“ব্যাংক মার্জার হলে সাময়িক সময়ের জন্য একটি সমস্যার সমাধান করা যাবে। কিন্তু কী কারণে ব্যাংকটি দুর্বল হল, তার কারণ এবং দায়ীদের চিহ্নিত করা না হলে সমস্যা আবার তৈরি হবে,” বলেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ।
Published : 13 Feb 2024, 12:24 AM
আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে জানিয়ে দিলেও সেই প্রক্রিয়া শেষ হতে আরো সময় লাগবে।
কেবল পদ্মা ব্যাংক নয়, খেলাপি ঋণ এবং নানা কেলেঙ্কারিতে বছরের পর বছর ধরে দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এক ডজনের বেশি ব্যাংক। এসব ব্যাংক এখন দেশের পুরো ব্যাংক খাতের জন্য সমস্যা হয়ে ওঠায় একীভূতকরণ বা মার্জারের বিষয়টি আর্থিক খাতের সংস্কারের আলোচনায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক সমস্যাগ্রস্ত এসব ব্যাংককে অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত (মার্জার) করতে চাইছে। সেজন্য একটি রোডম্যাপ ঠিক করার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে এক বছর সময় দিয়ে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন’ বা পিসিএ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
এ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার, মূলধনের পর্যাপ্ততা, নগদ অর্থের প্রবাহ, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের তথ্যকে প্রাধান্য দিয়ে আর্থিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সূচক ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।
সেই সূচকে কাঙ্ক্ষিত মানদণ্ডের নিচে থাকা ব্যাংকগুলোকে ‘দুর্বল’ শ্রেণিভুক্ত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংক টেনে তোলার শেষ পদক্ষেপ হিসেবে অন্য ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার বিষয়টি আসবে। সরকারও তাতে সায় দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বুধবার জাতীয় সংসদে বলেন, “বিভিন্ন ব্যাংক, আসলে যেগুলো হয়ত ভালোভাবে চালাতে পারছে না। ইতোমধ্যে একটি ব্যাংক একীভূত করে দিয়েছি। পদ্মা ব্যাংক করা হয়েছে। ঠিক এভাবে আমরা নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমরা কিন্তু বসে নেই, কাজ করে যাচ্ছি।”
এ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যাংক মার্জারের অপশন আইনে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে রোডম্যাপ ঠিক করেছে, সেখানেও বলা আছে দুর্বল ব্যাংক মার্জারের কথা। এজন্য একটি পিসিএ করা হয়েছে। তার মানদণ্ড অনুযায়ী দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করে মার্জারের প্রক্রিয়া শুরু হবে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, পদ্মা (সাবেক ফারমার্স) ব্যাংক একীভূত হতে পারে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে। তবে এটা এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। এর বিকল্পও ভাবতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিমকে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক কোম্পানি আইনের একটি ধারাকে বিশেষ ক্ষমতায় অব্যাহতি দিয়ে আগ থেকেই সোনালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক এবং এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের পদ্মা ব্যাংকে পরিচালক হওয়ার সুযোগ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দেশে ব্যাংকের সংখ্যা অর্থনীতির আকারের চেয়ে বেশি হয়ে গেছে- অর্থনীতিবিদদের এমন দাবি অনেক দিনের। এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থাও মনে করছে, এ সংখ্যা কমানোর দরকার।
তবে বিদ্যমান ৬১ ব্যাংক কমিয়ে কতটি রাখা হবে, সেরকম কোনো সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের ব্যাংক, যাদের ঋণ ও আমানতের অঙ্ক ১০ হাজার কোটি টাকার আশপাশে, তাদের দিকেই প্রথম ধাপে নজর দেওয়ার কথা জানাচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিরা।
যা হচ্ছে পদ্মা ব্যাংকে
