হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে ২৪ ঘণ্টায়ও চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। তবে স্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন, খুনিরা রোহিঙ্গা বলেই তাদের ধারণা।
বৃহস্পতিবার বিকালে মরদেহ কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গ থেকে পুলিশ পাহারায় উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জানাজার পর শরণার্থী শিবিরের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
এদিকে মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর থেকে উখিয়ার লম্বাশিয়াসহ আশপাশের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
বুধবার রাতে হামলার পর পর থেকে ক্যাম্পের মোড়ে মোড়ে অবস্থান করছে এপিবিএনসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে লম্বাশিয়া ক্যাম্পের বিভিন্ন স্টেশনের দোকানপাট ছিল বন্ধ রয়েছে। শিবিরের ভেতরে ও বাইরে চলাচলেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাসিন্দারা।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি পিস ফর হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচআর) চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহকে (৪৮) বুধবার রাতে লম্বাশিয়া ক্যাম্পের ডি-৭ ব্লকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়।
দুই বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে আসা মুহিবুল্লাহ বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে থাকা ১১ লাখ রোহিঙ্গার সবচেয়ে পরিচিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর এলাকার স্কুলশিক্ষক মুহিবুল্লাহ পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে ‘রোহিঙ্গাদের কণ্ঠস্বর’ হিসেবে বিবেচিত ছিলেন।
তাকে হত্যাকাণ্ডে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
কী বলছে স্বজনরা
স্বজনরা বলছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রিপাবলিকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) বাংলাদেশে থাকা সদস্যরা এই খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিকালে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গের সামনে মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, বুধবার রাতে উখিয়ার ১-ইস্ট নম্বর লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্থানীয় মসজিদে দুই ভাই মিলে নামাজ আদায় করেন। এরপর মুহিবুল্লাহসহ তিনি আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি পিস ফর হিউম্যান রাইটস অফিসে যান। সেখানে তিনি (মুহিবুল্লাহ) কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। পরে তিনি (হাবিবুল্লাহ) ঘরে খাবার খেতে যান।
“খাবার খাওয়ার এক পর্যায়ে গুলির শব্দ শুনে বের হয়ে আমি এআরএসপিএইচআর অফিসে যাই। এসময় আমার ভাই মুহিবুল্লাহকে রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখি। তাকে ঘিরে ছিল ১৫/২০ জন অস্ত্রধারী লোকজন।”
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে মুখে মাস্ক ও গামছা পরিহিত ওই অস্ত্রধারীরা হামলা চালায়। তবে সেখানে আরও কয়েকজন থাকলেও শুধু মুহিবুল্লাহকে লক্ষ্য করেই গুলি ছুড়েছিল।
মুখঢাকা হলেও হামলাকারী কয়েকজনকে চিনতে পারার দাবি করে হাবিবুল্লাহ বলেন, “আরসার নেতা মাস্টার আব্দুর রহিম, লালু ও মুর্শিদসহ ৩/৪ জনকে চিনতে পেরেছি। এরা বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস করে আসছে। অন্যদের চিনতে পারিনি।”
হামলার কারণ কী- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আমেরিকা ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের সাথে বাংলাদেশের ইতিবাচক আলালোচনা হয়েছে।
“আমার ভাই মুহিবুল্লাহ দ্রুত প্রত্যাবাসন নিয়ে খুবই আশাবাদী ছিলেন। কাল রাতে এ নিয়েই এআরএসপিএইচআর অফিসে বসে অন্য রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন তিনি।”
মুহিবুল্লাহর আরেক ভাই আহমদ উল্লাহ বলেন, মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের সর্বজনগ্রাহ্য নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তার সঙ্গে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিবর্গের যোগাযোগ ছিল। এ কারণে পুরনো সংগঠন আরসা তার উপর ক্ষুব্ধ ছিল।
“তারা (আরসার সদস্যরা) আমার ভাই মুহিবুল্লাহকে নেতা মানতে রাজি ছিল না। তারাই (আরসা) প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে আমার ভাইকে খুন করেছে। এর আগে থেকে প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ না করতে আরসা’র সদস্যরা আমার ভাইকে নানাভাবে হুমকী দিয়ে আসছিল।”
ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবি জানান নিহত রোহিঙ্গা নেতার এ ছোট ভাই।
রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায় এবং দ্রুত প্রত্যবাসন নিয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখায়ই মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয় বলে মনে করেন মুহিবুল্লাহর চাচাত ভাই নুরুল আমিন।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের দ্রুততম সময়ে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিয়ে অন্য নেতাদের সঙ্গে আলোচনার সময় উগ্রবাদী আরসা’র সদস্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করেছে।”
মুহিবুল্লাহ (৪৮) মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থানার সিকদার পাড়ার মৃত ফজল আহমদের ছেলে।
২০১৭ সালের অগাস্টে আরসার হামলার কারণেই রাখাইন প্রদেশে সেনা অভিযান শুরুর দাবি করেছিল মিয়ানমার সরকার। তখন নিপীড়নের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে মুহিবুল্লাহও বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলেন।
রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করা বিভিন্ন এনজিও ও বিদেশি সংস্থার সঙ্গে মুহিবুল্লাহর সম্পর্ক ছিল বেশ ভালো। ইংরেজি জানার সুবাদে তিনি রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি হিসেবে বিদেশিদের সঙ্গে আলোচনা চালাতেন।
বাংলাদেশে থাকা ১১ লাখ রোহিঙ্গার আবাসস্থল শরণার্থী শিবিরে ২০১৯ সালে যে সমাবেশ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা উঠেছিল, তার উদ্যোক্তা ছিলেন মুহিবুল্লাহ।
থমথমে পরিস্থিতি, মামলা
রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর বুধবার রাতেই শরণার্থী শিবিরের মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেয় এপিবিএনসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
যেখানে মুহিবুল্লাহ খুন হন, সেই লম্বাশিয়াসহ আশপাশের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি ছিল বৃহস্পতিবারও। সকাল থেকে লম্বাশিয়া ক্যাম্পের বিভিন্ন স্টেশনের দোকানপাট বন্ধ রয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। ক্যাম্পে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে লম্বাশিয়াসহ আশাপাশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এপিবিএন পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য নিয়োজিত রয়েছে।”
তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার বিকালে মুহিবুল্লাহর লাশ কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গ থেকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। হাবিবুল্লাহ লাশ বুঝে নেন। পরে পুলিশ পাহারায় তার লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানো হয়।
খুনের কারণ জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল বলেন, “রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের গুলিতেই মুহিবুল্লাহ খুন হয়েছে, এটা নিশ্চিত। কিন্তু কেন খুন করল, কারা খুন করল; তা এখন নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।”
“এ বিষয়ে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা খোঁজ-খবর নিচ্ছে। ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে,” বলেন তিনি।
উখিয়া থানার ওসি আহমেদ মঞ্জুর মোরশেদ জানান, মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনায় তার ভাই মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ২০/২৫ জনকে আসামি করে বৃহস্পতিবার রাতে মামলা করেছেন।
মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও খুনিদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে।