মৃত্যু আর ধ্বংস নিয়ে ঘূর্ণিঝড় এসেছে বার বার

প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই ছোট-বড় ঝড় আঘাত হানে। এসব ঝড়ে কেড়ে নেয় বহু মানুষের প্রাণ, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় সম্পদের।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 May 2023, 05:54 AM
Updated : 12 May 2023, 05:54 AM

বছরের প্রথম বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের মুখে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল। সরকারের পক্ষ থেকে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সবধরনের প্রস্তুতি রাখার কথা জানানো হয়েছে।

দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোসাগরে সৃষ্ট ‘মোখা’ নামের অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি রোববার দুপুর নাগাদ বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের কিয়াউকপিউয়ের মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে নানা সময়ে, বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন ঊপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা।

তবে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝড়ে প্রাণক্ষয় কমেছে।

‘মোখা’ আঘাত হানার আগে দেখে নেওয়া যাক অতীতের বড় ঝড়গুলোতে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য। 

# ১৫৮৪ সালে পাঁচ ঘণ্টা ধরে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে পটুয়াখালী ও বরিশাল জেলার উপকূলের দুই লাখ মানুষ প্রাণ হারান।

# ১৭৬৭ সালে ঘূর্ণিঝড়ে বরিশালের বাকেরগঞ্জে প্রাণ হারান ৩০ হাজার মানুষ।

# ১৮২২ সালের জুন মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল, হাতিয়া ও নোয়াখালীতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের প্রাণ যায়।

# ১৮৩১ সালে বালেশ্বর-উড়িষ্যা উপকূল ঘেঁষে চলে যাওয়া তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল উপকূলের ২২ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে।

# ১৮৭৬ সালের ২৯ অক্টোবর বরিশালের বাকেরগঞ্জে মেঘনা নদীর মোহনার কাছ দিয়ে তীব্র ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার। ঝড়ের প্রভাবে ১২ মিটারের বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় ঊপকূলীয় এলাকা। চট্টগ্রাম, বরিশাল ও নোয়াখালীর উপকূলে তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়া ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় দুই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।

# ১৮৯৭ সালের ২৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম অঞ্চলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়, যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কুতুবদিয়া দ্বীপ। ঝড়ে প্রাণ যায় পৌনে দুই লাখ মানুষের।

# ১৯০৯ সালের ১৬ অক্টোবর খুলনা অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যু হয় ৬৯৮ জনের।

# ১৯৪৮ সালে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারান চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে ১২০০ অধিবাসী।

# ১৯৫৮ সালে বরিশাল ও নোয়াখালীতে ঝড়ে মারা যান ৮৭০ জন।

# ১৯৬০ সালে অক্টোবরে ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার গতির বাতাস নিয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, পটুয়াখালী ও পূর্ব মেঘনা মোহনায়। ঝড়ের প্রভাবে ৪.৫ থেকে ৬.১ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। মারা পড়েন ঊপকূলের প্রায় ১০ হাজার বাসিন্দা।

# ১৯৬১ সালের ৯ মে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার। প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষ মারা যান সেই ঝড়ে।

# ১৯৬২ সালে ২৬ অক্টোবর ফেনীতে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় হাজারখানেক মানুষের মৃত্যু হয়।

# ১৯৬৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার এবং সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া ও মহেশখালী উপকূলীয় অঞ্চল। সেই ঝড়ে প্রাণ হারান ১১ হাজার ৫২০ জন।

# ১৯৬৫ সালে মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বারিশাল ও বাকেরগঞ্জে প্রাণ যায় ১৯ হাজার ২৭৯ জনের। সে বছর ডিসেম্বরে আরেক ঝড়ে কক্সবাজারে মৃত্যু হয় ৮৭৩ জনের।

# ১৯৬৬ সালের অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে সন্দ্বীপ, বাকেরগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লায়; ৮৫০ জনের মৃত্যু হয় সেই ঝড়ে।

# ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার উপর দিয়ে বয়ে যায় প্রলয়ঙ্করী ‘গ্রেট ভোলা সাইক্লোন’। ওই ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২২২ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, ভোলার চর বোরহানুদ্দিনের উত্তর পাশ ও চর তজুমুদ্দিন এবং নোয়াখালীর মাইজদি ও হরিণঘাটার দক্ষিণপাশ সেই ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাণ হারায় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ। চার লাখের মতো বসতভিটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

# ১৯৮৩ সালে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে দুটি ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও নোয়াখালী জেলার উপকূলীয় এলাকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রাণ যায় অনেকের।

# ১৯৮৫ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয় সন্দ্বীপ, হাতিয়া ও উড়িরচর এলাকা; সেই ঝড়ে প্রাণ হারান ঊপকূলের ১১ হাজার ৬৯ জন বাসিন্দা।

# ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায় যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায়। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার। সেই ঘূর্ণিঝড়ে ৫ হাজার ৭০৮ জনের মৃত্যু হয়।

