Published : 29 Apr 2025, 12:41 AM
চলচ্চিত্র একটি দেশের নাম ছড়িয়ে দিতে পারে সারা বিশ্বে, কেবল তাই নয়, সিনেমা দিয়েই নির্মাতা-অভিনয় শিল্পীরা নানা দেশের মানুষের কাছ থেকে ‘সমীহ’ পেতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন অভিনেতা নির্দেশক আফজাল হোসেন।
স্বাধীনতা উত্তর ও পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের কথা স্মরণ করে এই অভিনেতা আক্ষেপ ঝরিয়ে বলেছেন, সারা বিশ্বে যখন সিনেমার রূপান্তর ঘটছে, তখন বাংলাদেশে ‘সিনেমার মত সিনেমা বানানো প্রায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে’ এবং দর্শকও সিনেমা দেখা ছেড়ে দিয়েছেন।
আফজালের কথায়, “আমাদের ঝলমলে সিনেমাজগৎটা অন্ধকারে ডুবে গেল।”
আফজাল হোসেন মনে করেন, সিনেমায় পরিবর্তন আনতে পারেন তারকাভিনেতারা। তারকাকেও বদলে দিতে পারে সিনেমা। তবে দেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির বেহাল দশার জন্য দর্শকদেরও কিছুটা দায় দেখছেন আফজাল।
এদিকে এবারের ঈদে মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলো দেখতে দর্শক আগ্রহকে ঢাকাই সিনেমার জন্য দারুণ সন্তোষজনক পরিস্থিতি বলে মনে করছেন আফজাল।
ফেইসবুকে এক দীর্ঘ পোস্টে সিনেমার একাল-একাল এবং নির্মাতা-দর্শকদের মনোভাবের কথা তুলে ধরেছেন আফজাল।
‘আমাদের যৌবনে সিনেমা দেখাটা ছিল উদযাপন’
নিজেকে ‘সিনেমাপাগল’ বর্ণনা করে আফজাল লিখেছেন, “ছিলাম সিনেমার পাগল। এতটাই পাগলামো ছিল, ঢাকাতে যেদিন প্রথম পা দেই, শহর তেমন আকৃষ্ট করেনি, করেছিল সিনেমা হল। বলাকা সিনেমা হলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখি, ‘দর্পচূর্ণ’ চলছে। গ্রামের ছেলে, মফস্বলের সিনেমা ঘরে ছয় মাসের বা এক বছরের পুরানো সিনেমা দেখতে হত। ‘দর্পচূর্ণের’ বিশালাকারের ঝলমলে ব্যানার দেখে নেশা চেপে গেল, আজকেই সিনেমাটা দেখতে হবে।”
‘বলাকা’ সিনেমা হল এখনো মনজুড়ে আছে আফজালের। তবে হলের বেহাল দশা তার মর্মবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“এখনও বলাকা সিনেমা হলের সামনে দিয়ে যখনই যাই, আমার মন ঘুরে তাকায় বলাকার দিকে। আজও তাকিয়েছি। তাকিয়ে দেখে খুব কষ্ট হল- কেমন সর্বশান্ত হয়ে দাঁডিয়ে রয়েছে সে সিনেমা ঘরটা।”
শহরের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা সিনেমা হলের চিত্র উঠে এসেছে আফজালের লেখায়। তিনি মিরপুর থেকে বের হওয়ার সময় এখনো ডান দিকে ঘুরে ‘বিউটি’ সিনেমা হলটাকে খোঁজেন।
মতিঝিল আফজালের স্মৃতির এলাকা।
