ঋণ-অনিয়ম বিষয়ে এক প্রশ্নে বর্ষীয়ান শিল্পোদ্যোক্তা খলিলুর রহমান বলেন, ‘‘ন্যাশনাল ব্যাংকে লুটপাট আর হবে না, এক পয়সাও লুটপাট হবে না। এতটুকু আপনাদের বলতে পারি।’’
Published : 06 May 2024, 09:06 PM
খেলাপি ঋণ, অনিয়মে জর্জরিত ন্যাশনাল ব্যাংকের অবস্থা এক বছরের মধ্যে ভালো হবে দাবি করে নতুন চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান বলেছেন, অন্য কারও সঙ্গে একীভূতও হবে না প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকটি।
তার ভাষ্য, “আগামী এক বছরের মধ্যে আর্থিক স্বাস্থ্যে উন্নীত হওয়ার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে সম্মতি দিয়েছে।”
সাড়ে চার মাসের মাথায় আবার নতুন পর্ষদ গঠনের পরদিন সোমবার বিকালে রাজধানীর বাংলা মোটরে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এমন দাবি করেন খলিলুর রহমান; যিনি ৪০ বছরের বেশি সময় আগে সম্পূর্ণ দেশি মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটির উদ্যোক্তা পরিচালকদের একজন।
বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডকে (এনবিএল) দেশের সবার ব্যাংক দাবি করে নতুন চেয়ারম্যান বলেছেন, সবার সহযোগিতা পেলে ব্যাংকটি দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর শেষে এনবিএল এর আর্থিক প্রতিবেদন সন্তোষজনক অবস্থানে উন্নীত হলে একীভূত হওয়ার মতো পরিস্থিতি থেকে বেঁচে যাবে ব্যাংকটি।
গত বৃহস্পতিবার ব্যাংকটি থেকে সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ারসহ চার পরিচালক পদত্যাগ করেন। এরপর গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ সদস্যের নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেয়। এতে উদ্যোক্তা পরিচালক খলিলুর ছাড়াও আরেক উদ্যোক্তা পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেনকে রাখা হয়। আর গত দেড় দশকের মধ্যে প্রথমবার সিকদার পরিবারের কাউকে রাখা হয়নি।
নতুন পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়ে সোমবার আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে আসেন চট্টগ্রামভিত্তিকি শিল্প গ্রুপ কেডিএসের কর্ণধার খলিলুর রহমান। এ সময় আরও তিন পরিচালক উপস্থিত ছিলেন।
ঋণ অনিয়ম হওয়া সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে বর্ষীয়ান শিল্পোদ্যোক্তা খলিলুর বলেন, ‘‘ন্যাশনাল ব্যাংকে লুটপাট আর হবে না, এক পয়সাও লুটপাট হবে না। এতটুকু আপনাদের বলতে পারি।’’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড় করাতে উদ্যোক্তারা নতুন করে এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে। নতুন পর্ষদ তিন হাজার কোটি টাকার আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে।
ন্যাশনাল ব্যাংককে ব্যবসায়ীবান্ধব ব্যাংক হিসেবে গড়া হবে মন্তব্য করে খলিলুর বলেন, “ব্যবসায়ীদের প্রয়োজন আমরা বুঝি। ব্যবসায়ীদের সহযোগিতার মাধ্যমে ব্যাংক হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে।”
এসময় ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়াতে সংবাদমাধ্যমের সহযোগিতা চান তিনি।
তিনি বলেন, নতুন পর্ষদ পুরনো ঋণ আদায়, ব্যাংকের বিদ্যমান ব্যবসা বাণিজ্যকে সম্প্রসারণ করা ও মুনাফায় ফিরতে চেষ্টা করবে।
গত ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক আগের পর্ষদ বাতিল করে এনবিএলের চেয়ারম্যান করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ারকে। স্বতন্ত্র পরিচালক মনোনীত করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম ও সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসেনকে।
গত বৃহস্পতিবার তারা একযোগে সবাই পদত্যাগ করেন। তাদের সঙ্গে পর্ষদে থাকা সিকদার পরিবারের একমাত্র সদস্য পারভীন হক সিকদারও পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগের মাধ্যমে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে সিকদার পরিবারের অধ্যায় শেষ হল এনবিএলে।