চতুর্থ দফায় ক্ষমতা নেওয়া আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল আর্থিক খাতের সংস্কার। সরকার গঠন করে আর্থিক খাতের নেতৃত্বে পরিবর্তন এনে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের পথে হাঁটার ইঙ্গিতই দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণেও আর্থিক খাতের সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির শর্ত মেনে গত বছর থেকেই আর্থিক খাতে নানামুখী সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর অংশ হিসেবে গত ডিসেম্বরে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বিশেষ নজরদারিতে আনার উদ্যোগ আসে। শুরুতে ১০টি ব্যাংককে এ তালিকায় আনা হয়। ওই সময়ই ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ)’ নামে একটি কাঠামো তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন সূচকের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে, এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের শাস্তির পাশাপাশি মার্জারও করা হতে পারে।
কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকের ২০২৪ সালের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন দেখে পিসিএ বাস্তবায়ন করা হবে। হিসাব বছর শেষ হওয়ার দুই মাসের মধ্যে আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে।
সে হিসাবে দুর্বল ব্যাংকের তালিকা পাওয়া যাবে আগামী বছরের মার্চে। অন্যদিকে খেলাপি ঋণের হার কামিয়ে আনতে ১৭ দফার যে রোডম্যাপ বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা করেছে; সেখানেও কর্পোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে কয়েকটি দুর্বল ব্যাংককে অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় থাকা ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত এসেছে।
এমন পরিকল্পনার মধ্যে গত ৩১ জানুয়ারি দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংক থেকে সরে যেতে হয় ছয় বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা চৌধুরী নাফিজ সরাফাতকে, যিনি রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট পিএলসি এবং কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডেরও চেয়ারম্যান।
খেলাপি ঋণ কত
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকারে আসার পর প্রথম মেয়াদের শুরু থেকেই নতুন ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। ২০১৩ সালে একসঙ্গে নয়টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়, যার মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক অন্যতম।
যাত্রার তিন বছর পার করেই ধুঁকতে শুরু করে ব্যাংকটি। একসঙ্গে অনুমোদন পাওয়া বাকি ৮ ব্যাংক এত দুর্দশায় পড়েনি।
অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে তারল্য সংকটে ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে ২০১৭ সালে। সে সময় চাপের মুখে চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
পরের বছর ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়া চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে করেন পদ্মা ব্যাংক।
তখন পদ্মা ব্যাংককে উদ্ধার করতে সরকারের উদ্যোগে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এর মাধ্যমে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন জোগান দেওয়া হয়, যা ওই সময়ে ব্যাংকটির মোট মূলধনের ৬৬ শতাংশ।
ব্যাংক কোম্পানি আইনের একটি ধারা থেকে অব্যাহতি দিয়ে মূলধন জোগান দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের পদাধিকার বলে পদ্মা ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তখন থেকেই পাঁচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা পদ্মা ব্যাংকের পরিচালক হিসেব দায়িত্ব পালন করছেন।
২০১৯ সালে ফারমার্স ব্যাংক থেকে পদ্মা ব্যাংক হওয়ার সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৭০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের শেষে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণই ৩ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৬৪ শতাংশ।
গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির আমানত দাঁড়ায় ছয় হাজার ১৪১ কোটি টাকা। এই আমানতের মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) আমানত মোট এক হাজার কোটি টাকা। আর সরকারের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড ও জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের ৭৬০ কোটি টাকা মিলিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত দুই হাজার ৮৫০ কোটি টাকা।
ব্যাংক পুনর্গঠনের সময় আমানত দিয়ে এখন বিপাকে পড়েছে সরকারি এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। বিনিয়োগের বিপরীতে এক টাকাও মুনাফা পায়নি তারা।
মার্জার কি?