“অনেকদিন পর সেদিন হাটখোলার দিকে যেতে হয়েছিল। মতিঝিলে ঢুকেই মনে হয়, আহা! কত পুরানো স্মৃতিময় মধুমিতা, অভিসারের সামনে দিয়ে যেতে হবে। অনেকদিন পর সিনেমা হল দুটোকে দেখতে পাবো। দেখতে পেলাম। মধুমিতাকে মনে হল প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তানের মতো। বরবাদ চলছে বলে মানুষজনের ভিড় রয়েছে কিন্তু সে ভিড়ে উৎসব মুখরতা নেই।
“গুলিস্তানের দিকে অনেকদিন যাওয়া হয় না। যেসব বন্ধুবান্ধব ওদিকে যায় টায়- তারা বলে, যাসনে ওদিকে। গুলিস্তান সিনেমা হলের দিকে তাকালে মনে হবে- ইতিহাস চুরমার, স্মৃতি ধুয়ে মুছে সাফ। বিকেলের দিকে লোক গমগম করতো হলটার সামনে। টিকেট ব্ল্যাকার গলা তুলে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতো- অ্যাই রেয়ার, অ্যাই ডিসি। প্রবেশ পথের মুখে হাউস ফুল লেখা লাল বোর্ড ঝোলানো তবু টিকেট কাউন্টারের সামনে হাল্কা ভীড় জমে থাকতে দেখেছি। যারা টিকেট পেয়ে গেছে, তারা দেখতাম- আসিতেছে, চলিতেছে লেখা বোর্ডগুলোর সামনে জড়ো হয়ে প্রদর্শনের জন্য সাজিয়ে রাখা সিনেমার স্থিরচিত্রগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখছে।”
নিজের তরুণ বয়সের কথা তুলে ধরে আফজাল বলেছেন, “আমাদের যৌবনে সিনেমা দেখাটা ছিল আনন্দ উদযাপন। অভিসার সেদিন দুঃখ দিয়েছে। মনে হল, তার যদি দুঃখ প্রকাশের ক্ষমতা থাকত- রোজ যত মানুষ তার দিকে স্মৃতিভারাক্রান্ত মন নিয়ে তাকায়, জায়গাটা শোকে, দুঃখে অঝোরে কাঁদত।
“সময়ের তোড়ে কতকিছু বদলে যেতে দেখলাম। সিনেমা হলগুলোতে ইংরেজি, উর্দু এবং বাংলা- তিনটি ভাষার সিনেমা চলত। সর্বশ্রেণিরর দর্শক সব ভাষার সিনেমা আগ্রহ নিয়েই দেখেছে। ইংরেজি কি ধরনের সিনেমা দেখান হত আফজাল সে কথাও লিখেছেন তার পোস্টে।
“ছবি হাউস ফুল, উর্দু ছবি চলা সিনেমা হলেও টিকেট নেই। আর বাংলাতে সিনেমা হয়েছে কতরকমের- সবরকমের সিনেমা দেখতে ঠ্যালাঠেলি ধাক্কাধাক্কি হতে দেখতাম। সকল রকমের সিনেমা দেখায় আগ্রহ ছিল বলেই নির্দ্বিধায় তৈরি হয়েছে সামাজিক সিনেমা, পোষাকি বা রাজনৈতিক সিনেমা। গ্রামের গল্প, শহুরে গল্প- সবরকমের সিনেমাকে উপভোগ্য মনে করা মানে দর্শকের মানসিক উচ্চতা কতখানি ছিল-বুঝে নেয়া যায়।
আলাদা মনোযোগ ছিল দর্শক
আফজালের কথায়, অতীতে দর্শকদের মধ্যে সিনেমা ঘিরে ‘আলাদা মনোযোগ ছিল’।
“দর্শকেরা তখন সিনেমার আদর্শ দর্শক ছিলেন। সিনেমার বিজ্ঞাপনে কাহিনী কার, গানের কথা কার, লেখা বা সুর করেছেন কোন সুরকার সবই জানার আগ্রহ ছিল। নায়িকাদের সাজগোজ নিয়ে আলাপ হত। সিনেমা মন্দ লাগলে মন খারাপ করতেন কিন্তু দুর্নাম করতে কোমর বেঁধে নেমে পড়তে দেখিনি। পরিচালকেরা তাই দারুণ একটা হিট ছবি বানানোর চেষ্টায় নেমে পড়তেন না। দর্শকের প্রতি সন্মান রেখে নতুন ধরণের চলচ্চিত্র উপহার দেবার চেষ্টা করতেন।“
