“এখন বোর্ডের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করা হবে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রক্রিয়া হবে।"
Published : 08 Apr 2024, 06:23 PM
বেসরকারি খাতের পদ্মা ও এক্সিম ব্যাংকের মার্জারের পর এবার রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) একীভূত হচ্ছে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে।
সোমবার দুই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদই মার্জারের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পেলেই বিডিবিএল অধিগ্রহণের বাকি কাজ এগিয়ে নেমে সোনালী ব্যাংক।
বিডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমান কাজী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মার্জারের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে নির্দেশনা ছিল, সেটা আজ বোর্ডকে জানানো হয়েছে। পর্ষদ একমত হয়েছে যে, সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ হবে বিডিবিএল।
“এখন বোর্ডের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করা হবে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রক্রিয়া হবে।"
অর্থনীতিবিদরা গত কয়েক বছর ধরেই দেশে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে তাগিদ দিয়ে আসছিলেন। এর মধ্যে ঝুঁকিতে থাকা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রোডম্যাপ ঠিক করার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে এক বছর সময় দিয়ে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ একশন, পিসিএ’ নীতি ঘোষণা করা হয়।
ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার, মূলধনের পর্যাপ্ততা, নগদ অর্থের প্রবাহ, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের তথ্য বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন সূচকের মানদণ্ডে আর্থিক স্বাস্থ্য নিরূপণ করা হয়।
কাঙ্ক্ষিত মানদণ্ডের নিচে থাকা ব্যাংকগুলোকে দুর্বল হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। র্দুবল ব্যাংক টেনে তুলতে শেষ পদক্ষেপ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা রেখেছে। সরকারও তাতে সায় দিয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেন, “বিভিন্ন ব্যাংক, আসলে যেগুলো হয়ত ভালোভাবে চালাতে পারছে না। ইতোমধ্যে একটি ব্যাংক একীভূত করে দিয়েছি। পদ্মা ব্যাংক করা হয়েছে। ঠিক এভাবে আমরা নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমরা কিন্তু বসে নেই, কাজ করে যাচ্ছি।”
দুর্দশায় থাকা পদ্মা ব্যাংক একীভূত হচ্ছে শরীয়ভিত্তিক ব্যাংক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে। ইতোমধ্যে ব্যাংক দুটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পেয়ে চুক্তিবদ্ধও হয়েছে।
ওই চুক্তির পর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে মার্জারের আলোচনা শুরু হয়। এর মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত বুধবার বিকেলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়ে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই বৈঠকে দুর্বল ব্যাংককে সবলের সঙ্গে একীভূত করার বিষয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়।
কোন ব্যাংক কার সঙ্গে একীভূত হবে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা না হলেও ধারণা দেওয়া হয় যে, ব্যাংকগুলো নিজেদের পছন্দে বাছাই করতে পারবে।
সরকারের উচ্চ পর্যায় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে বিডিবিএলের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেন সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা, যা সোমবার পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করা হয়।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিডিবিএলকে সোনালীর সঙ্গে মার্জ করতে পরিচালক পর্ষদ অনুমোদন দিয়েছে। ঈদের পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকতা সারা হবে, তখন আমরা সমঝোতা চুক্তি করব। মার্জারের প্রক্রিয়া কীভাবে সারা হবে, সমঝোতা চুক্তিতে তার বিস্তারিত থাকবে।”
১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে শিল্প খাতের বিকাশে ‘বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক’ ও ‘বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা’ নামে দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়।
আশানুরূপ সাফল্য দেখাতে না পারায় ২০০৯ সালের নভেম্বরে প্রতিষ্ঠান দুটিকে একীভূত করে সরকার। নতুন নাম হয় বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড বা বিডিবিএল। তখন ব্যাংকটির শাখা সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭টি।
কোম্পানি আইন সংশোধনের পরে নামের শেষে লিমিটেডের পরে পিএলসি যোগ করা বাধ্যতামূলক করায় এখন তা বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি।
রাষ্ট্রায়ত্ত অন্যান্য ব্যাংকের চেয়ে বিডিবিএলের আর্থিক ভিত্তি ‘শক্তিশালী’ দাবি করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমান কাজী বলেন, “আমাদের ব্যাংকের পরিধি খুব একটা বড় না। সারা দেশে মাত্র ৫০টি শাখা। এটি যেমন একটি দুর্বল দিক, আবার এটিই সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। পরিসর ছোট হওয়ায় ঋণ কেলেঙ্কারি নেই। আমরা প্রকৃতভাবেই মুনাফায় আছি।”
অন্যদিকে সোনালী ব্যাংক বাংলাদেশে রাষ্ট্র মালিকানাধীন সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক ব্যাংক। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক (জাতীয়করণ) অধ্যাদেশ, ১৯৭২’-এর ক্ষমতাবলে পূর্ব পাকিস্তানে কার্যরত ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ব্যাংক অব বাহ্ওয়ালপুর এবং প্রিমিয়ার ব্যাংক নিয়ে ‘সোনালী ব্যাংক’ গঠিত হয়। ২০০৭ সালে এ ব্যাংক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়।
বর্তমানে ১২৩২টি শাখার মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে সোনালী ব্যাংক, এর মধ্যে বিদেশে দুটি শাখা রয়েছে। ওয়েব সাইটের তথ্য অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা ২ কোটি ৪৭ লাখের মত। কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ১৮ হাজার ১১৫ জন।
এদিকে দুর্দশায় থাকা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে বলেও খবর এসেছে।
সংবাদ মাধ্যমে আসা খবরে বলা হচ্ছে, সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিনের একটি বৈঠক হয়। সেখানেই বেসিক ব্যাংককে সিটির সঙ্গে একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত হয়।
এখন দুই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সায় দিলে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পেলে তখন সমঝোতা চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা সারা হবে।
তবে সিটি ব্যাংক বা বেসিক আনুষ্ঠানিকভাবে মার্জারের বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করেননি।
নীতিমালায় যা আছে
‘স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যাংক-কোম্পানির একীভূতকরণ সম্পর্কিত নীতিমালা’য় এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, “এ কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হল অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকের বিদ্যমান সমস্যা সমাধান এবং একইসাথে অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের কার্যক্রম উন্নয়নের মাধ্যমে আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা; যাতে করে জনস্বার্থে একীভূত ব্যাংক-কোম্পানি অধিকতর সেবা প্রদান করতে পারে।”
নীতিমালায় এক বা একাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সুযোগ রাখা হয়।
দুর্বল ব্যাংকের পুঞ্জীভূত লোকসান ধীরে ধীরে গ্রহীতা ব্যাংকের আয় থেকে সমন্বয় করা হবে জানিয়ে নীতিমালায় বলা হয়, একীভূত হতে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডার ও বিনিয়োগকারীদের অনুমোদন নিতে বিশেষ সাধারণ সভা ডাকতে হবে। সভায় অনুমোদন পেলেই তা কার্যকর করতে পারবে।
এরপর প্রস্তাব আকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠাতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে একীভূত প্রক্রিয়ায় যেতে পারবে ব্যাংক।
‘পিসিএ’ ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী, চলতি বছরের আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আগামী বছরের মার্চের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকের তালিকা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর আগে ডিসেম্বরের মধ্যে কোনো ব্যাংক চাইলে স্বেচ্ছায় অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে পারবে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্যতামূলকভাবে একীভূত হতে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে।
বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়ার বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, বাধ্যতামূলক একত্রীকরণের বেলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের পর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের দায় ও সম্পদ গ্রহণ করতে দরপত্র দেওয়া হবে পত্রিকায়।
দরপত্রে সাড়া না পাওয়া গেলে বা আবেদনকৃত কোম্পানির সক্ষমতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সন্তুষ্ট না হলে, যে কোনো এক বা একাধিক ব্যাংককে স্কিমের আওতায় এনে যে কোনো ব্যাংককে দায়িত্ব গ্রহণে নির্দেশ দিতে পারবে।