একীভূত বা মার্জার হচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা। অর্থাৎ, দুটি কোম্পানি মিলে একটিতে পরিণত হওয়া। সাধারণত সমজাতীয় দুই কোম্পানি বড় কোনো ব্যবসায়িক স্বার্থকে সামনে রেখে একীভূত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও বীমা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এতে সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। প্রতিযোগীদের তুলনায় এগিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য সামনে রেখেই মূলত তা হয়ে থাকে। যেখানে একটি প্রতিষ্ঠান আরেকটির সব ধরনের সম্পদকে ব্যবহার করার সুযোগ পায়।”
কিন্তু ব্যাংক খাতে সেই সুযোগ ‘এখন আর নেই’ বলে মনে করেন তিনি।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাব্কে লিড ইকোনোমিস্ট জাহিদ হোসেন বলেন, প্রয়োজনে দুর্বল বা সমস্যাগ্রস্ত কোনো কোম্পানিকে অধিগ্রহণ করেও মার্জার হতে পারে।
“দুর্বল ব্যাংক দুর্বলের সঙ্গে একীভূত করলে তো কোনো লাভ হবে না। মাইনাসের সঙ্গে মাইনাস যোগ করলে তা মাইনসই থাকবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে মার্জারের উদ্দেশ্য হল বড় কোনো প্রতিষ্ঠান সমজাতীয় ছোট বা দুর্বল কোনো প্রতিষ্ঠানকে অধিগ্রহণ করবে। এতে ছোট প্রতিষ্ঠানের বাজার ও সম্পদকে ব্যবহার করে নিজের ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারবে বড় বা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানটি।”
ব্যাংক মার্জার কোন পদ্ধতিতে?
জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংক মার্জারের উদ্দেশ্য হল সবল ব্যাংকের সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দুর্বলকে শক্তিশালী করা। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক সেটা কোন পদ্ধতিতে করে, সেটাই দেখার বিষয়।
“যদি নিয়ম মেনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে- এমন একটি মডিউল তৈরি করে, তাহলে বোঝা যাবে, যে উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে, তা অর্জিত হবে কি-না।”
ওই মডিউল প্রসঙ্গ তিনি বলেন, “দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করতে একটি পিসিএ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেটার মূল্যায়ন প্রতিবেদন এলে ব্যাংকগুলো সম্পর্কে অন্যরা ধারণা পাবে। তখন দেখা যাবে কোনো ব্যাংক স্বেচ্ছায় এই মার্জারে আসতে চায় কি না। অর্থাৎ দুর্বল ব্যাংককে অধিগ্রহণের কোনো আগ্রহ কারো আছে কি না।
“এখানে তো সবল ব্যাংক তার বাণিজ্যিক স্বার্থই দেখবে। কারণ তারা তো দুর্বল ব্যাংকের উপর বিনিয়োগ করবে। এই বিনিয়োগটি তারা কেন করবে? যদি বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়, তাহলে তো সাময়িকভাবে ভালো হলেও দীর্ঘ মেয়াদে কারো পরিণতিই ভালো হবে না।’’
কী পাবে ভালো ব্যাংক?
অধিগ্রহণ করলে দুর্বল ব্যাংকের গ্রাহক, আমানতকারীর বাজারটি পাবে সবল ব্যাংক। তেমনি দুর্বল ব্যাংকের জনবল, খেলাপি ঋণ, বেনামি ঋণের দায়ও নিতে হবে সবল ব্যাংককে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুর্বল ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটটা যোগ হবে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে। এতে ভালো ব্যাংকটির খেলাপির পরিমাণ বেড়ে যাবে, প্রভিশন রাখতে গিয়ে মুনাফা কমবে প্রথম দিকে। আর আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার চাপটি তো বাড়বে।’’
এসব সামলে নিতে পারলেই সবল ব্যাংকটি লাভবান হতে পারবে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান।
জনবল ও কেলেঙ্কারির কী হবে?