দর্শক রুচি বোঝাতে আফজাল বলেন, “দর্শকেরা নিজের দেশের অসংখ্য তারকাদের পাশাপাশি ইংরেজি ছায়াছবির ক্যারি গ্র্যান্ট, গ্রেগরী পেক, চার্লস ব্রনসন, এলিজাবেথ টেলর, সোফিয়া লরেন, ব্রিজিট বার্দোতদেরও চিনতেন। উর্দূভাষী, ভারতীয় বাংলা এবং হিন্দী ভাষাভাষী অভিনয়শিল্পী, চলচ্চিত্র, গল্প, চরিত্র, গান ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক চর্চা হতে দেখেছি।“
আফজালের কথায়, “এসব উদাহরণ বলে দেয়, দর্শকের কাছে সিনেমা, চলচ্চিত্র খুবই আগ্রহের, ভালোবাসাপূর্ণ, বিনোদনের বিষয় ছিল। বলতে হচ্ছে ছিল, অর্থাৎ নেই এখন। একসময় দেখতে পাই, সিনেমার জন্য আগের সেই আগ্রহ, ছায়াছবির প্রভাব মানুষের মন থেকে মুছে গেছে। যা সুন্দর- তা জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া দুঃখের।“
বাইরের দেশের সঙ্গে দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির তুলনা টেনে আফজাল লিখেছেন, “সারা বিশ্বে সিনেমার রূপান্তর ঘটছে। চলচ্চিত্র দিয়ে দেশের পরিচিতি তৈরি হয়। দেশের নাম ছড়িয়ে পড়তে পারে বিশ্বব্যাপী। দেশ অন্য দেশের মানুষের কাছ থেকে সমীহ পেতে পারে- আর আমরা সিনেমা দেখা, বানানো ছেড়ে দিলাম। আমাদের ঝলমলে সিনেমাজগৎটা অন্ধকারে ডুবে গেল।”
সিনেমা আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠতে শুরু করেছে
হতাশা, আক্ষেপের পাশাপাশি দেশের সিনেমা দিয়ে আশার আলোও দেখছেন আফজাল। এবারের রোজার ঈদে ঘিরে মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলো দেখতে প্রেক্ষাগৃহের সামনে দর্শক ভিড় আশাবাদী করে তুলেছে এই অভিনেতাকে। বিষয়টি তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে হারানো রাজ্য ফিরে পাওয়ার মত একটি ঘটনা।।
তিনি লিখেছেন, “সৌভাগ্যের কথা অন্ধকার থেকে সিনেমা আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। খুব ভালো লাগছে- ঈদের পর থেকে আজ অবধি যেখানেই যাই এই সিনেমাগুলো নিয়ে চর্চা হতে দেখি। এটা হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়ার মত।“
সিনেমাকে বদলে দিতে তারকার ভূমিকা অনন্য বলে মনে করেন আফজাল। এক্ষেত্রে তিনি ঢাকাই সিনেমার সুপারস্টার শাকিব খানের নাম নিয়েছেন।
আফজাল মনে করেন দেশে আরো কয়েকজ সাহসী নির্মাতা থাকলে মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, সিয়াম আহমেদ, আফরান নিশোর মত অভিনেতারা বড় পর্দাকে বদলে দিতে পারতেন।
“তারকা সিনেমার চেহারা বদলে দিতে পারে। সিনেমাও বদলে দিতে পারে তারকাকে। শাকিব খান তার উদাহরণ। এই তারকা প্রথমে নিজের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তারপর ক্রমাগত বদলে দিচ্ছেন তার সিনেমাগুলোকে।
