“পারস্পরিক প্রতিহিংসা, অবিশ্বাস ও অনাস্থা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অন্বেষণ অধিকতর ফলদায়ক হতে পারে,” এক ধারণাপত্রে বলছে ইসি।
Published : 20 Oct 2023, 08:47 AM
ভোটে আসা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমার আভাস না মিললেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তফসিলের আগে সব ধরনের প্রস্তুতির কাজ গুছিয়ে এনেছে নির্বাচন কমিশন; একই সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে সংলাপের বিষয়টিও আছে জোরালো আলোচনায়।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তারা বলছেন, তফসিল ঘোষণার কার্যক্রমও শেষ ধাপে রয়েছে। নির্বাচনী সামগ্রী আগামী সপ্তাহে মাঠ পর্যায়ে যাওয়া শুরু করবে। দিন যত যাচ্ছে কর্মযজ্ঞের পরিমাণ বাড়ছে। এরই মধ্যে বিবদমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে সমঝোতা-সমাধানের আশায় তাকিয়ে রয়েছে কমিশন।
ভোটের ৯০ দিনের ক্ষণ গণনা শুরু হচ্ছে ২ নভেম্বর। এর আগে ২৬ অক্টোবর সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ‘জাতির প্রত্যাশা’ নিয়ে কর্মশালা আয়োজনের সূচি রয়েছে ইসির। এজন্য একটি ধারণাপত্র তৈরি করেছে কমিশন। এতে বলা হয়েছে, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য যে অনুকূল পরিবেশ প্রত্যাশা করা হয়েছিল, সেটি এখনও হয়ে উঠেনি। এমন প্রেক্ষাপটে ‘পারস্পরিক প্রতিহিংসা, অবিশ্বাস ও অনাস্থা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অন্বেষণ অধিকতর ফলদায়ক’ হতে পারে বলে ধারণাপত্রে তুলে ধরা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, সংবাদমাধ্যমের ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে ধারাবাহিক এই আলোচনায় জাতির কাছে তাদের প্রত্যাশার বিষয়গুলো উঠে আসবে।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে এবারের সংসদ নির্বাচন। এ লক্ষ্যে নভেম্বরে ভোটের তফসিল দেবে নির্বাচন কমিশন। এরপরই মনোনয়নপত্র জমা থেকে আচরণবিধি প্রতিপালন, আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক বৈঠক, ভোটকেন্দ্রের গেজেট প্রকাশসহ অন্যান্য কার্যক্রম শুরু করবে ইসি।
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল ও প্রার্থীর প্রচারণা, পর্যবেক্ষক-সাংবাদিকদের ব্রিফিং, ভোটের ফলাফল সংগ্রহ তফসিল-পরবর্তী কার্যক্রমের সম্ভাব্য সময় ধরে চেকলিস্টও শিগগির চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
এজন্য নানা ধাপের কাজ সম্পন্নের কথা তুলে ধরে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন, “নির্বাচনের লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনায় ৯২টি দফা রয়েছে। এ কার্যক্রম ভোটের পরেও চলমান থাকবে। যখন যে মালামাল আসবে সেগুলো রিসিভ করে তাৎক্ষণিকভাবে মাঠে পাঠানো হবে। জেলা, অঞ্চলে চলে যাবে, নিরাপত্তাসহ সেগুলো রাখার জন্যে বলা হয়েছে।
“নির্বাচনী সরঞ্জাম সংগ্রহে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে, সময়ে তারা জানাবে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে। আমাদের যে কর্মপরিকল্পনা রয়েছে পিছিয়ে নেই; কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছি”।
এসব প্রস্তুতি এগিয়ে চলার মধ্যে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘জনগণ ও দেশের কথা ভেবে’ সমঝোতায় আসার আহ্বান জানিয়ে আসছে বর্তমান কমিশন।
সংলাপে সমঝোতা-সমাধান খোঁজার আহ্বান
সংবাদমাধ্যমের ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আলোচনার জন্য তৈরি ধারণাপত্রে ইসি বলছে, প্রত্যাশিত সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে মতভেদের নিরসন হয়নি। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধানতম দলগুলো স্ব স্ব সিদ্ধান্ত ও অবস্থানে অনড়। রাজপথে মিছিল, জনসমাবেশ ও শক্তি প্রদর্শন করে স্ব স্ব পক্ষে সমর্থন প্রদর্শনের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে প্রত্যাশিত মীমাংসা বা সংকটের নিরসন হচ্ছে বলে কমিশন মনে করে না। বিষয়টি রাজনৈতিক। নির্বাচন কমিশনের এক্ষেত্রে করণীয় কিছু নেই।
এতে বলা হয়েছে, নির্বাচন বিষয়ে দেশে পর্যাপ্ত আইন রয়েছে। তবে আইন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির সমান্তরাল মিথস্ক্রিয়া না হলে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে আইনের বাস্তবায়ন সহজসাধ্য হয় না। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ, মতানৈক্য ও সংকট হতেই পারে।
এমন অবস্থায় কমিশন মনে করে, “পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক সহনশীলতা ও সহমর্মিতা টেকসই ও স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য নিয়ামক।”