একীভূত হলেও দুর্বল ব্যাংকের কোনো জনবল তিন বছরের আগে ছাঁটাই বা বাতিল করা যাবে না– এমন শর্ত রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৭ দফা ‘রোডম্যাপে’। ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যে এই ‘রোডম্যাপ’ বাস্তবায়িত হওয়ার কথা।
জাহিদ হোসেন বলেন, “দুর্বল ব্যাংক অধিগ্রহণের আগে সবল ব্যাংক অবশ্যই এসব বিবেচনায় নেবে। কারণ, ব্যাংকটি দুর্বল হওয়ার জন্য তো বর্তমান কর্মকর্তা, পরিচালক ও ব্যবস্থাপনায় থাকাদের দায় রয়েছে।”
তিনি বলেন, “এখন যাদের কারণে ব্যাংক সমস্যায় পড়েছে, তাদের কেন তিন বছর ব্যাংকে রাখতে হবে? এটা তো কোনো ভালো ব্যাংক মেনে নেবে না। কারণ তারা তো ব্যাংকটিকে ভালো করতে নিজেদের মত করে সবকিছু সাজাতে চাইবে।’’
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “দুর্বল ব্যাংকের সব শাখা হয়ত রাখা হবে না। যে সব এলাকায় দুর্বল ব্যাংকের মত সবল ব্যাংকেরও শাখা আছে, তারা তো এক করে দেবে। একটি শাখা চালাতে প্রয়োজনীয় জনবলতো তার আগ থেকেই আছে। তাহলে অতিরিক্ত জনবল কি করবে?”
জাহিদ হোসেনের মতে, তিন বছরের ওই শর্ত হবে ‘হাত-পা বেঁধে দিয়ে সাঁতার কাটতে বলার মত’ অবস্থা।
“এজন্য দুর্বল ব্যাংক মার্জারের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে ইওআই (এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট) বা আগ্রহপত্র চাওয়া। এতে ব্যাংকগুলো নিজেদের সক্ষমতা ও ইচ্ছা অনুযায়ী প্রস্তাব দিতে পারবে।’’
দুর্বল ব্যাংক মার্জার করতে সবল ব্যাংকেরও আগ্রহ থাকা জরুরি মনে করেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, “এজন্য সবল ব্যাংকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে হবে। বাজার অর্থনীতি অনুসারে চাপিয়ে দিলে তো উদ্দেশ্যটা পূরণ হবে না।”
তিন বছরের আগে ছাঁটাই না করার শর্ত নিয়ে যে প্রশ্ন, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র ও পরিচালক সরোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ব্যাংক একীভূত করার সময়ে কর্মচারীদের গণহারে ছাঁটাই করা বা ম্যালপ্র্যাকটিস যাতে না হয় সেজন্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক সুরক্ষা দিতে রোডম্যাপে এমন সিদ্ধান্ত রেখেছে। এরপরও কারো অন্যায় পেলে তো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকবে।"
মার্জারেই মুশকিল আসান?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আরো অনেক বিষয় বিবেচনায় নেওয়া দরকার বলে মনে করেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ। তার যুক্তি, কোনো ব্যাংক একদিনে দুর্বল হয়নি।
“নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক সময়মত ব্যবস্থা নেয়নি। কোনো একটি ব্যাংকে একটি সমস্যা দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ছিল আরো কোনো ব্যাংক এই সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেই দায়িত্বটুকু পালন করেনি।
“এখন সমস্যা দেখা দেওয়ার পরে সমাধান করতে উদ্যোগী হচ্ছে। আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সেই সক্ষমতায় যেতে হবে; যেখানে ব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।’’
তিনি বলেন, ব্যাংক মার্জার হলে সাময়িক সময়ের জন্য একটি সমস্যার সমাধান করা যাবে। কিন্তু কী কারণে ব্যাংকটি দুর্বল হল, তার কারণ এবং দায়ীদের চিহ্নিত করা না হলে সমস্যা আবার তৈরি হবে।
তবে দেশে ব্যাংকের সংখ্যা ৬১ থেকে কমে যদি ৪০টিতেও নামে, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি করা এখনকার চেয়ে সহজ হবে বলে মনে করেন আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ।
একই ধরনের মত প্রকাশ করে জাহিদ হোসেন বলেন, “যারা দায়ী, তাদের দায় তো আগে চিহ্নিত করতে হবে। নইলে তো বোঝা যাবে না কি কারণে ব্যাংকটি দুর্বল হল। এটি যদি না হয়, তাহলে সমস্যা তো ফের দেখা দেবে। সবল ব্যাংকই বা তখন কীভাবে পুঞ্জীভূত সমস্যার সমাধান করবে? অনেকটা এ রকম যে রোগের ধরণ জানা গেল না, কিন্তু চিকিৎসককে বলা হচ্ছে চিকিৎসা করতে। এজন্য প্রয়োজন দুর্বল ব্যাংকটির সঠিক নিরীক্ষা।”
