এই রক্ত রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহর। কক্সবাজারের ক্যাম্পে বুধবার রাতে নিজের এ অফিসেই তিনি দলবদ্ধ ঘাতকের গুলিতে নিহত হন।
বাড়ি ফেরার স্বপ্ন দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের যিনি উজ্জীবিত করে রেখেছিলেন, তার স্থায়ী ঠিকানা হয়ে গেল বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির; সেখানেই তাকে দাফন করেছেন সঙ্গী আর স্বজনরা।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহর আর মিয়ানমারের মংডুতে তার নিজের বাড়ি ফেরা হবে না।
রোহিঙ্গাদের কাছে মুহিবুল্লাহ ছিলেন বাড়ি ফেরার স্বপ্নে বিভোর এক মানুষ। গত কয়েক বছর ধরে নির্যাতনের মুখে মিয়ানমারে সবকিছু ফেলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা লাখো মানুষের মাঝে সেই স্বপ্ন তিনি বিলিয়ে আসছিলেন।
মুহিবুল্লাহর স্বজন ও অনুসারীদের দাবি, দেশে ফেরার এই স্বপ্নই তার কাল হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যেই একটা অংশ দেশে ফিরতে চায় না। সশস্ত্র দলটির সঙ্গে ‘মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর যোগাযোগ’ রয়েছে বলেও ক্যাম্পের অনেকের বিশ্বাস।
তারা বলছেন, সম্প্রতি মিয়ানমারের সরকারবিরোধী জোটের সঙ্গে মহিবুল্লাহদের আলোচনা বেশ ‘এগিয়েছিল’। ওই সরকারবিরোধী জোট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সমর্থন করেছে বলে মুহিবুল্লাহ অনুসারীদের দাবি।
বুধবার রাতে কক্সবাজারের উখিয়ায় লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিজের অফিসে ৪৮ বছর বয়সী মুহিবুল্লাহ যখন খুন হলেন, তার আগে প্রত্যাবাসন নিয়েই সেখানে বৈঠক চলছিল।
ওই ক্যাম্পের নারী নেত্রী জামালিদা বলেন, শুক্রবার তাদের আরেকটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। মুহিবুল্লাহ বুধবার রাতে ফোন করে ওই বৈঠকে তাকেও থাকতে বলেছিলেন। সেখানে মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী রাজনৈতিক দল এনইউজির ‘প্রতিনিধির সঙ্গে’ প্রত্যাবাসন নিয়ে আলাপ হওয়ার কথা ছিল।
শুক্রবার দুপুরে লম্বাশিয়া ক্যাম্পে গিয়ে দেখা গেল নিরাপত্তার কড়াকড়ি। মুহিবুল্লাহর অফিস কক্ষটি হলুদ টেপ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। আর্মড পুলিশের সদস্যরা পাহারা দিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে মুহিবুল্লাহর সাত বছরের বাক প্রতিবন্ধী মেয়ে আনোয়ারা লাঠি হাতে বসে রয়েছে একটি চেয়ারে।
আর্মড পুলিশের সদস্য মো. সুমন জানালেন, দিনভর শিশুটি তাদের সঙ্গে রয়েছে। কাউকে বাবার অফিসের ভেতরে যেতে দেয় না সে।
ক্যাম্পের ভেতরেই একটি কবরস্থানে রোহিঙ্গাদের এ নেতাকে দাফন করা হয়েছে। শুক্রবার জুমার নামাজের পর অন্য ক্যাম্পের রোহিঙ্গারাও সেখানে ভিড় জমান।
কবরস্থানের উল্টো দিকেই ছোট্ট একটি বাক্স বসিয়ে পান-সিগারেট বিক্রি করছিলেন তরুণ আনসারউল্লাহ। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই তারা শুনে আসছেন সবাইকে নিয়ে দেশে ফিরবেন মুহিবুল্লাহ। তার মৃত্যুর পর সেই সম্ভাবনা মিইয়ে গেল কি না- তা নিয়ে তরুণদের মধ্যে আলোচনা রয়েছে।
আনসারউল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই অন্তত ২৫/৩০ জনের ভিড় জমে যায়। এর মধ্যেই মুহিবুল্লাহর কথা শুনে কেঁদে ওঠেন আব্দুর রহিম।
“বাংলাদেশের একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন। তার মত একজন নেতা দরকার ছিল আমাদের।”
ভিনদেশের মাটিতে নিজেদের মধ্যে হানাহানির প্রতিযোগিতায় অনেক রোহিঙ্গাই মুহিবুল্লাহকে ‘মুক্তিকামী নেতার’ মর্যাদা দিয়ে আসছিলেন। তার হঠাৎ চলে যাওয়ায় বাকি জীবন এখানেই কাটাতে হবে কি না, সেই প্রশ্ন এখন তাদের অনেকের মনে।
৫৯ বছর বয়সী নূরউদ্দীন অনেকটা হতোদ্দম হয়ে বসেছিলেন বাজারের পাকা মেঝেতে। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ভিড় এবার নূরউদ্দীনের চারপাশ ঘিরে ধরে।
মুহিবুল্লাহ সবাইকে নিয়ে দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন জানিয়ে নূরউদ্দীন বলেন, “সে বলেছিল, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে আলোচনা করছেন। দেশেও অনেকের সঙ্গে মুহিবুল্লাহদের আলোচনা হচ্ছিল। সে বলেছিল, আমাদের এখানে পড়ে থাকতে হবে না।“
কবরস্থানের পাশে ভিড়ের মধ্যে ছিলেন অন্য একটি ক্যাম্প থেকে আসা মো. ইউসুফ ও মো. শফি। পঞ্চাশোর্ধ্ব শফি বললেন, “মুহিবল্লাহ ভাইয়ের কথা বলতে গেলে আমার বুক ফেটে যায়।“
