রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার বিচার শুরু

প্রায় এক বছরের মাথায় বিচার শুরুর আদেশ দেন কক্সবাজার আদালতের বিচারক

কক্সবাজার প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Sept 2022, 10:06 AM
Updated : 11 Sept 2022, 10:06 AM

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় আলোচিত রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছে আদালত।

হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক বছরের মাথায় রোববার দুপুরে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এর আদালত এই আদেশ দেন বলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) ফরিদুল আললম জানান।

আইনজীবী আরও বলেন, “২৯ জনকে অভিযুক্ত করে দেওয়া অভিযোগপত্রটি আদালত গ্রহণ করে বিচারকাজ শুরুর নির্দেশ দিয়েছেন। এখন মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের কাজ শুরু হবে। বিচারক আদালতের কার্যক্রম শেষে বিচার শুরুর জন্য পরবর্তী দিন ধার্য করবেন।”

গতবছর ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার ১-ইস্ট লম্বাশিয়া ক্যাম্পে ৪৮ বছর বয়সী রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে একদল অস্ত্রধারী।

তিনি ছিলেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস’ নামের রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠনের চেয়ারম্যান। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকার স্কুলশিক্ষক মুহিবুল্লাহ পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে ‘রোহিঙ্গাদের কণ্ঠস্বর’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

হত্যাকাণ্ডে মোট ৩৬ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য পেলেও সাত জনের ঠিকানা ও অবস্থান জানতে না পারায় শেষ পর্যন্ত চলতি বছরের ১৩ জুন ২৯ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

অভিযোগপত্রে নাম থাকা ২৯ আসামির মধ্যে ১৫ জন গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন, বাকি ১৪ জন পলাতক। গ্রেপ্তার ১৫ জনের মধ্যে চার জন তদন্ত চলাকালে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।

বেশ কয়েকবছর আগে জীবন বাঁচাতে নিজ দেশ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে সপরিবারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা হন মুহিবুল্লাহ। সেখানেই গড়ে তোলেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ)।

রোহিঙ্গাদের কাছে মুহিবুল্লাহ ছিলেন বাড়ি ফেরার স্বপ্নে বিভোর এক মানুষ। গত কয়েক বছর ধরে নির্যাতনের মুখে মিয়ানমারে সবকিছু ফেলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা লাখো মানুষের মাঝে সেই স্বপ্ন তিনি বিলিয়ে আসছিলেন।

মুহিবুল্লাহর স্বজন ও অনুসারীদের দাবি ছিল, দেশে ফেরার এই স্বপ্নই তার কাল হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যেই একটা অংশ দেশে ফিরতে চায় না। সশস্ত্র দলটির সঙ্গে ‘মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর যোগাযোগ’ রয়েছে বলেও ক্যাম্পের অনেকের বিশ্বাস।

মুহিবুল্লাহ উখিয়ার ১-ইস্ট লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-৭ ব্লকে থাকতেন। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে আলোচনায় আসেন তিনি। জেনিভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থায়ও রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি।

চল্লিশোর্ধ্ব এই রোহিঙ্গা নেতা ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ’ নামে পরিচিত ছিলেন। ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৮টায় উখিয়া উপজেলার ১-ইস্ট নম্বর লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-৭ ব্লকে তার উপর গুলিবর্ষণ হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে উখিয়ার কুতুপালংস্থ এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানেই রাত সোয়া ১০টার দিকে তিনি মারা যান।

রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তায় থাকা ১৪ আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক পুলিশ সুপার মো. নাঈম-উল হক সে সময় বলেছিলেন, “মুখে গামছা পরিহিত একদল দুর্বৃত্ত অতর্কিত তাকে লক্ষ্য করে পর পর পাঁচটি গুলি ছোড়ে। তার শরীরে তিনটি গুলি লাগে। স্থানীয় লোকজন এগিয়ে গেলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।”

মুহিবুল্লাহকে রোহিঙ্গাদের আরেকটি সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রিপাবলিকান স্যালভেশন আর্মি (আরসার) সদস্যরা হত্যা করেছে বলে সন্দেহ করে আসছিল তার পরিবার।

তার ভাই আহমদ উল্লাহ বলেছিলেন, মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের সর্বজনগ্রাহ্য নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তার সঙ্গে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিবর্গের যোগাযোগ ছিল। এ কারণে পুরনো সংগঠন আরসা তার উপর ক্ষুব্ধ ছিল।

পরিবার থেকে দাবি করা হয়, আরসার সদস্যরা মুহিবুল্লাহকে নেতা মানতে রাজি ছিল না। তারাই (আরসা) প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এর আগে থেকে প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ না করতে আরসা’র সদস্যরা তাকে নানাভাবে হুমকি দিয়ে আসছিল বলেও জানান।

মুহিবুল্লার ভাই হাবিবুল্লাহ ওই হত্যাকাণ্ডের পর উখিয়া মামলা দায়ের করেন; ওই মামলায় অজ্ঞাতনামা ২০ থেকে ২৫ জনকে আসামি করা হয়। হাবিবুল্লাহর দাবি ছিল, খুনিদের ১৫ থেকে ২০ জনের দলের প্রত্যেকের মুখ মাস্ক এবং গামছায় ঢাকা ছিল।

হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই মুহিবুল্লাহর স্বজন ও অনুসারীরা হন্যে হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছাড়ার চেষ্টা করছিলেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন তারা। এর ধারাবাহিকতায় তার পরিবারের ১১ সদস্য গত ১ এপ্রিল কানাডার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন।

ওই দলে মহিবুল্লাহর স্ত্রী নাসিমা খাতুন, নয় ছেলেমেয়ে এবং এক মেয়ের জামাইও ছিলেন। তাদের ‘রিফিউজি’ মর্যাদা দিয়ে কানাডায় আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।

ওই হত্যাকাণ্ডে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। জাতিসংঘ, ইউএনএইচসিআরসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।

পুরোনো খবর