ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, আলোচনা চলছে তবে ব্যাংক ঠিক হয়নি।
Published : 10 Apr 2024, 01:00 AM
ঋণ জালিয়াতি ও নানা অনিয়মে ধুঁকতে থাকা প্রথম প্রজন্মের ন্যাশনাল ব্যাংকের অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের আলোচনা শুরু হয়েছে প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পেরিয়ে আসার পর।
পুরোপুরি দেশি উদ্যোক্তাদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম ব্যাংক এনবিএলকে একই বছর ১৯৮৩ সালে ব্যবসা শুরু করা আরেক ব্যাংক ইউসিবির সঙ্গে একীভূত করতে মধ্যস্ততা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক বলে খবরে এসেছে।
মঙ্গলবার এ দুটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতনদের নিয়ে একীভূতকরণের বিষয়ে বৈঠক করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
এ বিষয়ক এক প্রশ্নে ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আলোচনা করছে ব্যাংকগুলো। বিচার-বিশ্লেষণ করছে তারা। এখনও চূড়ান্ত কিছুই হয়নি। চূড়ান্ত হলে বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে।’’
প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর অন্যতম ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের (এনবিএল) বর্তমান চেয়ারম্যান সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সবল কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত (মার্জার) হতে আলোচনা শুরু হয়েছে। কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চললেও এখন পর্যন্ত তা চূড়ান্ত হয়নি।
ব্যাংক একীভূতকরণের বিষয়টি সামনে আসার পর এক্সিম ব্যাংকে পদ্মা, সোনালীতে বিডিবিএল এবং সিটি ব্যাংকে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের এক হওয়ার উদ্যোগের মধ্যে এনবিএল ও ইউসিবির মার্জারের বিষয়টি খবরে এল।
বেসিক ও সিটি ব্যাংক ছাড়া অন্য ব্যাংকগুলোর একীভূত হওয়ার বিষয়ে নিজ নিজ পর্ষদ সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হলেও অপেক্ষায় আছে সোনালী ও বিডিবিএল।
এমন প্রেক্ষাপটে বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া প্রথম বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের মালিকানাধীন ন্যাশনাল ব্যাংকের বর্তমান দুরবস্থার কারণে আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে এক করার বিষয়ে আলোচনা করছেন গভর্নর।
মঙ্গলবার এনবিএলের চেয়ারম্যান ও সিইও এর পাশাপাশি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চেয়ারম্যান ও সিইওদের নিয়ে একসঙ্গে বৈঠক করেন তিনি; যাতে ছিলেন দুই ব্যাংকের কয়েকজন পরিচালকও।
ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফারহাত আনোয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আমাদের পর্ষদে আলোচনা হয়েছে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ হতে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রস্তাব দিয়েছি। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিক করে দেবে কোন ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ হতে পারি।’’
২০০৯ সালে এনবিএলের পরিচালনা পর্ষদে সিকদার গ্রুপের একক নিয়ন্ত্রণ আসার দীর্ঘদিন পর ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এ পরিবারের বাইরের কেউ এনবিএলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে আসেন। দীর্ঘদিনের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের ২০২১ সালে মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিবাদে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় সৈয়দ ফারহাত আনোয়ারকে। এর আগে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে পর্ষদে যুক্ত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সাবেক এই অধ্যাপককে।
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে আলোচনা শুরুর পর অনিয়মে ধুঁকতে থাকা এনবিএলের পর্ষদের গত মার্চের বৈঠকে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে এক হওয়ার বিষয়টি উপস্থাপন করেন নতুন চেয়ারম্যান। ওই সভায় এ নিয়ে পরিচালকরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিচালক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুটি মতের পক্ষেই জোরালো অবস্থান থাকায় চেয়ারম্যান সময় নিয়েছিলেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে। বিরোধিতাকারী সদস্যরাও আরও সময় চেয়েছেন বিষয়টি বুঝতে। চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেছিলেন, আরও সময় নিয়ে আলোচনা করতে।
দ্বিধা-বিভক্ত পর্ষদের এমন মতামতের মধ্যেই বেসরকারি ইউসিবি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়া নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈঠক হল।
১৯৮৩ সালে ১৮ উদ্যোক্তা পরিচালক শুরু করেন ন্যাশনাল ব্যাংক, যাদের মধ্যে ছিলেন একেএম আবু তাহের, আবু তাহের মিয়া, জয়নুল হক সিকদার, খলিলুর রহমান ও মোয়াজ্জেম হোসেন।
এরপর ২০০৯ সালে পরিচালনা পর্ষদে ব্যাপক বদলের মাধ্যমে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের কাছে। এরপর একে একে অন্য পরিবারের পরিচালকরা পর্ষদ থেকে বাদ পড়েন। জয়নুল হক সিকদারের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েরা পর্ষদে আসেন।
এক যুগের বেশি সময় ধরে চেয়ারম্যান পদে থাকা অবস্থায় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মারা যান জয়নুল হক সিকদার। তার পর তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন গত ডিসেম্বর পর্যন্ত।
এক বছর পর ২০২২ সালের অগাস্টে পর্ষদ থেকে সরে যেতে হয় উদ্যোক্তা পরিচালক ও হোসাফ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন। একই পরিবারের মাবরুর হোসেনও বাদ পড়েন। এর মাধ্যমে ব্যাংকটিতে সিকদার পরিবারের কর্তৃত্ব আরও নিরঙ্কুশ হয়। এ পরিবারের বাইরে পরিচালক হিসেবে তখন ছিলেন উদ্যোক্তা পরচিালকদের মধ্যে কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যাংকটির পরিচালক ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন।
বাবার মৃত্যুর পর ব্যাংক ও পারিবারিক ব্যবসার উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন রন হক সিকদার, রিক হক সিকদার ও কন্যা পারভীন হক সিকদার। সন্তানদের বিবাদ সামাল দিতে অনেকটা ব্যর্থ হন মনোয়ারা হক সিকদার। পারিবারিক দ্বন্দের প্রভাব পড়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের উপরও। পরিচালক পর্ষদে সিকদার পরিবারের চার পরিচালক থাকায় বিবাদ স্পষ্ট হয়ে উঠে।
এরমধ্যে ঋণ নিয়ে অনিয়ম এবং সিকদার পরিবারের সদস্য পরিচালকদের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে প্রায় দেড়শত কোটি টাকার অর্থপাচার ও ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ হয়।
ব্যাংকটির দুরবস্থা আরও বাড়তে থাকার মধ্যে নিয়ম ও বিধি ভাঙাসহ বিভিন্ন কারণ তুলে ধরে গত ডিসেম্বরে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে সাজানো হয় নতুন পর্ষদ। দীর্ঘদিন পর সিকদার পরিবারের বাইরে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার।
নতুন পর্ষদে জায়গা পায়নি সিকদার গ্রুপের তিন পরিচালক। পুরনো পর্ষদের মধ্যে থেকে তিনজনকে রাখা হয়েছে, যাদের মধ্যে সিকদার পরিবারের এক সদস্য রয়েছেন। একই সঙ্গে পরিচালক হিসেবে ফিরিয়ে আনা হয় হোসাফ গ্রুপের মোয়াজ্জেম হোসেনকে।
একীভূতকরণের বিষয়ে ফারহাত আনোয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আমরা একাধিক ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলছি, আলোচনা চলছে কিন্তু ব্যাংক ঠিক হয়নি। যার সঙ্গে গেলে বনিবনা ভালো হবে-তার সঙ্গেই যাব। কোনো কিছুই এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আমরা শুধু প্রক্রিয়াটা শুরু করেছি। এখনও অনেক আলোচনা বাকি।’’
এনবিএলের মতো ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউসিবি এখন আর্থিক সূচকে অনেকটা ভালো অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের আলোচনার বিষয়ে জানতে ইউসিবির চেয়ারম্যান রুকমিলা জামান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ কাদরির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাদের বক্তব্য জানা যায়নি। মোবাইল ফোন ও ক্ষুদে বার্তা দেওয়ার পরও তারা সাড়া দেননি।
তিন হাজার ২১৯ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনের ন্যাশনাল ব্যাংকটরি সারাদেশে শাখা-উপশাখা রয়েছে ২৮১টি, যার মধ্যে শাখা ২২১টি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ৪২ হাজার ২৬০ কোটি টাকার মধ্যে খেলাপি ১৩ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা; এ হার ৩১ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
এক হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের ইউসিবির শাখা-উপশাখা ২২৮টি। মোট বিতরণ করা ৪৮ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকার মধ্যে খেলাপি তিন হাজার ৩২৫ কোটি টাকা; ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
সরকারি সুবিধা আসায় বেসিক নিতে চায় সিটি ব্যাংক