মুহিবুল্লাহর ঘর থেকে একটু দূরেই জাহেদা বেগমের ঘর। সেই রাতে গুলির শব্দ শুনেছিলেন তিনি। শুক্রবার বিকালে তিনি বলেন, “মুহিবুল্লাহ ভাইকে সবাই পছন্দ করত। তার জন্য অনেকে কান্নাকাটি করছে। ক্যাম্পের ভেতরে ঘরে ঢুকে কেউ তাকে মারবে এটা ভাবতেও পারিনি।“
রাতের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো যে অনেকটেই ‘অরক্ষিত’ থাকে, সে আলোচনা পুরনো। বাসিন্দাদের ভাষ্য, রাতে অস্ত্রধারীদের আনাগোনা এখন তাদের চোখে ‘সয়ে গেছে’।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বুধবার রাতে ১৫-২০ জন হামলাকারী পিস্তলের মত অস্ত্র হাতে মুহিবুল্লাহর অফিসে ঢোকে। সে সময় ‘পুলিশ আইয়্যের- পুলিশ আইয়্যের’ বলে চিৎকার করছিল তারা।
পান দোকানদার আনসারউল্লাহ বলেন, ওই দলটি পশ্চিম দিক দিয়ে এসে চিৎকার করে ‘পুলিশ আসার’ খবর দিয়ে আবার সেদিকেই চলে যায়। এদিকে সত্যিই পুলিশ আসছে মনে করে আশপাশে থাকা রোহিঙ্গারা যার যার ঘরে ঢুকে পড়েন।
“এই সুযোগে তারা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে দল বেঁধে পালিয়ে যায়। তারা সবাই লুঙ্গি পরা ছিল। কয়েকজনের মাথায় টুপি (ক্যাপ) ছিল। মুখে মাস্ক বা গামছা বাঁধা ছিল সবার।“
মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেছিলে, বুধবার রাতে উখিয়ার ১ ইস্ট নম্বর লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্থানীয় মসজিদে দুই ভাই মিলে নামাজ পড়েছিলে তারা। এরপর তারা আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস অফিসে যান। সেখানে মুহিবুল্লাহ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতার সঙ্গে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলাপ করছিলেন।
পরে হাবিবুল্লাহ রাতের খাবার খেতে ঘরে চলে যান। খাওয়ার মধ্যেই গুলির শব্দ শুনে এআরএসপিএইচআর অফিসে ছুটে গিয়ে ভাইকে রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেন। সে সময় ১৫/২০ জন অস্ত্রধারী লোক তাকে ঘিরে ছিল বলে হাবিবুল্লাহর ভাষ্য।
দুজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, হামলাকারীদের হাতে পিস্তল ছিল। এবং তাদের ধারণা, সেগুলো বিদেশি অস্ত্র।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উখিয়া থানার উপপরিদর্শক কার্তিক চন্দ্র পাল অবশ্য একমত নন। তিনি বলেন, “হামলাকারীদের হাতে স্থানীয়ভাবে তৈর করা আগ্নেয়াস্ত্র থাকতে পারে, ওরা বিদেশি অস্ত্র কোথায় পাবে?”
মুহিবুল্লাহর শরীরে পাওয়া গুলি বা গুলির খোসা থেকে অস্ত্রের ধরন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “চোরাবাজারে যেসব গুলি কিনতে পাওয়া যায় সেগুলো দেশি অস্ত্রেও ব্যবহৃত হতে পারে।“
আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে শুক্রবার এক রোহিঙ্গাকে আটক করেছে ক্যাম্পের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন। আটক ওই ব্যক্তিও লম্বাশিয়া ক্যাম্পের বাসিন্দা।
১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নইমুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে উখিয়া উপজেলার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া ক্যাম্পের এপিবিএন সদস্যরা ওই রোহিঙ্গাকে আটক করে।
আটক যুবকের নাম সেলিম উল্লাহ, বয়স ৩০। কেন তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে, সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য দেয়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কারা কেন মুহিবুল্লাহকে হত্যা করে থাকতে পারে, সে বিষয়েও পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য আসেনি।
‘দায় নেয়নি’ আরসা
নিহত রোহিঙ্গা নেতার ভাই হাবিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই এ হত্যাকাণ্ডের জন্য আরাকান রিপাবলিকান স্যালভেশন আর্মিকে (আরসা) দায়ী করে আসছেন। তার দাবি, আরসার নেতা মাস্টার আব্দুর রহিম, লালু ও মুর্শিদসহ ৩/৪ জনকে তিনি ‘চিনতে পেরেছেন’।
তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক অডিও বার্তায় আরসা বলেছে, তারা মুহিবুল্লাহকে খুন করেনি। ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের অনেকের মোবাইল ফোনেই ওই অডিও বার্তা রয়েছে। তাদের ভাষ্য, আরসার নেতা আতাউল্লাহর সহযোগী সোয়াইব ওই বার্তাটি তাদের দিয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, “আমাদের কী গরজ পড়েছে মাস্টার মুহিবুল্লাহকে খুন করার। কে না কে খুন করেছে, এখন আমাদের ওপর দায় চাপাচ্ছে মুহিবুল্লাহর ভাই।”
চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী লিখেছে, আরসার প্রধান আতাউল্লাহ জুনুনীর পক্ষ থেকে মুখপাত্র সোয়াইব ওই ভিডিও বার্তাটি দিয়েছেন।