দেশটায় আরও কয়েকজন সাহসী পরিচালক থাকলে মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, সিয়াম, নিশোরা আমাদের চলচ্চিত্রের মহা আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারতেন। সিনেমার চেহারায় দারুণ পরিবর্তন নিশ্চয়ই আসতে পারত। “
আফজাল এবার প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে শিহাব শাহীনে পরিচালনায় এবং আফরান নিশো অভিনীত ‘দাগি’ সিনেমাটি দেখেছেন। তার কথায় ‘দাগি’ সবাইকে ‘মুগ্ধ’ করতে পেরেছে।
আফজালের কথা জানা গেল, ‘দাড়ি’ দেখতে তারা প্রেক্ষাগৃগে গিয়েছিলেন সদলবলে।
“শিহাব শাহীনকে অতি চমৎকার নির্মাতা হিসাবে জানি, তাই আগ্রহ নিয়ে দাগী দেখতে যাই। নিশোকে নিয়ে বহু মহলে আলোচনা শুনি- সেজন্যেও বন্ধুবান্ধব ঠিক করে দাগি দেখবে। একসাথে গিয়েছিলাম নয়জন। সবাইকে মুগ্ধ করতে পেরেছে দাগি। হল থেকে বেরিয়ে দলেবলে রেস্তোরাঁয় খেতে গেছি- এ পুরো সময়টা দাগি নিয়ে অসংখ্য রকমের কথা হয়েছে।
“আমার খুব ভালো লেগেছে- আবার আগের মতোই আমাদের দেশে তৈরি একটা সিনেমা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ সবাই হৈহৈ রৈরৈ আলাপ করেছি। শিহাব শাহীন মুগ্ধ করেছে তারা নির্মানের মুন্সিয়ানা দিয়ে। গল্পটা এক বৈচিত্র থেকে আর এক বৈচিত্রে দৌঁড়ায়। থামে না। দৌঁড়াতেই থাকে।”
সিনেমার কৌতুহল টিকিয়ে রাখার বিষয়টি পরিচালক শাহীন সহজেই সিনেমায় ধরে রেখেছেন বলে জানিয়েছেন আফজাল।
আফজাল এই সিনেমায় নায়কের প্রশংসা করে বলেছেন, “নিশো চমকে দেওয়ার মত সুবাতাস। এত বড় একটা চলচ্চিত্রের ভার কাঁধে নিয়ে দর্শকমনে বিশ্বস্ততা ধরে রেখে দৌঁড়ে চলা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। সিনেমার পর্দাটা অনেক বড় সেই পর্দা জুড়ে সারাক্ষণ বড় হয়ে জুড়ে যে থাকতে পারে- সে ই নায়ক।”
সিনেমার সব অভিনয়শিল্পীর প্রশংসা করে আফজাল বলেন, “সিনেমার প্রত্যেক অভিনয়শিল্পীকে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে। চরিত্রগুলোর উপস্থাপনা অসাধারণ। প্রেমকে নতুনভাবে হাজির করা হয়েছে আর দুই নায়িকার প্রেমময়তা যে কোন দর্শকের জন্য চমৎকার উপহার।”
এবারের সিনেমার ‘জোয়ার’ নিয়ে উচ্ছ্বাসের কথা প্রকাশ করেছেন আফজাল।
“আমি আমাদের কালে সিনেমা পাগল ছিলাম। বয়স বেড়েছে কিন্তু একের পর এক ভালো সিনেমা হতে থাকলে যৌবনের আনন্দ আবার ফিরে পেতে পারি- মনে হয়েছে। নতুন নতুন সিনেমা ঘর হোক, মানুষ সিনেমা দেখুক। নানারকম গল্পের চর্চায় মানুষ নিত্য নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারুক। এ চাওয়া বাড়াবাড়ি রকমের নয়।
“ঈদের আনন্দের সাথে বহুকাল পরে আবার সিনেমার আনন্দ যুক্ত হয়েছে। এ যেনো হারিয়ে পাওয়া। মানুষ কথা বলছে বরবাদ, চক্কর, জংলি, দাগি নিয়ে। সিনেমা তো এক ধরণের স্বপ্ন রচনা। স্বপ্ন বড় হতে থাকলে মানুষও বড় হবে।”