১৯৮৩ সালে প্রায় একই সময়ে গঠিত ইউসিবিএলের সঙ্গে একীভূত হওয়া নিয়ে আলোচনা এবং এনবিএলের পর্ষদে এর বিরোধিতা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যে পর্ষদ ভেঙে দেওয়া ও পুর্নগঠনের খবর আসে রোববার।
দশ সদস্যের নতুন পর্ষদে খলিলুর রহমানসহ আগের তিন পরিচালককে রাখা হয়েছে। পুরনোর মধ্যে আছেন উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ও সিকদার ইন্স্যুরেন্সের মনোনীত পরিচালক সফিকুর রহমান।
নতুন পর্ষদে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে এসেছেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক কমিশনার ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন নিজামী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট রত্না দত্ত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক জহুরুল হুদা।
প্রতিনিধি পরিচালক হয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক একে এম তফাজ্জল হক, প্রিমিয়ার ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রিয়াজুল করিম, ব্যবসায়ী এরশাদ মাহমুদ ও আইনজীবী এহসানুল করিম।
নিয়ম ও বিধি ভাঙাসহ বিভিন্ন কারণ তুলে ধরে নানা অনিয়মে ধুঁকতে থাকা বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক গত ২০২৩ সালেও প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। আগের বছরে লোকসান দিয়েছিল তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা।
১৯৮৩ সালে ১৮ উদ্যোক্তা পরিচালক শুরু করেন ন্যাশনাল ব্যাংক, যাদের মধ্যে ছিলেন একেএম আবু তাহের, আবু তাহের মিয়া, জয়নুল হক সিকদার, খলিলুর রহমান ও মোয়াজ্জেম হোসেন।
এরপর ২০০৯ সালে পরিচালনা পর্ষদে ব্যাপক বদলের মাধ্যমে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের কাছে। এরপর একে একে অন্য পরিবারের পরিচালকরা পর্ষদ থেকে বাদ পড়েন। জয়নুল হক সিকদারের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েরা পর্ষদে আসেন।
এক যুগের বেশি সময় ধরে চেয়ারম্যান পদে থাকা অবস্থায় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মারা যান জয়নুল হক সিকদার। তার পর তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন গত ডিসেম্বর পর্যন্ত।
এক বছর পর ২০২২ সালের অগাস্টে পর্ষদ থেকে সরে যেতে হয় উদ্যোক্তা পরিচালক ও হোসাফ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন। একই পরিবারের মাবরুর হোসেনও বাদ পড়েন।
এর মাধ্যমে ব্যাংকটিতে সিকদার পরিবারের কর্তৃত্ব আরও নিরঙ্কুশ হয়। এ পরিবারের বাইরে পরিচালক হিসেবে তখন ছিলেন উদ্যোক্তা পরচিালকদের মধ্যে কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যাংকটির পরিচালক ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন।
বাবার মৃত্যুর পর ব্যাংক ও পারিবারিক ব্যবসার উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন রন হক সিকদার, রিক হক সিকদার ও কন্যা পারভীন হক সিকদার। সন্তানদের বিবাদ সামাল দিতে অনেকটা ব্যর্থ হন মনোয়ারা হক সিকদার। পারিবারিক দ্বন্দের প্রভাব পড়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের উপরও। পরিচালক পর্ষদে সিকদার পরিবারের চার পরিচালক থাকায় বিবাদ স্পষ্ট হয়ে উঠে।
এরমধ্যে ঋণ নিয়ে অনিয়ম এবং সিকদার পরিবারের সদস্য পরিচালকদের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে প্রায় দেড়শত কোটি টাকার অর্থপাচার ও ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ হয়। পরে ২০২৩ সাল থেকে হস্তক্ষেপ শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বছরের শেষ দিকে ডিসেম্বরে পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন...
ফের এনবিএলের পর্ষদ পুনর্গঠন, চেয়ারম্যানসহ ৪ পরিচালকের পদত্যাগ
একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত 'এখনই না', সময় নেবে এনবিএল: চেয়ারম্যা
৪০ বছর পেরিয়ে অন্য ব্যাংকে মিলবে এনবিএল, আলোচনায় ইউসিবির নাম