দেওয়ানের পুল ভেঙে বা পাশে নতুন সেতু নির্মাণের প্রকল্পটিও বাতিল হয়েছে বলে জানিয়েছে এলজিইডি।
Published : 26 Apr 2024, 09:39 AM
সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় মুঘল আমলে নির্মিত ‘দেওয়ানের পুল’ ভেঙে ফেলার কাজ পরিবেশকর্মীদের আন্দোলনের মুখে বন্ধ হয়েছে। কিন্তু এর প্রায় দেড় বছর পরেও শুরু হয়নি সেতুটির সংস্কার কাজ।
পাশাপাশি নতুন সেতু তৈরি না হওয়ায় চলাচলের ভোগান্তিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাউশা এলাকার দেওরভাগা খালের ওপর নির্মিত প্রত্নতাত্ত্বিক এ নিদর্শনটি ভেঙে নতুন একটি সেতু নির্মাণের প্রকল্প নেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর-এলজিইডি।
কিন্তু ২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৬ ফুট প্রস্থের প্রাচীন স্থাপনাটি ভাঙার প্রতিবাদ করে একে ‘পুরাকীর্তি’ হিসেবে সংরক্ষণের দাবিতে সোচ্চার হয় মানুষ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সিলেটের কয়েকজন সদস্য সেখানে গিয়ে বাধা দেন। ঐতিহ্যবাহী সেতুটি অক্ষতভাবে সংরক্ষণ এবং ভেঙে ফেলা অংশ পুনরায় নির্মাণেরও দাবি জানান তারা।
তখন সমালোচনার মুখে সেতুটি ভাঙা বন্ধ করতে চিঠি দেয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। পরে তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ সেতুটি ভাঙার কাজ বন্ধ রাখতে নির্দেশনা দেন।
সেসময় দেওয়ানের পুল রক্ষায় আন্দোলন করেছিলেন সিলেটের পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গোলাম সোবহান চৌধুরী। ঐতিহাসিক সেতুটি ভাঙার এতদিন পরও সংস্কার কাজ না হওয়াতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্তারা স্বীকার করছেন, নির্মাণ শৈলী এবং শৈল্পিক রীতি বলছে এটা মুঘল আমলে নির্মিত। এমন প্রাচীন প্রত্ন স্থাপনা আইন অনুযায়ী অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু ভেঙে ফেলা অংশ এখনও মেরামত না করা কী উদ্দেশ্যে…?”
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক (সিলেট বিভাগ) এ কে এম সাইফুর রহমান বলেন, “দেওয়ানের পুলকে পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করতে অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। আমাদের আগ্রহ আছে এটিকে সংরক্ষণ ও সংস্কার করার।”
কবে শুরু হতে পারে সংরক্ষণ ও সংস্কার কাজ এ বিষয়ে তিনি বলেন, “সংরক্ষণের প্রক্রিয়া অনুযায়ী আমাদের কাজ করতে হবে; দেওয়ানের পুলের প্রতি আমাদের আলাদা নজর রয়েছে। যখন এটা নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়েছিল তখন আমাদের লোক গিয়ে পরিদর্শনও করেছেন।”
এ রকম প্রাচীন স্থাপনা দ্রুত সংস্কার না করলে পরবর্তীতে সংস্কার করা কঠিন হয় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট সিলেট সেন্টারের সাধারণ সম্পাদক রাজন দাস।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “দেওয়ানের পুল মুঘল আমলের স্থাপত্য; এটি চুন-সুরকি ব্যবহার করে নির্মাণ করা হয়েছিল। তাই বৃষ্টি হচ্ছে এর প্রধান শত্রু; বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে স্থাপনাটি ঢেকে রাখা উচিত।”
তিনি আরও বলেন, “প্রাচীন স্থাপনা সংস্কারে বাংলাদেশে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন; উনাদের দ্বারা সেতুটির সংস্কার কাজ করাতে হবে। তা না হলে সঠিকভাবে সংস্কার হবে না।”
এদিকে দেওয়ানের পুল ভেঙে বা পাশে নতুন ব্রিজ নির্মাণের প্রকল্পটি বাতিল হয়েছে বলে জানিয়েছেন এলজিইডি সিলেট জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী কে এম ফারুক হোসেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুল ভেঙে ব্রিজ নির্মাণ বা পাশে নতুন ব্রিজ নির্মাণে আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। দেওয়ানের পুলের সংস্কার কাজ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর করবে।”
তবে ওই স্থানে নতুন সেতু নির্মাণের প্রকল্প বাতিল করা ঠিক হয়নি বলে দাবি করেছেন সিলেটের পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি গোলাম সোবহান চৌধুরী।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা বলেছিলাম, মুঘল আমলের সেতুর পাশে নতুন ব্রিজ হোক। সরেজমিনে আমরা দেখেছি পুরাতন সেতুর পাশে আরেকটি নতুন সেতু নির্মাণ করার পর্যাপ্ত জায়গা আছে। স্থানীয়দেরও অভিমত ছিল একটি নতুন ব্রিজ হলে জনসাধারণের চলাচলে সুবিধা হয়।
“এখন প্রকল্প বাতিলের সংবাদে মানুষ ক্ষুব্ধ হবে; সেটা ঠিক হয়নি। ঐতিহ্য ও উন্নয়ন সাংঘর্ষিক নয়। দায়িত্বশীলদের ভ্রান্ত কর্মকাণ্ডের ফলে সমাজে ভুল তথ্য যাবে। ঐতিহ্য রক্ষা করেই উন্নয়ন সম্ভব; সেটা করতে হবে।”
এদিকে সম্প্রতি দেওয়ানের পুলের বর্তমান অবস্থা দেখতে গিয়েছিলেন দক্ষিণ সুরমার বাসিন্দা মনতোষ সরকার। তিনি ১৬ বছর ওই এলাকায় শিক্ষকতা করেছেন।
তার ভাষ্য, “ঐতিহাসিক দেওয়ানের পুলের ভাঙা অবস্থা দেখে খুব খারাপ লেগেছে। নিজেদেরকে ভঙ্গুর জাতি বলেই মনে হয়েছে। কারণ আমরা ঐতিহ্য সংরক্ষণ বুঝি না; মেরামত করতেও আমাদের দারুণ অনীহা। তা না হলে এতদিন ধরে পুলটি এ অবস্থায় থাকার কথা না।”
সরজমিনে যা দেখা গেছে
সম্প্রতি দেওয়ানের পুল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সংস্কার কাজ না হওয়া পুলের ভাঙা দুই অংশ বাঁশের পাটাতন দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছে।
কিন্তু তা দিয়ে অটোরিকশা চালকেরা যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে পারেন না। মানুষজন হেঁটে সেতু পার হয়ে আবার গাড়িতে উঠেন। এ ছাড়া ভেঙে ফেলে রাখার কারণে সৌন্দর্য হারিয়েছে সেতুটি।
স্থানীয় বাসিন্দা সমীর বলেন, “শুনেছিলাম এখানে নতুন আরেকটি ব্রিজ হবে কিন্তু তা হয়নি। পুরাতন পুলটাকেও ঠিক করা হয়নি। এলাকাবাসী ভাঙা পুল দিয়ে কষ্ট করে আসা-যাওয়া করেন; দেখার কেউ নেই।”
কথা হয় দেওয়ানের সড়কের অটোরিকশা চালক জাবেদ মিয়ার সঙ্গে। তার ভাষ্য, “আমরা প্রতিদিন ট্রিপ নিয়ে এই সড়ক দিয়ে সিলেট টু ঢাকাদক্ষিণ যাই, আবার আসি। দেওয়ানের পুলের আগে এসে যাত্রীদের নামিয়ে দেই। তারপর বাঁশের উপর দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি পার করি।”
ঝুঁকি নেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “এই রাস্তা দিয়ে গেলে আমাদের কয়েক কিলোমিটার সড়ক ঘুরতে হয় না। আর গোলাপগঞ্জ উপজেলা সদর হয়ে গেলে ঘুরতে হয়, গাড়ির গ্যাসও বেশি লাগে।”
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ভেঙে রাখা পুরান পুলটি ঠিক করার কোনো লক্ষণ দেখছি না, ভাই। নতুন করে ব্রিজ করারও কোনো কিছু দেখা যাচ্ছে না। তাহলে এটি কেন ভাঙা হলো। আমরা আগে এ পুল দিয়ে সহজে যাত্রী নিয়ে চলাচল করছি, এখন পারি না।”
দেওয়ানের পুলের ইতিকথা
গোলাপগঞ্জ উপজেলার সরকারি তথ্য বাতায়নে উল্লেখ করা হয়েছে, “মুঘল সম্রাট মুহম্মদ শাহ (১৭১৯-৪৮) এর রাজত্বকালে আনুমানিক ১৭৪০ সালে অল্পকালের জন্য সিলেটের দেওয়ান (রাজস্ব কর্মকর্তা) নিযুক্ত হয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে সিলেট আসেন গোলাব রাম (মতান্তরে গোলাব রায়)।
“দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই এই ধর্মপ্রাণ দেওয়ান গোলাপগঞ্জের ঢাকাদক্ষিণে শ্রী চৈতন্যের পিতৃভূমি সম্পর্কে অবগত হন। তার নির্দেশে সিলেট থেকে ঢাকা দক্ষিণ পর্যন্ত সড়ক ও সেতু নির্মিত হয়।
“হেতিমগঞ্জ থেকে ঢাকা দক্ষিণগামী সড়কটি আজও দেওয়ান সড়ক নামে পরিচিত। এ সড়কে দেওয়ানের পুল নামে একটি প্রাচীন কালভার্ট আজও বর্তমান।”
ধারণা করা হয়, এই দেওয়ানের নামানুসারেই সুরমা নদী তীরে ‘গোলাবগঞ্জ’ নামে এক বাজার গড়ে ওঠে যা কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে ‘গোলাপগঞ্জ’ নাম ধারণ করে।
গোলাপগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে জানা যায়, সেতুটি ভারী যান বহনের ক্ষমতা হারানোর কারণে পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পুরোনো সেতুটির দৈর্ঘ্য ছিল ২০ ফুট ও প্রস্থ ১৬ ফুট। একই জায়গায় ৯৯ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩২ ফুট প্রস্থের নতুন সেতু বানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর জন্য ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়।
কিন্তু পরে সেই প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।
আরও পড়ুন
দেওয়ানের পুল ভাঙায় গণশুনানি ‘পাতানো’: পরিবেশ আন্দোলন