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, মার্জারের সঙ্গে আরো অনেক পদক্ষেপ নিতে হবে ব্যাংকিং খাতের সমস্যা দূর করতে। কারণ, এর জন্য ‘পরিচালকরাও দায়ী’।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এখনো মার্জারের সিদ্ধান্ত হয়নি। আইনি কাঠামো অনুযায়ী যখন বাস্তবায়নের দিকে যাব, তখন মার্জর গাইডলাইন করা হবে, সেখানে এসব বিষয় অ্যাডজাস্ট (সমন্বয়) করা হবে। গাইডলাইনে বিস্তারিত ব্যাখ্যা থাকবে।"
ব্যাংক মার্জার: ইতিহাস কী বলে
সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই ব্যাংক মার্জারের নজির রয়েছে দেশে। সর্বপ্রথম ব্যাংক একীভূত করার ঘটনা দেখা যায় ১৯৭২ সালে। আর সর্বশেষ ২০০৯ সালে।
স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক (জাতীয়করণ) অধ্যাদেশ, ১৯৭২’-এর ক্ষমতাবলে পূর্ব পাকিস্তানে কার্যরত থাকা মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক, অস্ট্রেলেশিয়া ব্যাংক এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক একীভূত করে নাম দেওয়া হয় রূপালী ব্যাংক। তিন ব্যাংকের সকল দায় ও সম্পদ এক করে তৈরি হয় আজকের রূপালী ব্যাংক।
সে সময় রূপালী ব্যাংক ছিল শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানার প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৬ সালে এর ৫১ শতাংশ শেয়ার সরকারের কাছে রেখে অবশিষ্ট শেয়ার বাজারে ছেড়ে ব্যাংকটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে ব্যাংকটির ৯০ শতাংশের বেশি শেয়ার ফের সরকারের মালিকানায় রয়েছে।
১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে শিল্প খাতের বিকাশে ‘বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক’ ও ‘বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা’ নামে দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ২০০৯ সালের নভেম্বরে প্রতিষ্ঠান দুটিকে একীভূত করে সরকার। নতুন নাম হয় বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড।
সাবেক হাবিব ব্যাংক লিমিটেড ও সাবেক কমার্স ব্যাংক লিমিটেড এর বাংলাদেশে থাকা সব সম্পদ ও দায় সমন্বয় করে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে গঠন করা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক।
আর একই আদেশে ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড ও ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড মিলিয়ে একই বছরে গড়া হয় জনতা ব্যাংক।
সোনালী ব্যাংক গঠন করা হয় তিনটি ব্যাংক নিয়ে। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ব্যাংক অব বাহওয়ালপুর এবং প্রিমিয়ার ব্যাংক নিয়ে সোনালী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয় একই বছরে।
সুদমুক্ত শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে ১৯৮৭ সালের ২০ মে আল-বারাকা ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড কার্যক্রম শুরু। ২০০৪ সালে মালিকানা পরিবর্তনে এ ব্যাংকের নাম দেওয়া হয় ওরিয়েন্টাল ব্যাংক।
৬৫০ কোটি টাকার আর্থিক জালিয়াতির কারণে ২০০৬ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক অধিগ্রহণ করে প্রশাসক বসায় বাংলাদেশ ব্যাংক। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়ায় ব্যাংকটির ৫২ দশমিক ৬৭ শতাংশ শেয়ার উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক মালয়েশিয়ার মালিকানাধীন আইসিবি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপ হোল্ডিংস এজির কাছে বিক্রি করা হয়।
২০০৮ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক এর নাম পরিবর্তন করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড রাখা হয়।