নতুন কেউ দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
Published : 31 Jan 2024, 05:44 PM
অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডোবা ফারমার্স ব্যাংক ‘পদ্মা’ নামে যাত্রা শুরুর পাঁচ বছর পর পদত্যাগ করলেন এর চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।
পুনর্গঠনের সময় পদ্মা ব্যাংকের নেওয়া সরকারি সংস্থার আমানত ফিরিয়ে দিতে না পেরে সেগুলোকে শেয়ারে রূপান্তরের প্রস্তাব নিয়ে নতুন করে আলোচনার মধ্যেই ‘স্বাস্থ্যগত’ কারণ দেখিয়ে তিনি সরে গেলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বুধবার নাফিজ সরাফাতের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছে পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।”
তবে ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়নি জানিয়ে মেজবাউল বলেন, “নতুন কেউ দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।”
এ বিষয়ে কথা বলতে চৌধুরী নাফিজ সরাফাতকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
একটি জাতীয় দৈনিক নাফিজ সরাফাতকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন, তার একটি ‘অস্ত্রোপচার’ হয়েছে। পুরোপুরি সুস্থ হতে ‘বেশ কয়েক মাস’ সময় লাগবে। ব্যাংকের কার্যক্রম যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে কারণে তিনি ‘সরে দাঁড়িয়েছেন’।
তবে একজন ব্যবসায়ী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, নাফিজ সরাফাত মঙ্গলবার রাতেও দেশে ছিলেন। ঢাকার একটি হোটেলে একটি ব্যবসয়িক বৈঠকে তাদের দেখাও হয়েছে। তার বিদেশে যাওয়ার যে খবর পত্রিকায় এসেছে, সেটা ‘হয়ত ভুল তথ্য’।
আর ব্যাংক খাত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল একটি সূত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছে, পদ্মা ব্যাংকের দুর্দশার মধ্যে নাফিজ সরাফাতকে আসলে চেয়ারম্যান পদ ‘ছাড়তে হয়েছে’।
অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে ২০১৭ সালে।
সে সময় চাপের মুখে চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর। পরের বছর ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, যিনি রেইস অ্যাসেট ম্যানেজেমেন্ট পিএলসি এবং কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডেরও চেয়ারম্যান।
পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তনের পর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ফারমার্স ব্যাংকের নাম হয় পদ্মা ব্যাংক।
পদ্মা ব্যাংককে উদ্ধার করতে সরকারের উদ্যোগে রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এর মাধ্যমে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন জোগান দেয়া হয়, যা ওই সময়ে ব্যাংকটির মোট মূলধনের ৬৬ শতাংশ।
ব্যাংক কোম্পানি আইনের একটি ধারা থেকে অব্যাহতি দিয়ে মূলধন যোগান দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের পদাধিকার বলে পদ্মা ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তখন থেকেই পাঁচ রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা পদ্মা ব্যাংকের পরিচালক হিসেব দায়িত্ব পালন করছেন।
আর্থিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ায় আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছিল না পদ্মা ব্যাংক। ওই অবস্থায় ২০২০ সালে কোনো রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দেয় তারা।
আরেকটি প্রস্তাবে যোগান দেয়া মূলধনের বিপরীতে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমপরিমাণ শেয়ার ইস্যু করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের মতামত জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে যে চিঠি দেয়, সেখানে বলা হয়, পদ্মা ব্যাংক সরকারি ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করার যে প্রস্তাব দিয়েছে সেটা ব্যাংক কোম্পানি আইনের সাথে ‘সমঞ্জস্যপূর্ণ নয়’।
এর আগে দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতকে শেয়ারে রূপান্তরের ঘটনা ঘটেনি। তবে ব্যক্তি আমানতকে শেয়ারে রূপান্তর করে ইস্টার্ন ব্যাংক পুনর্গঠন করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একমত হয়ে প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দেয় অর্থমন্ত্রণালয়। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পদ্মা ব্যাংকের পর্ষদকে বলা হয়েছিল, বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আনার চেষ্টা চালাতে।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির পক্ষ থেকে ৭০ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগ আনার ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ডেলমর্গান অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা সই করার কথা জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিও পাঠানো হয় গণমাধ্যমে।
ব্যাংকটির তখনকার এমডি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এহসান খসরু ৪ থেকে ৬ মাসের মধ্যে ওই বিনিয়োগ আসবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন। তবে পরে কী হয়েছে, ব্যাংকটির পক্ষ থেকে তা আর জানানো হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ২০২২ সালের জুলাই মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বিশেষ নজরদারিতে আনার উদ্যোগ নেন। শুরুতে ১০টি ব্যাংক নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। সেই তালিকায় উপরের দিকে ছিল পদ্মা ব্যাংক।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ এর পরামর্শে গত ডিসেম্বরেও সমস্যা জর্জরিত ও দুর্বল ব্যাংকের সংকট কাটিয়ে তোলার পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বিশেষ পরিকল্পনা নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
খেলাপি ঋণ কত
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকারে আসার পর প্রথম মেয়াদের শুরু থেকেই নতুন ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। ২০১৩ সালে এক সঙ্গে ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়, যার মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক অন্যতম।
যাত্রার তিন বছর পার করেই ধুঁকতে শুরু করে ব্যাংকটি। একসঙ্গে অনুমোদন পাওয়া বাকি ৮ ব্যাংক এত দুর্দশায় পড়েনি।
২০১৯ সালে ফারমার্স ব্যাংক থেকে পদ্মা ব্যাংক হওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৭০ কোটি টাকা।
২০২৩ সালের শেষে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণই ৩ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৬৪ শতাংশ।
অর্থাৎ নাফিজ সরাফাতের সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৬০২ কোটি টাকা।
গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির আমানত দাড়ায় ছয় হাজার ১৪১ কোটি টাকা। এই আমানতের মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) আমানত মোট এক হাজার কোটি টাকা।
আর সরকারের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড ও জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের ৭৬০ কোটি টাকা মিলিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতই দুই হাজার ৮৫০ কোটি টাকা।
ব্যাংকটি পুনর্গঠনের সময় দেওয়া আমানত দিয়ে এখন বিপাকে পড়েছে সরকারি এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। বিনিয়োগের বিপরীতে এক টাকাও মুনাফা পায়নি তারা।