার বাসিন্দা নূর জাহান বেগম বলেন, “আর কোনোবার আসি নাই, এইবারের অবস্থা বেশি খারাপ লাগে।”
Published : 12 May 2023, 03:10 PM
ঘূর্ণিঝড় মোখা উপকূলের দিকে এগিয়ে আসতে থাকায় মেঘ বাড়তে শুরু করেছে কক্সবাজারের আকাশে। উদ্বেগের মধ্যে দেশের সর্বদক্ষিণের প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে আসতে শুরু করেছেন বাসিন্দারা।
স্থানীয়রা বলছেন, বৃহস্পতি ও শুক্রবার মিলিয়ে দুই শতাধিক পরিবার সেন্টমার্টিন ছেড়ে টেকনাফে এসেছেন। তাদের একটি বড় অংশ দ্বীপের কোনারপাড়া, গলাচিপা, ডেইলপাড়া ও উত্তর পাড়ার বাসিন্দা। শুক্রবার দুপুরেও অনেককে পরিবার পরিজন আর ব্যাগ-বোচকা নিয়ে ট্রলারে করে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাটে পৌঁছাতে দেখা যায়।
কোনারপাড়ার বাসিন্দা নূর জাহান বেগম বলেন, “আর কোনোবার আসি নাই, এইবারের অবস্থা বেশি খারাপ লাগে। আমরা আসছি পরিবারের সাতজন।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফের ইউএনও মুহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, “এরকম সিগন্যাল পেলে কিছু মানুষ টেকনাফে আত্মীয় স্বজনের বাসায় চলে আসে, এরকম একটা টেনডেন্সি আছে। তবে সেই সংখ্যাটা এখনও খুব বেশি না।
“যারা ওখানে (সেন্ট মার্টিনে) আছে, তাদেরও উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ আমরা ওখানে ১৭টা আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তত রেখেছি,
বড় হোটেল রিসোর্ট যেগুলো আছে, একই সাথে স্কুল, ডাক বাংলো, প্রত্যেকটা রেডি আছে আমাদের। আমাদের সিপিপি টিম, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, নেভি, আমাদের পুলিশ, জনপ্রতিনিধি, গ্রাম পুলিশ সবাই অ্যালার্ট আছেন।”
ইউএনও বলেন, “উদ্বিগ্ন না হয়ে আমরা যদি আশ্রযকেন্দ্রে চলে আসি, সবাই যদি সিগন্যালের সাথে সাথে নিরাপদ আশ্রয় নেয়, তাহলে জানমালের ক্ষতিটা কমাতে পারব বলে আমরা বিশ্বাস করি।”
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “সেন্টমার্টিনে এখনও পর্যন্ত লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার পরিস্থিতি হয়নি। তবে দ্বীপবাসীকে সতর্ক থাকতে প্রত্যেক গ্রামে বার্তা পাঠানো হয়েছে; মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে।
দ্বীপে সিপিপি টিমসহ ৫০০ স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখা হয়েছে জানিয়ে চেয়ারম্যান আরও বলেন, “কিছু লোক ট্রলার ও স্পিডবোটে করে দ্বীপ ছেড়ে গেছে বলে শুনা যাচ্ছে।”
প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা শুক্রবার সকালে আরও শক্তিশালী হয়ে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেয়। বর্তমান গতিপথ ঠিক থাকলে এ ঝড় রোববার দুপুর নাগাদ কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের কিয়াউকপিউয়ের মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় উপকূলের দিকে এগিয়ে আসার সময় প্রচুর বৃষ্টি ঝরাবে। সেই সঙ্গে উপকূলীয় নিচু এলাকা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পরে।
কক্সবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আব্দুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের সময় কক্সবাজার উপকূলজুড়ে সাধারণত ৪ থেকে ৬ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয়ে থাকে। আমরা এবারও তেমনটাই আশঙ্কা করছি।”
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ থাকায় দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে এবং গভীর সাগরে বিচরণ না করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, শুক্রবার সকাল থেকে কক্সবাজারের আকাশে মেঘ-রোদের খেলা চলছে, পাশাপাশি ভ্যাপসা গরম অনুভূত হচ্ছে। সাগর স্বাভাবিকের চাইতে কিছুটা উত্তাল থাকার পাশাপাশি পানির উচ্চতাও বাড়তে শুরু করেছে।
ফিশিং বোট মালিক সমিতির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখনও উপকূলের কাছাকাছি অবস্থানে থেকে মাছ ধরছে অন্তত দুই সহস্রাধিক ট্রলার। আবহাওয়ার আরও অবনতি হলে সেগুলোকে দ্রুত তীরে ফিরতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. আবু সুফিয়ান জানান, ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলায় মোট ৫৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হচ্ছে।
টেকনাফের সেন্টমার্টিন, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া দ্বীপাঞ্চলে নেওয়া হয়েছে বাড়তি সতর্কতা। সেখানে লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে যানবাহনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুক্রবার সকালে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে খোলা হয়েছে জরুরি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতেও সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে প্রশাসন। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে একটি প্রস্তুতিমূলক সভা হয়েছে। দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেখানে।
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় ইতোমধ্যে দুই ধাপে কক্সবাজার জেলার জন্য ৫৯০ মেট্রিক টন চাল, সাড়ে ৩ মেট্রিক টন বিস্কুট, সাড়ে ৩ মেট্রিক টন ড্রাই কেক, ২০ হাজার ওরস্যালাইন, ৪০ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ১৯৪ বান্ডেল ঢেউটিন এবং ২০ লাখ ৩০ হাজার নগদ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে।