সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য হলেও তিনি চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের রশীদকে সমর্থন দিচ্ছেন।
Published : 26 Apr 2024, 11:22 AM
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতার মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া গেছে। পিছিয়ে নেই উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হওয়ার প্রত্যাশায় ইউপি চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে আসা জাতীয় পার্টির নেতাও। জনপ্রতিনিধি হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন তার ছেলেও।
সব মিলিয়ে প্রথম ধাপে আগামী ৮ মে বন্দর উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে এবার ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
এ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন- বর্তমান চেয়ারম্যান বন্দর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ রশীদ (দোয়াত-কলম), সাবেক চেয়ারম্যান মহানগর বিএনপির সাবেক সহসভাপতি আতাউর রহমান মুকুল (চিংড়ি মাছ), মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান জেলা জাতীয় পার্টির সহসভাপতি মাকসুদ হোসেন (আনারস) এবং তার ছেলে মাহমুদুল হাসান শুভ (হেলিকপ্টার)।
ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন- দুবারের ভাইস চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির জেলা কমিটির সভাপতি সানাউল্লাহ সানু (উড়োজাহাজ), বন্দর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম জুয়েল (টিউবওয়েল), আলমগীর হোসেন (মাইক) ও মোশাঈদ রহমান (তালা)।
সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর একজন বর্তমান নারী ভাইস চেয়ারম্যান ছালিমা হোসেন (ফুটবল) এবং আরেকজন সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার (কলস)।
১৭ এপ্রিল মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে বন্দর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পাঁচ চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীসহ ১১ জনকে বৈধ ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা কাজী ইস্তাফিজুল হক আকন্দ।
পরে ২২ এপ্রিল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিন চেয়ারম্যান পদে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম আবু সুফিয়ান।
২৩ এপ্রিল চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে মোট ১০ প্রার্থীকে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতীক পেয়ে নির্বাচনি এলাকাগুলোতে প্রচারও শুরু করেছেন তারা। তীব্র গরমকে উপেক্ষা করে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা ছুটছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। নানা প্রতিশ্রুতিতে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করছেন।
# বন্দর উপজেলায় এবার ১০ প্রার্থী লড়াই করছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে চারজন, সাধারণ ভাইস চেয়ারম্যান পদে চারজন এবং সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
# বন্দর উপজেলায় মোট ভোটারের সংখ্যা ১ লাখ ৩১ হাজার ৫৬৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬৭ হাজার ৫০০ জন; নারী ভোটার ৬৪ হাজার ৬২ জন এবং হিজড়া ভোটার ২ জন।
# প্রথম ধাপে ৮ মে মোট ৫৪টি কেন্দ্রে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করবে নির্বাচন কমিশন।
# ২০১৮ সালের নির্বাচনে এ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে এম এ রশিদ বিনাভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
# পঞ্চম উপজেলায় চেয়ারম্যান হন আওয়ামী লীগের এম এ রশীদ। চতুর্থ ও তৃতীয়বারে চেয়ারম্যান ছিলেন বিএনপির আতাউর রহমান মুকুল। দ্বিতীয় নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির শামসুল করিম। আর প্রথমবার ছিলেন বাওয়ানী জুট মিল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক (শ্রমিক নেতা) এমদাদ হোসেন।
বন্দর, মুছাপুর, ধামগড়, কলাগাছিয়া, মদনপুর; এই পাঁচ ইউনিয়ন নিয়ে প্রায় ৫৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বন্দর উপজেলা তিন দিক দিয়ে শীতলক্ষ্যা, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও ধলেশ্বরী নদী দিয়ে বেষ্টিত।
প্রতীক বরাদ্দের আগে আনুষ্ঠানিক প্রচারে বিধিনিষেধ থাকলেও প্রার্থীরা কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ভোটের মাঠে সরব ছিলেন। প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে প্রচারে মাত্রা বেড়েছে; দিনে এবং রাতে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন তারা।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না পেলেও বর্তমান চেয়ারম্যান এম এ রশীদ দলীয় সমর্থন পাচ্ছেন। তার বিপরীতে দলেরই আরেক প্রার্থী আবু সুফিয়ান দলীয়ভাবে সমঝোতায় রাজি হয়েছেন। তিনি রশীদকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনি মাঠ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
১৯ এপ্রিল (শুক্রবার) মদনপুরের এক রিসোর্টে আওয়ামী লীগ নেতাদের বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে এম এ রশীদ ও আবু সুফিয়ান দুজনই উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যস্থতায় আবু সুফিয়ান নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে রশীদের পক্ষে কাজ করার কথা জানান। পরে তিনি তার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারও করে নেন।
এ প্রসঙ্গে কথা হলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত মো. শহীদ বাদল বলেন, “নৌকা প্রতীক না থাকলেও দলীয়ভাবে রশীদের পক্ষেই আওয়ামী লীগের সমর্থন রয়েছে।”
এদিকে এম এ রশীদ সমর্থন পাচ্ছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমানেরও। সেলিম ওসমান জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য হলেও তিনি এ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের রশীদকে সমর্থন দিচ্ছেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর একাধিক অনুষ্ঠানে রশীদকে সমর্থন করে তিনি বক্তব্যও দিয়েছেন।
গতবারের উপজেলা নির্বাচনেও সেলিম ওসমান আওয়ামী লীগের রশীদের পক্ষে ছিলেন। সেবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রথমবারের মতো চেয়ারম্যান হন এম এ রশীদ।
এদিকে নির্বাচনে বিজয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী বলে এম এ রশীদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “আমার বিগত সময়ের কাজ দেখে মানুষ আমাকে ভোট দেবে। প্রতীক পাওয়ার পর থেকে আমি মানুষের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছি। তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। সব পর্যায়ের মানুষই আমার পাশে আছেন।”
মোবাইল ফোনে কথা বলার সময়ও গণসংযোগে ব্যস্ত থাকার কথা জানান এ প্রার্থী।
এদিকে গত নির্বাচনে রশীদকে ছাড় দিলেও এবার বেশ শক্তভাবেই মাঠে নেমেছেন বিএনপি নেতা আতাউর রহমান মুকুল। তিনি এ উপজেলায় পরপর দুইবারের চেয়ারম্যান। মাঠ পর্যায়েও বেশ ‘সমর্থন’ রয়েছে তার। গত ৩০ ডিসেম্বর জেলার ছয় নেতাকে বহিষ্কার করে বিএনপি; এই তালিকায় আতাউরও রয়েছেন।
যদিও ভোটের মাঠে এর কোনো ‘প্রভাব পড়বে না’ বলে দাবি আতাউরের। বরং ভোটের মাঠে তার অবস্থান বেশ ‘শক্ত’ বলে দাবি তার।
আতাউর রহমান মুকুল বলেন, “দল এবং ব্যক্তিগত- দুই ভাবেই আমি মাঠে আছি। আমি এই উপজেলায় জনগণের ভোটে দুইবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। তখনও যেমন সব দলের লোক আমাকে ভোট দিয়েছে, এবারও দেবে।”
এদিকে, ‘জনপ্রিয়তায়’ ভীত হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জাতীয় পার্টির মাকসুদ হোসেন তার নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়ে ভয়-ভীতি দেখাচ্ছেন বলে অভিযোগ মুকুলের।
যদিও এই বিষয়ে মাকসুদ হোসেনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল নম্বরে একাধিকবার চেষ্টা করেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
সার্বিক পরিস্থিতি অনুযায়ী এবারের নির্বাচনে আতাউর রহমান মুকুল ও এম এ রশীদ- এই দুই সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যানের লড়াইয়ে মাকসুদ হোসেনও একটি ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়িয়েছেন বলে মত স্থানীয় ভোটারদের।
ভোটাররা বলছেন, উপজেলা চেয়ারম্যান হতে ইউপি চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দেওয়া মাকসুদ নিজ ইউনিয়ন মুছাপুরের বাইরেও পুরো উপজেলায় অনুসারী কর্মী-সমর্থকদের মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। নির্বাচনি মাঠ অবাধ ও সুষ্ঠু থাকলে নতুন ও পুরাতনের লড়াইয়ে বাজিমাত করতে পারেন মাকসুদও।
কারণ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের মধ্যে নিজের ইউনিয়ন ছাড়া আরও একটিতে রয়েছে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। দলীয় নেতা হিসেবে কলাগাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের সমর্থন মাকসুদের পক্ষে থাকার সম্ভবনা রয়েছে।
তবে দেলোয়ার সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের ঘনিষ্ঠ অনুসারী বলে পরিচিত। সেক্ষেত্রে সংসদ সদস্যের পছন্দের প্রার্থী রশীদকে পাশ কাটিয়ে মাকসুদকে সমর্থন দেওয়া দেলোয়ারের জন্য সহজ হবে না বলেও মনে করছেন অনেকে।
বন্দর ইউনিয়ন পরিষদের বাসিন্দা আবু জাফর বলেন, “গতবার তো আমরা চেয়ারম্যান কাউরে ভোট দিতে পারি নাই। বিনা ভোটেই চেয়ারম্যান হইছেন রশীদ সাহেব। এবার অন্তত ভোট হচ্ছে; তবে তা সুষ্ঠু হবে কী-না তা এখনও বলা যাইতেছে না।
“কিন্তু সুষ্ঠু ভোট হলে এইবার রশীদ সাহেব আর মুকুল সাহেবের মধ্যে লড়াইটা জমবো।’
মুছাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা সবজি বিক্রেতা মো. কামালের ভাষ্য, সাবেক চেয়ারম্যান হওয়ায় এই ইউনিয়নের ভোটের হিসাবে মাকসুদ হোসেনের পাল্লা ভারী।
কামাল বলছিলেন, “অন্য এলাকার কথা জানি না। কিন্তু মাকসুদ ভাই মুছাপুরের মানুষের পাশে ছিল। লোকজন তারেই ভোট দিব।”
কলাগাছিয়া ইউনিয়নের তরুণ ভোটার ফয়সাল হোসেন বলেন, “আমরা চাই একজন ভালো জনপ্রতিনিধি। গত কয়েক বছরে উপজেলার এলাকাগুলোতে রাস্তাঘাটের উন্নয়নসহ শিক্ষা, চিকিৎসা খাতে তেমন কাজ হয়নি।
“তাছাড়া বন্দরে চোর-ডাকাতের উৎপাতও খুব বেশি। এলাকার উন্নয়ন আর মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব যেই প্রার্থী নিবেন, ভোটাররা তাকেই ভোট দেবেন।”
এদিকে দ্বিতীয় স্ত্রীর করা যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের অভিযোগে করা এক মামলায় বিপাকে পড়েন চেয়ারম্যান প্রার্থী মাকসুদ হোসেন। যদিও বৃহস্পতিবার হাই কোর্ট থেকে এই মামলায় জামিন পেয়েছেন তিনি।
এদিকে ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুইবারের নির্বাচিত সানাউল্লাহ সানুর পথটি এবার সুগম নয়। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে শক্ত অবস্থানে আছেন যুবলীগ নেতা শহিদুল ইসলাম জুয়েল।
নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে এবারও ছালিমা হোসেন ও মাহমুদা আক্তারের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে মনে করছেন ভোটাররা। গতবার অল্প ব্যবধানে পরাজিত হলেও সাবেক নারী ভাইস চেয়ারম্যান মাহমুদা এবার জয় পেতে প্রচার চালাচ্ছেন জোরেশোরে।
ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সানাউল্লাহ সানু বলছেন, “প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকলে তো নির্বাচন জমে না৷ কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী কাউকে নিয়ে আমার কোনো টেনশন নাই৷ তারা তাদের মতো করে প্রচার চালাক, মাঠ গরম রাখুক৷
“কিন্তু ভোটের লড়াইতে বিজয় আমারই হবে, অন্য কেউ পাত্তা পাবে না৷ তারা তো আমার কাছে বাচ্চা পোলাপান৷ গত দুইবারের মতো এবারও ভোটাররা তাদের রায় জানাবে৷”
জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী শহিদুল ইসলাম জুয়েলও৷ তিনি বলছেন, “আমি ভোটারদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি৷ বন্দরের মানুষ নতুন কাউকে চায়৷ নির্বাচন কমিশন যদি সুষ্ঠু ও সুন্দর একটা নির্বাচন উপহার দিতে পারে তাহলে আমি জয়ী হব৷”