দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংক একীভূত হচ্ছে এক্সিমে

আগামী সোমবার এ বিষয়ে দুই ব্যাংকের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 March 2024, 10:23 AM
Updated : 14 March 2024, 10:23 AM

আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংক একীভূত হচ্ছে শরিয়ার ভিত্তিতে পারিচালিত এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে।

বৃহস্পতিবার এক্সিম ব্যাংকের পর্ষদ সভায় পদ্মা ব্যাংককে অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়।

এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের পর্ষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে একীভূত করার। আগামী সোমবার এ বিষয়ে পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে।”

গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে ওই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। কীভাবে এই একীভূতকরণ সম্পন্ন হবে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা মেনে দুই ব্যাংকের আইনজীবীরা ঠিক করবেন।

পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে এক্সিম ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেন বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকে যান।

সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আলোচনা চলছে। আজকে এ বিষয়ে মিটিং হবে। আশা করছি মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। একীভূত হয়ে যাবে। মিটিংয়ের পরেই আপনারা জানতে পারবেন।”

এ বিষয়ে পদ্মা ব্যাংকের কারো বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

একীভূত বা মার্জার হচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা। অর্থাৎ, দুটি কোম্পানি মিলে একটিতে পরিণত হওয়া। সাধারণত সমজাতীয় দুই কোম্পানি ব্যবসায়িক স্বার্থকে সামনে রেখে একীভূত হয়।

খেলাপি ঋণ এবং নানা কেলেঙ্কারিতে বছরের পর বছর ধরে দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এক ডজনের বেশি ব্যাংক। এসব ব্যাংক এখন দেশের পুরো ব্যাংক খাতের জন্য সমস্যা হয়ে ওঠায় একীভূতকরণ বা মার্জারের বিষয়টি আর্থিক খাতের সংস্কারের আলোচনায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক সমস্যাগ্রস্ত এসব ব্যাংককে অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত (মার্জার) করতে চাইছে। সেজন্য একটি রোডম্যাপ ঠিক করার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে এক বছর সময় দিয়ে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন’ বা পিসিএ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

এ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার, মূলধনের পর্যাপ্ততা, নগদ অর্থের প্রবাহ, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের তথ্যকে প্রাধান্য দিয়ে আর্থিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সূচক ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।

সেই সূচকে কাঙ্ক্ষিত মানদণ্ডের নিচে থাকা ব্যাংকগুলোকে ‘দুর্বল’ শ্রেণিভুক্ত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শুরুতে ১০টি ব্যাংককে এ তালিকায় আনা হয়েছে। দুর্বল ব্যাংক টেনে তোলার শেষ পদক্ষেপ হিসেবে অন্য ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার বিষয়টি থাকছে, যাতে সরকারও সায় দিয়েছে।

ডুবতে থাকা ফারমার্স ব্যাংক মালিকানা এবং পরে নাম বদলে পদ্মা ব্যাংক হয় পাঁচ বছর আগে। এবার সেই পদ্মা ব্যাংক যে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে যাচ্ছে, সে কথা গত ফেব্রুয়ারি মাসেই জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেছিলেন, “বিভিন্ন ব্যাংক, আসলে যেগুলো হয়ত ভালোভাবে চালাতে পারছে না। ইতোমধ্যে একটি ব্যাংক একীভূত করে দিয়েছি। পদ্মা ব্যাংক করা হয়েছে। ঠিক এভাবে আমরা নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমরা কিন্তু বসে নেই, কাজ করে যাচ্ছি।”

মার্জার নিয়ে আলোচনার মধ্যে গত ৩১ জানুয়ারি পদ্মা ব্যাংক থেকে সরে যেতে হয় ছয় বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা চৌধুরী নাফিজ সরাফাতকে, যিনি রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট পিএলসি এবং কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডেরও চেয়ারম্যান। সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিমকে দেওয়া হয় পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব।

বাংলাদেশ ব্যাংক সে সময় জানিয়েছিল ব্যাংক একীভূতকরণের আগে গাইডলাইন প্রকাশ করা হবে। তবে তা এখনো প্রকাশ করা হয়নি।

কোন প্রক্রিয়ায় পদ্মা ও এক্সিম ব্যাংক একীভূত হবে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া আছে ব্যাংকগুলোর নিজেরা নিজেরা মার্জারে যাওয়ার জন্য। তারা যদি একীভূত হতে সম্মত হয়, সিদ্ধান্ত নিয়ে আসে, তাহলে আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করব। "

একীভূত হওয়ার পর নাম কী হবে সে সিদ্ধান্ত ব্যাংকগুলো নেবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

প্রথমে নাম বদল, এবার বিলীন

দেশে এক্সিম ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। পরে এ ব্যাংক শরিয়াহ ধারার ব্যাংকিং চালু করে। ২০০৪ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় এক্সিম ব্যাংক।

আর পদ্মা ব্যাংকের সূচনা হয়েছিল ফারমার্স ব্যাংক নামে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৩ সালে একসঙ্গে যে নয়টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়, তার মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক একটি।

যাত্রার তিন বছর পার করেই ধুঁকতে শুরু করে ব্যাংকটি। অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে তারল্য সংকটে ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে ২০১৭ সালে। সে সময় চাপের মুখে চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর।

পরের বছর ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়া চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে করেন পদ্মা ব্যাংক।

তখন পদ্মা ব্যাংককে উদ্ধার করতে সরকারের উদ্যোগে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এর মাধ্যমে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন জোগান দেওয়া হয়, যা ওই সময়ে ব্যাংকটির মোট মূলধনের ৬৬ শতাংশ।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের একটি ধারা থেকে অব্যাহতি দিয়ে মূলধন জোগান দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের পদাধিকার বলে পদ্মা ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তখন থেকেই পাঁচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা পদ্মা ব্যাংকের পরিচালক হিসেব দায়িত্ব পালন করছেন।

২০১৯ সালে ফারমার্স ব্যাংক থেকে পদ্মা ব্যাংক হওয়ার সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৭০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের শেষে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণই ৩ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৬৪ শতাংশ।

গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির আমানত দাঁড়ায় ছয় হাজার ১৪১ কোটি টাকা। এই আমানতের মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) আমানত মোট এক হাজার কোটি টাকা। আর সরকারের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড ও জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের ৭৬০ কোটি টাকা মিলিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত দুই হাজার ৮৫০ কোটি টাকা।

ব্যাংক পুনর্গঠনের সময় আমানত দিয়ে এখন বিপাকে পড়েছে সরকারি এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। বিনিয়োগের বিপরীতে এক টাকাও মুনাফা পায়নি তারা।

এ অবস্থায় পদ্মা ব্যাংকের মালিকানায় আবার পরিবর্তন আসছে; ব্যাংকটি একীভূত হচ্ছে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে।

ব্যাংক মার্জার: ইতিহাস কী বলে

সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই ব্যাংক মার্জারের নজির রয়েছে দেশে। সর্বপ্রথম ব্যাংক একীভূত করার ঘটনা দেখা যায় ১৯৭২ সালে। আর সর্বশেষ ২০০৯ সালে।

স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক (জাতীয়করণ) অধ্যাদেশ, ১৯৭২’-এর ক্ষমতাবলে পূর্ব পাকিস্তানে কার্যরত থাকা মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক, অস্ট্রেলেশিয়া ব্যাংক এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক একীভূত করে নাম দেওয়া হয় রূপালী ব্যাংক। তিন ব্যাংকের সকল দায় ও সম্পদ এক করে তৈরি হয় আজকের রূপালী ব্যাংক।

সে সময় রূপালী ব্যাংক ছিল শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানার প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৬ সালে এর ৫১ শতাংশ শেয়ার সরকারের কাছে রেখে অবশিষ্ট শেয়ার বাজারে ছেড়ে ব্যাংকটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে ব্যাংকটির ৯০ শতাংশের বেশি শেয়ার ফের সরকারের মালিকানায় রয়েছে।

১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে শিল্প খাতের বিকাশে ‘বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক’ ও ‘বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা’ নামে দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ২০০৯ সালের নভেম্বরে প্রতিষ্ঠান দুটিকে একীভূত করে সরকার। নতুন নাম হয় বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড।

সাবেক হাবিব ব্যাংক লিমিটেড ও সাবেক কমার্স ব্যাংক লিমিটেড এর বাংলাদেশে থাকা সব সম্পদ ও দায় সমন্বয় করে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে গঠন করা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক।

আর একই আদেশে ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড ও ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড মিলিয়ে একই বছরে গড়া হয় জনতা ব্যাংক।

সোনালী ব্যাংক গঠন করা হয় তিনটি ব্যাংক নিয়ে। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ব্যাংক অব বাহওয়ালপুর এবং প্রিমিয়ার ব্যাংক নিয়ে সোনালী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয় একই বছরে।

সুদমুক্ত শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে ১৯৮৭ সালের ২০ মে আল-বারাকা ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড কার্যক্রম শুরু। ২০০৪ সালে মালিকানা পরিবর্তনে এ ব্যাংকের নাম দেওয়া হয় ওরিয়েন্টাল ব্যাংক।

৬৫০ কোটি টাকার আর্থিক জালিয়াতির কারণে ২০০৬ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক অধিগ্রহণ করে প্রশাসক বসায় বাংলাদেশ ব্যাংক। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়ায় ব্যাংকটির ৫২ দশমিক ৬৭ শতাংশ শেয়ার উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক মালয়েশিয়ার মালিকানাধীন আইসিবি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপ হোল্ডিংস এজির কাছে বিক্রি করা হয়।

২০০৮ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক এর নাম পরিবর্তন করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড রাখা হয়।

পুরনো খবর:

Also Read: ব্যাংক একীভূতকরণ কতদূর?

Also Read: পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ ‘ছাড়লেন’ নাফিজ সরাফাত