ধারণাপত্রে কমিশন বলেছে, “নির্বাচন আয়োজনে যদি সঙ্কট নিরবিচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত থাকে, তাহলে গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।”
নির্বাচন নিয়ে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা, চিন্তা চেতনা ও ভাবনার বিষয়গুলো কর্মশালায় উঠে এলে তা ফলপ্রসু হবে বলে আশা করা হয়েছে ধারণাপত্রে।
অনড় আওয়ামী লীগ-বিএনপি, জাপা চায় সংলাপ
ভোট প্রস্তুতির মধ্যে ঘরে-বাইরে রাজনৈতিক সমঝোতা-সংলাপের দাবিও বাড়ছে।
বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে ১২ জুলাই থেকে ‘এক দফা’ আন্দোলন চালিয়ে আসছে বিএনপি। এ আন্দোলন ‘চূড়ান্ত পর্যায়ে’ নিয়ে যেতে আগামী ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার হুঁশিয়ারি, সেদিন থেকে আন্দোলনের ‘মহাযাত্রা শুরু হবে।’ সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমরা আর থেমে থাকব না।
বিএনপির দাবি নাকচ করে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাই থাকবেন। ভোটে জিতে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন।
তিনি বলেন, “বার্তা দিয়ে দিচ্ছি, নির্বাচনের পর আল্লাহর রহমতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনা আবারও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদে বসবেন। এটাই আমাদের বার্তা। অন্যথা হবে না।”
অপরদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে গাইবান্ধায় এক অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মনোভাব কিছুটা নরম করতে হবে। নির্বাচনের জন্য সরকারের সংলাপের ব্যবস্থা করা উচিত। এজন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি জানান, কিছু বিদেশি শক্তি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে আবার কিছু বিদেশি শক্তি সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে।
এদিকে জাতীয় নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক ও সংঘাতহীনভাবে’ আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রধান নির্বাচনী বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা ও অর্থবহ আলোচনার সুপারিশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল।
বাংলাদেশে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ এবং বিভিন্ন দলের সঙ্গে বৈঠকের পর রোববার এক বিবৃতিতে বক্তৃতা-বিবৃতির ব্যাপারে ‘সহনশীল’ হয়ে প্রধান নির্বাচনী বিষয়গুলো নিয়ে সংলাপসহ পাঁচ দফা সুপারিশ করে তারা ।
এ পরামর্শের পর প্রতিক্রিয়ায় ওবায়দুল কাদের বলেন, “বিএনপি বলছে, তারা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চায়, সংসদ ডিজলভ করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়, নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ চায়। আমরা তো এই শর্তযুক্ত সংলাপে রাজি হব না।… শর্তযুক্ত কোনো সংলাপের ব্যাপারে আমাদের কোনো চিন্তাভাবনা নেই। শর্ত তারা প্রত্যাহার করলে তখন দেখা যাবে।”
এর আগে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা এলে সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসার কথা জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেছেন, সেই সরকার কীভাবে গঠন হবে, আলোচনা হতে পারে তা নিয়ে।
এর জবাবে গত রোববার ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি যদি কোনো শর্ত ছাড়া সংলাপ করতে চায়, আওয়ামী লীগ তখন ‘ভেবে দেখবে’।
এর বক্তব্য পাল্টা বক্তব্যের মধ্যে ঢাকা সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে তার সরকারের অবস্থানের কথা বলেন। তার সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্তভাবে’ আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থবহ সংলাপের যে সুপারিশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক মিশন করেছে, সে ব্যাপারে মার্কিন অবস্থানও অনেকটা একই রকম।
আরও পড়ুন-
ভোট দেখতে নভেম্বরে আসছে ইইউ কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল: ইসি
সংসদ নির্বাচন: ভোটের সরঞ্জাম পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু ইসির
‘অর্থবহ সংলাপের’ সুপারিশে যুক্তরাষ্ট্র সরকারও ‘একমত’
২৮ অক্টোবর থেকে আন্দোলনের ‘মহাযাত্রা’: ফখরুল
শেখ হাসিনাই ‘আবার প্রধানমন্ত্রী’, বিএনপিকে কাদেরের ‘শেষ বার্তা’
দেশ ও জনগণের স্বার্থে রাজনৈতিক সমঝোতার ‘আহ্বান’ ইসির
ভোটার যদি আসে, কোন দল এল না, ভাববেন না সিইসি
নির্বাচন কেবল ভোটের দিনের বিষয় নয়: আফরিন আখতার