# ১৯৯১ সালের ৩০ এপ্রিল বয়ে যায় আরেকটি প্রলয়ঙ্করী ঝড়। ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট সেই ঝড় ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার গতি নিয়ে আঘাত হানে চট্টগ্রাম ও বরিশালের উপকূলীয় এলাকায়। প্রায় দেড় লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে ওই ঝড়ে।

>>১৯৯৭ সালের ১৯ মে বাংলাদেশের সীতাকুণ্ড ও এর আশপাশের এলাকায় আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এ সময় ঘণ্টায় ২৩২ কিলোমিটার বেগের বাতাসের সঙ্গে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়৷

# ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় ‘সিডরের’ আঘাতে বিধ্বস্ত হয় দেশের দক্ষিণ উপকূল। উত্তর ভারত মহাসাগরে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে সৃষ্ট এ ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ থেকে ৩০৫ কিলোমিটার। এতে তিন হাজরের বেশি মানুষ মারা যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩২টি জেলার ২০ লাখ মানুষ। উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৬ লাখ টন ধান নষ্ট হয়। সুন্দরবনের প্রাণীদের পাশাপাশি ব্যাপক গবাদিপশু প্রাণ হারায়।

# ২০০৮ সালের অক্টোবরে ঘণ্টায় ৮৫ কিলোমিটার বেগের বাতাস নিয়ে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় রেশমিতেও প্রাণহানি ঘটে।

# ২০০৯ সালের ২১ মে ভারত মহাসাগরে সৃষ্টি হয় ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’। ২৫ মে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে আঘাত হানা এই ঝড় ভারতে ১৪৯ জন ও বাংলাদেশে ১৯৩ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে উপকূলে প্রায় ৩ লাখ মানুষ বাস্তুভিটা হারায়।

# ২০১৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’-এ প্রাণ হারান ১৭ জন।

# ২০১৪ সালের ৬ অক্টোবর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘হুদহুদ’। ঘণ্টায় ১৮০ কিলোমিটার গতির বাতাসের সেই ঝড়ে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ ও ওড়িশায় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও বাংলাদেশে ক্ষতির পরিমাণ ছিল তুলনামূলকভাবে কম।

# ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেনে’ দেশের চার জেলায় অন্তত চারজন মারা যান।

# ২০১৬ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানুর’ আঘাতে লাখখানেক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, চট্টগ্রামে মৃত্যু হয় ২৪ জনের।

# ২০১৭ সালের ৩০ মে ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার বেগের বাতাসের শক্তি নিয়ে কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’।

# ২০১৯ সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ ভারতের ওড়িশা উপকূলে তাণ্ডব চালিয়ে বাংলাদেশে ছোবল দেয়, কেড়ে নেয় অন্তত ৯ জনের প্রাণ। তবে ফসলের ক্ষতি ছিল অনেক বেশি।

# একই বছর ৯ নভেম্বর অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আঘাত হানার পর প্রবেশ করে বাংলাদেশে। সেই ঝড়ে মৃত্যু হয় অন্তত আটজনের, ক্ষতি হয় সুন্দরবনেও৷

# ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন ‘আম্পান’। ২১ মে এটি অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় রূপে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আঘাত হানে। পরে রাতে এ ঝড় প্রবেশ করে বাংলাদেশে; আট জেলায় মারা যায় অন্তত ১৫ জন।

# ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ২০২১ সালের ২৬ মে ভারতের ওড়িশা উপকূল দিয়ে অতিক্রম করে। এর প্রভাবে বাংলাদেশ উপকূলে কোথাও কোথাও স্বাভাবিকের চেয়ে ৭ থেকে ৮ ফুট বেশি উচ্চতার জোয়ারে প্লাবিত হয়। এ ঝড়ে দেশের উপকূলীয় ৯টি জেলার ২৭টি উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতি হয় বলে জানায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

# ২০২১ সেপ্টেম্বরে ঘূর্ণিঝড় ‘গুলাব’ ও ডিসেম্বরে ঘূর্ণিঝড় ‘জোয়াদ’ হলেও অন্ধ্র প্রদেশ ও ওডিশা উপকূলে এলেও বাংলাদেশে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেনি।

# ২০২২ সালের ৯ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আসানি’ অন্ধ্র উপকূলে দুর্বল হয়ে পড়ে। এসময় বাংলাদেশেও বেশ বৃষ্টি হয়।

# ২০২২ সালের ২৪ অক্টোবর মাঝারি শক্তির ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ আঘাত হানে উপকূলে। ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটারের বেশি গতিবেগের এ ঝড়ে বিভিন্ন স্থানে গাছ ও দেয়াল চাপায় অন্তত ৭ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে ফসলেরও ক্ষতি হয়।  

# দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোসাগরে ২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর ‘ম্যানদাউস’ নামের আরেকটি ঝড়ের সৃষ্টি হয়, যেটি ভারতের তামিলনাড়ু ও পুদুচেরি উপকূলে আঘাত হানার পর দুর্বল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে এ ঝড়ের তেমন প্রভাব পড়েনি।